হাসান মামুন : কোরবানি ঈদে মসলার দাম বাড়তে দেখা যায়। এবারও সে প্রবণতা ছিল। তবে বেশি দুশ্চিন্তা ছিল পেঁয়াজ নিয়ে। এর দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকা হয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ ছিল অনেকের। সেটা না হলেও দাম ১০০-র কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। ঈদের পর দাম কিছুটা কমবে বলে যারা ধারণা করেছিলেন, তারাও এখন হয়তো অবাক নতুন করে এর দাম বৃদ্ধি দেখে। পেঁয়াজের দাম মানভেদে ১১০-১২০ টাকা হয়ে গেছে এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত।
মসলাপণ্যের মধ্যে পেঁয়াজের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। রেস্তোরাঁয়ও এর চাহিদা বিরাট। আদা, রসুনের চাহিদাও একেবারে কম নয়। ঈদের পর এগুলোর দাম কিছুটা কমার খবর অবশ্য রয়েছে। চাহিদা কমায় এগুলোর দাম কমে থাকলে বলতে হয়, তাহলে কি পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে? কোরবানি ঈদের সময়টা তো অতিক্রান্ত। তাহলে কি পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি? এর উৎপাদন বিষয়ে যে তথ্য সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে, তাতে এবারও চাহিদার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে দেশে। এটাও সত্য, সংরক্ষণের অসুবিধায় প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। সেজন্য এর কিছু আবার করতে হয় আমদানি।
সুবিধাজনক বলে ভারত থেকেই আমরা চেষ্টা করি বেশি পেঁয়াজ আনতে। সাম্প্রতিককালে সে সুযোগ তৈরিও হয়েছিল দেশটির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে দাম পড়ে যাচ্ছে, সেটা সুবিধাজনক নয় বলে আমদানিও তেমন হয়নি গেল কমাসে। প্রতিযোগিতামূলক দামে আনতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকেও পড়েন। এমন খবর অন্য আমদানিকারকদের উৎসাহিত করার কথা নয়। এদিকে দেশীয় পেঁয়াজের ব্যাপারেই আবার ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। এটা বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায়। বড় সাইজের পেঁয়াজও দেশে কম উৎপাদিত হচ্ছে না। পাবনা, ফরিদপুরের মতো কিছু অঞ্চল মানসম্মত পেঁয়াজ উৎপাদনে খ্যাতিও অর্জন করেছে।
গেল মৌসুমে পেঁয়াজ ফলিয়ে কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন বলেও খবর মিলছিল। এ কারণে মৌসুমের শুরুতেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও দেখতে হয়। এর পেছনে উৎপাদন হ্রাসের ব্যাপার ছিল কিনা, সেটা অবশ্য খতিয়ে দেখা হয়নি। তবে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে এটা আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সাধারণত উত্তোলন মৌসুমে কৃষিপণ্য আমদানিতে উৎসাহ জোগানো হয় না দেশের উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভেবে। সেটা ঘটতোও– ভারত থেকে কম দামে পেঁয়াজ আনা গেলে। তা সম্ভব না হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রভাব পড়েনি বললেই চলে।
বিশেষ ক্ষেত্র বাদে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজই বাজারে চলছে বেশি। এর দাম বৃদ্ধির প্রবণতাও বহাল। তবে কোরবানি ঈদের পর দাম নতুন করে বাড়লো কেন, সেটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ঈদের ছুটিতে পেঁয়াজ আমদানি না হওয়া, ঢিলেমি, বৃষ্টিবাদলে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় থাকতে পারে। ব্যাপারটিকে শুধু বিক্রেতাদের ‘অজুহাত’ বলে বর্ণনা করা ঠিক হবে না। এটা হয়ে যাবে সরলীকরণ। সবারই প্রতিদিন কমবেশি লাগে বলে পেঁয়াজের দাম নিয়ে আলোচনাও বেশি। এ নিয়ে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। নিকটেই একবার তো পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে প্রায় ৩০০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। এবার পরিস্থিতি শেষতক কী দাঁড়াবে, সেটা হয়তো বলতে পারবেন পণ্যবাজার বিশ্লেষকরা। তবে কোনো নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকলে আর তা সংরক্ষণযোগ্য হলে একশ্রেণির ক্রেতার মধ্যে সেটা বেশি করে কিনে মজুদের প্রবণতা বেড়ে যায়। দাম আরও বাড়ার শংকাতেই লোকে এমন আচরণ করে। তাতে দাম আরও বেড়ে যায়। তবে এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারে না তারা, যারা ইতোমধ্যে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে কেনাকাটাই কমিয়ে দিয়েছে।
পেঁয়াজের মতো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সবজি আলুর দামও বেড়েছে একই সময়ে, নতুন করে। গেল বছরও আলুর দাম বেড়েছিল এবং সে কারণে এটা আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হয় সরকারকে। আলুতে আমরা এতখানি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম যে, এটা আমদানির চিন্তাও করতে হয়নি অনেক বছর। আলু আমদানির সিদ্ধান্তে তাই অনেকে অবাক হয়েছিলেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছিলেন, উৎপাদন কমাতেই দেখা দিয়েছে সংকট। হিমাগারে আলু রাখার জায়গা কিছুটা খালি থাকায় ব্যবসায়ীরাও বুঝেছিলেন, উৎপাদন কম হয়েছে। পরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সেটা একরকম স্বীকার করে নেয়– যখন অনুমতি দেওয়া হয় আলু আমদানির। ততদিনে এর দাম অবশ্য গিয়েছিল বেড়ে। এবারও আলুর দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এর আমদানি বাড়াতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। আলু এত গুরুত্বপূর্ণ যে, একে চালের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। এদেশে আলুর দাম চালের চেয়ে কম থাকবে, এটাকেই মনে করা হয় আদর্শ। চালের দাম বাড়লে বেশি করে আলু খেতে বলা হয়ে থাকে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে এ প্রবণতা রয়েছেও। চালের সঙ্গে গম তথা আটারও এমনি ধারার সম্পর্ক রয়েছে। যাহোক, আলুর দাম এত বেড়েছে যে, এটা মোটা ও মাঝারি চিকন চালের চেয়ে দামি হয়ে গেছে! এদিকে বোরোর ভরা মৌসুমে সবরকম চালের দাম নতুন করে বাড়ার প্রবণতাও রয়েছে– চট করে যার ভালো ব্যাখ্যা মিলছে না। তবে চালের চেয়ে আলুর দাম বৃদ্ধির প্রবণতা মনে হচ্ছে বেশি। ঈদের পর মিলগুলো একযোগে নতুন ধান ভাঙানো শুরু করলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে চালের দাম হয়তো কিছুটা কমেও আসবে। তাপপ্রবাহসহ প্রতিকূল আবহাওয়ায় বোরোর ফলন মার খায়নি বলে সরকারিভাবে বলা হচ্ছে। সেটা সত্য হলে বাজারে এর প্রতিফলন থাকবে নিশ্চয়ই। দাম বৃদ্ধির প্রবণতা থাকলে তা অন্তত সংশোধিত হয়ে যাওয়ার কথা। মূল্যস্ফীতি যখন দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ পর্যায়ে এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও উঁচুতে, তখন চালের দাম নতুন করে না বাড়াটা জরুরি। এখন চাল আমদানি করাটাও কঠিন। পেঁয়াজের মতোই এটা কম দামে আনা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে এর দাম এখনও চড়া। ভারতের মতো বড় চাল রপ্তানিকারক দেশের রপ্তানিতে অনাগ্রহটাও এজন্য দায়ী। তুলনায় গম আমদানি বরং সহজ। এর উৎস অনেক। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে আসার প্রবণতাও রয়েছে। আমরা অবশ্য ডলারের উচ্চ দামের কারণে আমদানিতে এর সুফল নিতে পারছি না। দেশে আটা-ময়দার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসেনি আজও। এ অবস্থায় যে আলুতে বিদেশনির্ভরতা ছিল না বললেই চলে– এর দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বিপদ। এ অবস্থায় আলু আমদানি বাড়াতে হলে সেটা দ্রুতই করা দরকার। এক্ষেত্রেও ভারত সুবিধাজনক উৎস। সেখান থেকে কিছু আলু আমরা আমদানি করেছিলামও। কিন্তু বাজারে প্রভাব ফেলা যায়নি; যে কারণে এর দাম বাড়তে বাড়তে কেজিপ্রতি ৬৫-৭০ টাকায় উঠে গেছে। এটা মানসম্মত চিকন চালের দামের কাছাকাছি!
আলুতে এমন একটা পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো বিশেষত উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে, সেটা পর্যালোচনা করে দেখাও জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পুষ্টিকর মিষ্টি আলুর উৎপাদন বাড়ানোর ওপরও এক সময় জোর দেওয়া হতো। এখন উল্টো দেখা যাচ্ছে, গোল আলু আমদানির প্রয়োজন বাড়ছে। কিন্তু আমদানি করলেই তো হবে না। উল্লেখযোগ্য কম দামে আনতে না পারলে বাজারে প্রভাব ফেলা যাবে না। শুল্ক ছাড় দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু দেখা যায়, পরিবহন ব্যয়সহ নানা কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম যাচ্ছে বেড়ে। রপ্তানিকারক দেশও অনেক সময় কম দামে দিতে পারে না। তাতে আখেরে আমদানিটাই হয় নিরুৎসাহিত। আমাদের তো কাঁচামরিচও আমদানি করতে হচ্ছে। কোরবানি ঈদের সময় থেকেই এর দাম বাড়ার প্রবণতা ছিল। তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টিবাদল দুটোতেই নাকি এর উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। গেল বছরও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে দাম তখন যেভাবে বেড়ে গিয়েছিল– এবার এখনও তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত কাঁচামরিচের কেজিপ্রতি দাম ৩০০ টাকা ছাড়ায়নি। আমদানি অব্যাহত থাকাটা হয়তো কিছুটা ভূমিকা রেখেছে এক্ষেত্রে। কিছু কৃষিপণ্যের দাম বাড়ার সাধারণ প্রবণতা থাকে বিশেষ বিশেষ সময়ে। সেদিকে দৃষ্টি রেখে আগেভাগে আমদানির উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। বিরূপ আবহাওয়ায় উৎপাদন যাতে কম মার খায়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। বিরূপতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা কম ভূমিকা রাখছেন না। পেঁয়াজ, আলু, কাঁচামরিচের মতো পণ্যেও এর সুফল নিশ্চিত করা চাই। উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখাটাও জরুরি। কৃষিজমির অন্যান্য ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় একরপ্রতি উৎপাদন বাড়িয়ে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর এজেন্ডাও দূরে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ভুট্টার মতো নতুন কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনে আমাদের সাফল্য রয়েছে। তাতে কমছে আমদানিনির্ভরতা। এসব ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং উৎপাদন ব্যয় যথাসম্ভব কমানোর প্রশ্ন রয়েছে।
এ সময়টা আবার বন্যার। বিশেষত হাওর ও নিম্নাঞ্চলে দফায় দফায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। এক অঞ্চলে পরিস্থিতির উন্নতি হলে আরেক অঞ্চলে হচ্ছে অবনতি। এর আগে দেশের সিংহভাগ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ। তাতেও কৃষি উৎপাদন কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ঘূর্ণিঝড় রেমালও দেশের ১৯টি জেলার উপকূলভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে গেছে। এতে অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি রেণু-পোনা উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মাছের বাজারে এর বিলম্বিত প্রভাব পড়েছে মনে হয়। এ সময়ে চাষের মাছের সরবরাহও কম বলে দাম বেড়েছে বাজারে। নদী, বিল ও হাওরের মাছের গায়ে তো হাতই দেওয়া যাচ্ছে না!
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির উৎপাদন, আহরণ আর সরবরাহও বিঘ্নিত অব্যাহত বৃষ্টিবাদলে। এ সময়ে সবজি নষ্ট হওয়ার মাত্রাও বাড়ে। পরিবহন ব্যয়ও বাড়তে দেখা যায়। ডিজেলের দাম কমিয়ে আনা গেলে এর একটা প্রভাব হয়তো পড়তো পণ্যবাজারে। সেটাও যাচ্ছে না। আমের মৌসুমে নাকি চাল পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুরের মতো স্থান থেকে। এ জায়গাটায় সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিয়ে সরবরাহ ব্যয় কমাতে পারে কিনা, দেখা দরকার। সবজি উৎপাদনে দক্ষ হয়ে ওঠা অঞ্চলগুলো থেকে এর সরবরাহও নির্বিঘ্ন রাখা চাই। আর সব ক্ষেত্রেই পণ্যের হাতবদল কমিয়ে আনা গেলে চূড়ান্ত দামে এর সুফল মিলবে। সরকার নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার যে বড় লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে– আমদানি খাতের পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেও তা অর্জনের প্রয়াস নিতে হবে বৈকি। কাজটা কঠিন
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট