ঢাকা ০৭:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫

পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারের জঞ্জাল, আইন ও বাস্তবতা

  • আপডেট সময় : ০৭:৪০:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

তারেক অপু

পোস্টার, ফেস্টুন বা ব্যানার টাঙিয়ে কোনো দলের পক্ষে ভোট প্রার্থনা; কাউকে শুভেচ্ছা জানানো; নেতা হিসেবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের প্রচার নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এই প্রচলন আমাদের দেশে চলে আসছে। প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিকর না হওয়ায় এ নিয়ে অধিকাংশ মানুষেরই মাথাব্যথা নেই।

২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন রাজনৈতিক ফেস্টুন-ব্যানার উধাও হয়ে গিয়েছিল। তখন চোখে পড়তো বিভিন্ন কোম্পানির ফেস্টুন-ব্যানার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ফেস্টুন-ব্যানার ফের বাড়তে থাকে। বড় শহর (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও কুমিল্লা) থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও এগুলো চোখে পড়ে। বিভিন্ন মহাসড়কের পাশজুড়েই অবস্থান করে নিয়েছে এই ফেস্টুন-ব্যানার।

বিভিন্ন মহাসড়কের পাশজুড়েই অবস্থান করে নিয়েছে ওই ফেস্টুন-ব্যানার। ফলে অনেক স্থানে চালকদের গাড়ি চালাতে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে মোড়ে মোড়ে ফেস্টুন-ব্যানার খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। অনেক স্থানে গাছ ঢেকে গেছে এগুলোয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে দেওয়াল ছেঁয়ে গেছে পোস্টারে। পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারের ব্যবহার এমন পর্যায়ে গেছে যে, এগুলোকে এখন জঞ্জাল বললে অতিরিক্ত বলা হবে না। ঢাকা শহরের কিছু গলি বিশেষ করে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের আশপাশে ফাঁকা জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ওইসব দলের শীর্ষ নেতাদের বাসার আশপাশেও একই অবস্থা। এই পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে; কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এগুলো টাঙানো হয়েছে, সেই নেতারা এগুলো দেখেন কি না- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিভিন্ন গাছে পেরেক ঢুকিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন আটকে দেওয়া হচ্ছে। এতে গাছের বৃদ্ধি কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া কাঠও নষ্ট হচ্ছে। বাইরে থেকে এটা দেখলে বোঝা যাবে না। যখন গাছ কেটে কাঠ তৈরি করা হবে; তখন পেরেকের জায়গায় পঁচা ধরা পড়বে। আসলে নিজের অজান্তেই আমরা গাছের ক্ষতি করছি। অত্যাধিক পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের ফলে শ্রী হারাচ্ছে শহর-নগর।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর, গুলশান, বনানী, মহাখালী, খিলগাঁও, পল্টন, প্রেস ক্লাব, গুলিস্তান ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে- সবখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের নামে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন ঝুলছে; এমনকি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের বাউন্ডারিও এখন পোস্টারে ঢেকে গেছে। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছবি সংবলিত পোস্টারই বেশি দেখা গেছে। পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও আইনজীবীরাও পিছিয়ে নেই। ঢাকার অনেক ডাক্তার মফস্বল শহরে গিয়ে রোগী দেখেন। রোগী ও স্বজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ডাক্তারের যোগ্যতা সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানো হয়। আইনজীবীদের চেম্বারের ঠিকানা সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনও ঝুলছে অনেক জায়গায়।

কয়েকদিন আগে রাজবাড়ী-১ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস আমার চোখে পড়ল। তিনি নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন শহরের প্রধান সড়কে যারা ব্যানার-ফেস্টুন লাগাবেন, তারা যেন গাছের গায়ে পেরেক না ঢোকান। অর্থাৎ তিনি সুতা বা রশি ব্যবহারের কথা বলেছেন। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তিনি যদি ফেস্টুন-ব্যবহার বিধি বা আইন মেনে চলার পরামর্শ দিতেন, তাহলে আরও ভালো হতো। এখন হয়তো অনেকেই আকাশ থেকে পড়বেন? বলবেন পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার ব্যবহারের আবার আইন আছে নাকি? হ্যাঁ, আছে। আপনি ইচ্ছা করলেই যেখানে সেখানেপোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙাতে পারেন না।

যে কোনো ব্যানার টাঙানোর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (সিটি কর্পোরেশন জাতীয় প্রতিষ্ঠান) কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া অপরিহার্য। আইন অনুযায়ী, ব্যানার লাগানোর জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থান রয়েছে; যা সাধারণত নির্দিষ্ট পোস্টার বা বিলবোর্ডের জন্য নির্ধারিত হয়। আইন ভাঙলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ব্যানার টাঙানোর সময় মনে রাখতে হবে যে, এটি সরকারি বা জনসাধারণের সম্পত্তি নষ্ট করছে কি-না। কী আছে সেই আইনে? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের ব্যবহার সংক্রান্ত একটি আইন করা হয় ২০১২ সালে। এতে বলা হয়েছে-
(১) কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।

(২) কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।

(৩) কোন সুবিধাভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ (ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, এই আইনে কী কারো শাস্তি হয়েছে? হ্যাঁ, হয়েছে। বছর দুয়েক আগে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত এক মাসে নগরজুড়ে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার অবৈধ ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অবৈধ পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারকে জঞ্জাল বলেও আখ্যা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

গত ৬ নভেম্বর নগরভবনে ‘ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ কার্যক্রম’ বিষয়ক বিভাগীয় পর্যালোচনা সভা শেষে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ১ লাখ ২৫ হাজার ফেস্টুন-ব্যানার অপসারণের তথ্য দিয়েছিলেন। সাত দিনের মধ্যে অবৈধ পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার কথা বলছে প্রতিষ্ঠানটি। শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিয়েই তারা এ কাজ করছেন। অপসারণ করার পর পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনগুলো ডাম্পিং করা হচ্ছে। সারাদেশের বিপুল পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন কিন্তু ডাম্পিং করা হচ্ছে না। এগুলো আপনা-আপনি নষ্ট হয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। অবশেষে উচ্ছিষ্ট অংশের ঠিকানা হচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল। ফলে কমছে পানির অক্সিজেনের মাত্রা। হুমকিতে পড়ছে মাছ ও জলজ প্রাণী।

মনে রাখতে হবে, দেশটি আমাদের। এর ভালো-মন্দ আমাদেরই ভাবতে হবে। কেবল আইন দিয়ে সব কিছু হবে না। আগে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য।

লেখক: সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারের জঞ্জাল, আইন ও বাস্তবতা

আপডেট সময় : ০৭:৪০:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

তারেক অপু

পোস্টার, ফেস্টুন বা ব্যানার টাঙিয়ে কোনো দলের পক্ষে ভোট প্রার্থনা; কাউকে শুভেচ্ছা জানানো; নেতা হিসেবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের প্রচার নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এই প্রচলন আমাদের দেশে চলে আসছে। প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিকর না হওয়ায় এ নিয়ে অধিকাংশ মানুষেরই মাথাব্যথা নেই।

২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন রাজনৈতিক ফেস্টুন-ব্যানার উধাও হয়ে গিয়েছিল। তখন চোখে পড়তো বিভিন্ন কোম্পানির ফেস্টুন-ব্যানার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ফেস্টুন-ব্যানার ফের বাড়তে থাকে। বড় শহর (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও কুমিল্লা) থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও এগুলো চোখে পড়ে। বিভিন্ন মহাসড়কের পাশজুড়েই অবস্থান করে নিয়েছে এই ফেস্টুন-ব্যানার।

বিভিন্ন মহাসড়কের পাশজুড়েই অবস্থান করে নিয়েছে ওই ফেস্টুন-ব্যানার। ফলে অনেক স্থানে চালকদের গাড়ি চালাতে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে মোড়ে মোড়ে ফেস্টুন-ব্যানার খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। অনেক স্থানে গাছ ঢেকে গেছে এগুলোয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে দেওয়াল ছেঁয়ে গেছে পোস্টারে। পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারের ব্যবহার এমন পর্যায়ে গেছে যে, এগুলোকে এখন জঞ্জাল বললে অতিরিক্ত বলা হবে না। ঢাকা শহরের কিছু গলি বিশেষ করে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের আশপাশে ফাঁকা জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ওইসব দলের শীর্ষ নেতাদের বাসার আশপাশেও একই অবস্থা। এই পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে; কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এগুলো টাঙানো হয়েছে, সেই নেতারা এগুলো দেখেন কি না- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিভিন্ন গাছে পেরেক ঢুকিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন আটকে দেওয়া হচ্ছে। এতে গাছের বৃদ্ধি কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া কাঠও নষ্ট হচ্ছে। বাইরে থেকে এটা দেখলে বোঝা যাবে না। যখন গাছ কেটে কাঠ তৈরি করা হবে; তখন পেরেকের জায়গায় পঁচা ধরা পড়বে। আসলে নিজের অজান্তেই আমরা গাছের ক্ষতি করছি। অত্যাধিক পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের ফলে শ্রী হারাচ্ছে শহর-নগর।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর, গুলশান, বনানী, মহাখালী, খিলগাঁও, পল্টন, প্রেস ক্লাব, গুলিস্তান ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে- সবখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের নামে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন ঝুলছে; এমনকি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের বাউন্ডারিও এখন পোস্টারে ঢেকে গেছে। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছবি সংবলিত পোস্টারই বেশি দেখা গেছে। পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও আইনজীবীরাও পিছিয়ে নেই। ঢাকার অনেক ডাক্তার মফস্বল শহরে গিয়ে রোগী দেখেন। রোগী ও স্বজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ডাক্তারের যোগ্যতা সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানো হয়। আইনজীবীদের চেম্বারের ঠিকানা সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনও ঝুলছে অনেক জায়গায়।

কয়েকদিন আগে রাজবাড়ী-১ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস আমার চোখে পড়ল। তিনি নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন শহরের প্রধান সড়কে যারা ব্যানার-ফেস্টুন লাগাবেন, তারা যেন গাছের গায়ে পেরেক না ঢোকান। অর্থাৎ তিনি সুতা বা রশি ব্যবহারের কথা বলেছেন। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তিনি যদি ফেস্টুন-ব্যবহার বিধি বা আইন মেনে চলার পরামর্শ দিতেন, তাহলে আরও ভালো হতো। এখন হয়তো অনেকেই আকাশ থেকে পড়বেন? বলবেন পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার ব্যবহারের আবার আইন আছে নাকি? হ্যাঁ, আছে। আপনি ইচ্ছা করলেই যেখানে সেখানেপোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙাতে পারেন না।

যে কোনো ব্যানার টাঙানোর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (সিটি কর্পোরেশন জাতীয় প্রতিষ্ঠান) কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া অপরিহার্য। আইন অনুযায়ী, ব্যানার লাগানোর জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থান রয়েছে; যা সাধারণত নির্দিষ্ট পোস্টার বা বিলবোর্ডের জন্য নির্ধারিত হয়। আইন ভাঙলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ব্যানার টাঙানোর সময় মনে রাখতে হবে যে, এটি সরকারি বা জনসাধারণের সম্পত্তি নষ্ট করছে কি-না। কী আছে সেই আইনে? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের ব্যবহার সংক্রান্ত একটি আইন করা হয় ২০১২ সালে। এতে বলা হয়েছে-
(১) কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।

(২) কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।

(৩) কোন সুবিধাভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ (ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমত, পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, এই আইনে কী কারো শাস্তি হয়েছে? হ্যাঁ, হয়েছে। বছর দুয়েক আগে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত এক মাসে নগরজুড়ে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার অবৈধ ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অবৈধ পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারকে জঞ্জাল বলেও আখ্যা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

গত ৬ নভেম্বর নগরভবনে ‘ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ কার্যক্রম’ বিষয়ক বিভাগীয় পর্যালোচনা সভা শেষে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ১ লাখ ২৫ হাজার ফেস্টুন-ব্যানার অপসারণের তথ্য দিয়েছিলেন। সাত দিনের মধ্যে অবৈধ পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার কথা বলছে প্রতিষ্ঠানটি। শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিয়েই তারা এ কাজ করছেন। অপসারণ করার পর পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনগুলো ডাম্পিং করা হচ্ছে। সারাদেশের বিপুল পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন কিন্তু ডাম্পিং করা হচ্ছে না। এগুলো আপনা-আপনি নষ্ট হয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। অবশেষে উচ্ছিষ্ট অংশের ঠিকানা হচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল। ফলে কমছে পানির অক্সিজেনের মাত্রা। হুমকিতে পড়ছে মাছ ও জলজ প্রাণী।

মনে রাখতে হবে, দেশটি আমাদের। এর ভালো-মন্দ আমাদেরই ভাবতে হবে। কেবল আইন দিয়ে সব কিছু হবে না। আগে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য।

লেখক: সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ