খান মো. রবিউল আলম : বাংলাদেশ একটি প্রকল্পশাসিত দেশ। প্রকল্প মানে স্বপ্লমেয়াদী উন্নয়ন উদ্যোগ। উদ্যোগ না বলে তৎপরতা বলাই সমীচীন। কারণ, প্রকল্প নিষ্কলঙ্ক নয়। প্রকল্প হলো সুনির্দিষ্ট ক্ষত। বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার দুদশকের অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রকল্প বরাদ্দের কমপক্ষে ১৫-২০ ভাগ অনিয়ম বা দুর্নীতিতে খরচ হয়।
দুর্নীতিযুক্ত প্রকল্পগুলোর বার্নরেট ভালো মানে খরচের হার বা কর্মতৎপরতা অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় বেশি। কারণ, এখানে ফাইল ঘুরে বেশি। আর ফাইল ঘুরলে আসে নগদনারায়ণ। যেসব প্রকল্পে দুপয়সা বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই সেগুলো স্থবির প্রকল্প।
প্রকল্প মানেই কাগজ-কালি, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, ফিকচার-ফার্নিচার আর মানবসম্পদের বড় কর্মকাণ্ড। প্রকল্প অফিস থাকে শহরে-মহানগরে। তিনবছর বা পাঁচবছর মেয়াদী তৎপরতা। অনেক সময় শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। প্রকল্প সাধারণত পাঁচ বছরের মেয়াদী হয়। তবে এমন কিছু প্রকল্পও আছে যার তিনটি পর্ব থাকে এবং চলে ১০ থেকে ১৫ বছর অবধি। তবে সরকারি ৮০ শতাংশ প্রকল্পই হয় পাঁচ বছর মেয়াদী। প্রকৃতপক্ষে প্রকল্প হলো নির্দিষ্ট ফোকাসধর্মী স্বল্পমেয়াদী কাজ। প্রকল্পের ভেতর রয়েছে এক ধরনের তাৎক্ষণিকতা।
কোনো চাহিদার তাৎক্ষণিক সমাধান। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হয় না। সমস্যাটি যেন আবার তৈরি না হয় তার জন্য লেগে থাকতে হয়। যেমনÑ দেশজুড়ে যে বিস্তৃত পাকা সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে তা করা হয়েছে মূলত অনেক প্রকল্পের আওতায়।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সড়ক পাকা করার পর তার মেয়াদ চার বছর হলে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজস্ব খাতের আওতায় চলে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশে যে পরিমাণ সড়ক পাকা হয়েছে, সেই তুলনায় এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ অপ্রতুল। ধারণা করা হয়, তা চাহিদার তুলনায় তা মাত্র ১৫ শতাংশ। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেশব্যাপী পাকাসড়ক নেটওয়ার্কের পরিমাণ দেড় লাখ কিলোমিটারের ওপরে আর সড়ক ও জনপথের ২১ হাজার কিলোমিটারের উপরে। তাই সড়ক নির্মাণ শেষ কথা নয়।
নির্মিত সড়ক অবকাঠামো সব মৌসুমে চলাচলের উপযোগী রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি উন্নয়ন থেকে যদি টেকসই রিটার্ন পেতে চাই তাহলে সেগুলো ব্যবহার উপযোগী রাখা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে রিটার্ন আসবে না, অর্থনীতি রোল করবে না। আয় বাড়বে না। দেশ উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারাবে।
অন্যদিকে প্রকল্পে অধিকাংশ অবকাঠামো নির্মাণত্রুটি নিয়ে তৈরি হয়, কাজ হয় মানহীন। এ কারণে সড়ক অবকাঠামোর আয়ুষ্কাল কমে আসে। এ মানহীনতা কেবল পেশাদারি দক্ষতা, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি বা গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তের সীমাবদ্ধতা নয়। এর পেছনে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির শক্ত ভিত। প্রকল্প ঘিরে যত ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়, তার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে কাজের মানের ওপর। যেমন ধরুন প্রকল্পের পক্ষ থেকে যখন কাজের মান তদারকি করতে মাঠে যাওয়া হচ্ছে ঠিকাদার তখন তদারকি দলের সদস্যদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন, টিমকে উপহার দিচ্ছেন এবং তা করছেন নিজের স্বার্থে। নিশ্চয় এ টাকা তিনি পকেট থেকে খরচ করছেন না। কাজের কোনো না কোনো অংশ থেকে তিনি পুষিয়ে নেবেন। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অনিয়ম স্বাভাবিক রূপ লাভ করেছে।
দুর্নীতির ব্যাপারে মানুষের সহনশীল মনোভঙ্গি সামাজিক বাস্তবতার এক নতুন দিক। কারণ মানুষ দুর্নীতিকে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু মনে রাখতে হবে নৈতিকতা দিয়ে সব সময় জীবন চলে না। যেখানে কোনো সিস্টেম গড়ে উঠেনি সেখান সৎ থাকা বা দুর্নীতিমুক্ত থাকা ব্যয়বহুল ব্যাপার। এটা জনগণসহ প্রকল্প ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও ঠিকাদার সবাই বুঝে গেছে।
ক্ষমতা, দায়িত্ব ও অর্থের অপব্যবহারের সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতির সম্পর্ক। ঘুষ হলো অর্থের অপব্যবহার সম্পর্কিত দুর্নীতির একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। ঘুষ দিলে দ্রুত কাজ হয়। এ কারণে ঘুষের উপযোগিতা তৈরি হয়েছে। সৎ থাকতে গেলে অফিসে ঘুরতে হয়, বারবার অনুরোধ করতে হয়, তদবির করতে হয়, কাজ না হওয়ার মানসিক চাপ নিতে হয়। ঘুষ না দিয়ে কাজ করানো বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে।
সরেজমিন দেখেছি, ঠিকাদাররা বিল নিতে বা স্কিম অনুমোদনের জন্য ঘুষ দিতে না পারলে মন খারাপ করেন, এমনকি কাজ নাও হতে পারে জেনে ঘুষ দেন। প্রকল্পগুলোয় ঘুষ ম্যানেজমেন্টের নিজস্ব স্টাইল দাঁড়িয়ে গেছে।
মানুষের মধ্যে ঘুষ দেওয়ার নতুন মনোভঙ্গি তৈরি হয়েছে। বিশেষত ঠিকাদার শ্রেণি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো এ অপচেষ্টায় এগিয়ে আছেন। প্রকল্পজীবী মানে যার প্রকল্প হাতে নেন, অর্থায়ন করেন, বাস্তবায়ন করেন, বাস্তবায়নের সহায়তা করেন, তারা প্রত্যক্ষ -পরোক্ষভাবে এ ঘুষ নেক্সাসের সঙ্গে যুক্ত। ঘুষ একক ব্যাপার নয়, এর রয়েছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎদলীয় তৎপরতা। ঘুষ অনেক পক্ষের পারস্পরিক সমঝোতামূলক অপতৎপরতা। প্রকল্প বাংলাদেশ নতুন এক ক্যাশবেইজ শ্রেণী উপহার দিয়েছে-যাদের হাতে অঢেল টাকা। নতুন এ ক্যাশবেইজ শ্রেণী সমাজের সবস্তরকে প্রভাবিত করছে।
দরপত্রে অংশগ্রহণের আগে, মধ্যে ও পরে কাজের জন্য কী পরিমাণ ঘুষ দিতে হবে তা মূল্যায়ন করেই তারা বিডিংয়ে নামছেন। এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক শাসকগোষ্ঠীর রয়েছে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ব্যবসায়ী-রাজনীতি-আমলানির্ভরÑ এ নেক্সাস কমবেশি সবার জানা।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি হিসেবে গজিয়ে উঠেছে। তারা মূলত শ্রমশোষক। প্রকল্পের আওতায় নিযুক্ত কর্মীদের যে বেতন দেয় প্রকল্পের কাছ থেকে তার ডাবল চার্জ করে। আবার প্রকল্প থেকে ১০ পারসেন্টের মতো সার্ভিস চার্জ নেয়। তারা যেতেও কাটে, আসতেও কাটে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে নৈতিকতা ও মান তলানির পর্যায়ে। বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে তা আরও করুণ অবস্থায় গেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে অভিযোজিত হতে গিয়ে মানুষের সার্বিক নৈতিকমান পড়ে গেছে। তারা অভিনয়ে পারঙ্গম, নগদজীবী ও কাঁচা মানুষ হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা, টাকা, আধিপত্য এ জটিল রসায়নে আবর্তিত হচ্ছে জনমনস্তত্ত্ব।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দেশের এক বৃহৎ উন্নয়ন সংস্থার ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছে, সেখানে ঠিকাদারকে কাজের মোট টাকার ওপর শতকরা ৮-১০ ভাগ ঘুষ দিতে হয়। লেখার শুরুতে ঘুষের রেট নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ঘুষের রেট বেড়েছে। এর সঙ্গে হয়ত বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা মুদ্রাস্ফীতির সম্পর্ক থাকতে পারে। এক সময় এক হাজার টাকায় যে কাজ হতো, এখন তাতে পাঁচ হাজার টাকা লাগে। ঘুষ এখন সিস্টেমেটিক ব্যাপার, সহনশীল ও গ্রহণযোগ্য প্রবণতা।
২০১৯ সালের ২৭ অগাস্ট একটি দৈনিক সংবাদপত্রে সলিমুল্লাহ খান ‘আহমদ ছফার গব্যপুরাণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেনÑ “ঘুষ’ ফারসি শব্দ, আদি অর্থ ‘কান’। কানে ফিসফিস করিয়া যে টাকা গছাইয়া দেওয়া হয় তাহাকেই ‘ঘুষ’ বলে। এই ক্রমে শব্দ কিংবা বাক্য যাহা ঘুষ পর্যন্ত পৌঁছায় তাহার নাম ‘ঘোষণা’। এমনকি ঘুষ অর্থাৎ কান বরাবর যে আঘাত তাহার নাম ‘ঘুষি’।”
ঘুষের অস্বাভাবিকতায় সবাই উদ্বিগ্ন। বালিশ ক্রয়, সরকারি অফিসে বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয়ে দুর্নীতির প্রতিবেদন দেখে পাঠক আহত হন, উদ্বিগ্ন হন। এ আহত বা উদ্বিগ্নতা যত না ঘুষের কারণে তার চেয়েও ঘুষের পরিমাণগত অস্বাভাবিকতার কারণে। এ অস্বাভাবিকতাই হলো ‘ঘুষ শক’।
কাজ পেতে বা সেবা নিতে ঘুষ দেওয়া এক সহনশীল অভ্যাসের মধ্যে চলে এসেছে। মানুষ বুঝে গেছে কাজ উদ্ধারে ঘুষ ছাড়া ‘উন্নত’ বিকল্প নেই। অনেকে মনে করেন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে ঘুষের পরিমাণ কমেছে। বাস্তবতা হলো সরকার পরিবর্তন হলেও বিভিন্ন অফিসে গড়ে উঠা ঘুষ নেক্সাসগুলো বহাল রয়েছে। প্যারাডাইমগত পার্থক্য হলো ‘সরব ঘুষ থেকে নীরব ঘুষে উত্তরণ’।
ঘুষ দিতে পারা অনেকের কাছে আনন্দ ও বিশেষ দক্ষতার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যারা ঘুষ দেন তারাও একে বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন, কয়েকগুণ সুদে-আসলে তা তুলে নেন। ঘুষের চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয় জনগণকে। কারণ, সরকারি টাকা তো জনগণের টাকা। প্রকল্পের টাকাও জনগণের টাকা। বাস্তবতা হলো জনগণকে একটি ঘুষনির্ভর সমাজে বাস করতে হচ্ছে।
আকবর আলি খানের বিখ্যাত বই ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’র একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি’। মূলত এ অংশে ঘুষ ও দুর্নীতির ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
লেখক এ অংশে মাইকেল ক্যারিটÑ যিনি ১৯২৯ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং চাকরি ছাড়ার ৫০ বছর পর যে স্মৃতিকথা লেখেন তা থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেনÑ ‘ইতোমধ্যে পাঞ্জাবি লোকটি কপট বিনয়ের সঙ্গে মাফ চাইল। তারপর সে শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে তার মুখস্থ বক্তৃতা ঝাড়লো: হুজুর হচ্ছেন মহানুভব ব্যক্তি। এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছেন সজ্জন যারা ঘুষ খান না, যেমনÑ আপনি। আছে বদলোক যারা ঘুষ খায় এবং (আমার চোখের দিকে চেয়ে) আছে শুয়রের বাচ্চারা যারা ঘুষ নেয় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকে কোনো সাহায্য করে না। সালাম (হুজুর সালাম)।’ স্মৃতিকথার উপসংহারে মাইকেল ক্যারিট লিখেছেন যে, তিনি তার দীর্ঘ জীবনে সজ্জন, বজ্জাত ও শুয়রের বাচ্চাÑ এ তিন কিসিমের লোকই দেখেছেন।
সরকারি ও উন্নয়ন সংযোগীদের ঘুষ বা দুর্নীতি প্রতিরোধে নীতি, আইন ও কাঠামোর অভাব নেই। কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। ঘুষ বন্ধে প্রয়োজন কার্যকর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘুষ বন্ধ করা গেলে তা কমে পক্ষে জনগণের ২০-৩০ ভাগ অর্থ সাশ্রয় করবে।
লেখক: করেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টিভি ও গবেষক