ঢাকা ০৮:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

পেঁয়াজের বাজার: চাপে ভোক্তা ও কৃষকের অর্থনীতি

  • আপডেট সময় : ০৬:৪০:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

ড. মিহির কুমার রায়

পেঁয়াজের একটি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে খাদ্য উপকরণে। যেমন- পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে, ক্যালসিয়াম-সালফার-ভিটামিন সংযোজনে, শরীরের তাপমাত্রা কমাতে, লিভারের হজম শক্তি বাড়াতে, ত্বকের সমস্যা নিরসনে, ক্যানসার ও ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৩৪ লাখ টন। দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন এবং প্রতিদিন সারাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন। ঢাকা শহরেই চাহিদা প্রতিদিন দেড় হাজার টন।

সাধারণভাবে তিন ঋতুতে পেঁয়াজের চাষ হলেও বর্ষায় এর চাষ বেশি হয়। যদিও বন্যার একটা অনিশ্চয়তা কিংবা বর্ষার একটি সংকট থেকেই যায়, তবুও যে বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়, সে বছর আবার কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং পরবর্তী বছরে পেঁয়াজ চাষে কৃষক আর উৎসাহিত না হয়ে অন্য ফসলে চলে যায়। ফলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায় পরবর্তী বছরে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে বছরে ২৪ লাখ টন।

উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ (প্রায় ৩০ শতাংশের মতো) বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয় বিধায় মোট ঘাটতি ৮ থেকে ৯ লাখ টন থেকেই যায়; যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। প্রতি বছরই স্বাভাবিক নিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের সিংহভাগ উৎপাদন হয় রবি মৌসুমে। এ মৌসুমে মুড়িকাটা ও হালি দুই জাতের পেঁয়াজ চাষ করেন কৃষক। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন সময়ে প্রথম দিকে কন্দ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়। এরপর চাষ করা হয় চারা বা হালি পেঁয়াজ। সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাঠ থেকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ কাটা শুরু হয়। মধ্য মার্চ থেকে পুরোদমে শুরু হয় হালি পেঁয়াজ তোলা।

হঠাৎ করে দেশের বাজারে এ বছরের মাঝামাঝি থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল; যা কেজি প্রতি দাম ছাড়ায় ১০০ টাকা। এরপর প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। এখন খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকায়; যা কয়েকদিন আগেও ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। পাইকারি বাজারেও একই চিত্র। মানভেদে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে; যা আগে বিক্রি হয়েছে ৭২ থেকে ৮৫ টাকায়।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের আড়তদাররা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।

কুমিল্লা আড়তের আড়তদার আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, ‘পাবনা ও ফরিদপুরের আড়তে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সারা দেশের পাইকারি বাজারে। আগের চেয়ে মোকামে দাম প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আসছে, তা যথেষ্ট নয়।’ চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারেও তিন দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত।

গত ৩ নভেম্বর দেখা যায়, মানভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৯০ থেকে ১০৫ টাকায়; যা গত শেষ অক্টোবরে বিক্রি হয়েছিল ৭২ থেকে ৮৫ টাকায়।খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া গণমাধ্যমে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, দেশে রবি মৌসুমের রোপণ শুরু হয়েছে দেরিতে। ফলে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে সময় লাগবে। পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো রোপণ শেষ হয়নি। সময়মতো আমদানি অনুমোদন না পেলে বাজার আরও অস্থিতিশীল হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

অন্যদিকে কৃষি অধিদপ্তর বলছে, দেশে এখন পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত আছে। এ মুহূর্তে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) বলেন, ‘এই মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যবসায়ী কারসাজি। কৃষকের হাতে এখনো পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ আছে। তাই আগামী দুই মাস কোনো সংকট হবে না।’ তিনি জানান, ‘গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে, আর ডিসেম্বরের মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজও উঠতে শুরু করবে। ফলে দাম আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ ঘাটতির চেয়ে পরিকল্পিতভাবে সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই এই দাম বাড়ানো হয়েছে। কারণ, সরকারি হিসাবে দেশে পর্যাপ্ত পিঁয়াজ মজুত আছে; এমনকি চাহিদার চেয়ে উৎপাদনও বেশি। তারা মনে করেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাবই এখন মূল সমস্যা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে বছরে ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টন। তবু বেশি মুনাফার লোভে পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে জমা পড়েছে প্রায় ৩ হাজার আমদানি অনুমতি (আইপি) আবেদন। স্থানীয় কৃষককে সুরক্ষা দিতে সেসব আইপি আবেদন স্থগিত রেখেছে মন্ত্রণালয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, আমরা সবকিছু নজরদারির ওপর রাখছি। নিম্নচাপের প্রভাবে কয়েকটি উপজেলায় বৃষ্টি হয়েছিল। সেটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে হয়তো অনেক ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকটের চেষ্টা করছেন। বেশি সংকট হলে মজুত রাখা পেঁয়াজ বাজারে ছাড়া হবে। কৃষকের কাছে যে পেঁয়াজ মজুত আছে সেগুলো বাজারে ছাড়লেই দাম আবারও কমে আসবে। মৌসুমের আগে যদি ভারতীয় পেঁয়াজ যদি বাজারে ঢুকে যায়, তাহলে কৃষক আবারও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।

পাবনার চাটমোহরের কৃষক রহমত আলী বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে ফসল তুলছি, খরচ গেছে কেজিতে ৪০ টাকা। এখন যদি ভারতীয় পেঁয়াজ আসে, তাহলে আমাদের ফসল বিক্রি হবে না। সরকার আমদানি বন্ধ না করলে আমরা টিকতে পারব না।’দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মাঝে ৫০ টন উন্নতমানের পেঁয়াজ বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে ডিএপি ও এমওপি সার। এবার ৮ হাজার ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ স্থাপন করা হয়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে পেঁয়াজ সংরক্ষণে সাহায্য করছে। এবার উৎপাদিত পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দুই দিকেই ভারসাম্য রাখা- কৃষক যেন লাভবান হন আর ভোক্তাও ন্যায্যমূল্যে পণ্য পান। তাই এখন আমদানি স্থগিতই যুক্তিযুক্ত।’

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে আড়তদার, কমিশন এজেন্ট ও দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। তারা পেঁয়াজ কিনে মজুত করছে। বাজারে ছাড়ে না। দেশে ভালো উৎপাদন হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির পাঁয়তারা করা হয়। সরকারের নজরদারি না বাড়ালে বাজারে এই সিন্ডিকেট আবারও সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলবে। এরপরও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, বিশেষত কৃষিজাত পণ্যের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরমার্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

দেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উগযোগী। বছরে ২ থেকে ৩ বার চাষ করার মতো উফশী জাতের বীজ রয়েছে। পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষ, পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় ওয়্যার হাউস নির্মাণের বিকল্প নেই। পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল; যা দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে আর ৩০ শতাংশ নিয়ে জাতির চিন্তা।

এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের ৩টি গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পেঁয়াজ এমন একটি মসলা জাতীয় ফসল- যা পৃথিবীব্যাপী উৎপন্ন হয় এবং সব চেয়ে বেশি উৎপাদন হয় ভারত ও চীনে। আমদানি বাণিজ্যে আমদানিকারকদের সকল বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে, টিসিবির কার্যক্রম ভোক্তাবান্ধব হতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বাজার স্থিতিশীল হতে হবে, সঠিক নিয়মে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে মূল্য বিপর্যয়ের কোন সম্ভাবনা থাকবে না; যা কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় হতে পারে। সর্বোপরি পেঁয়াজ উৎপাদনে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

পেঁয়াজের বাজার: চাপে ভোক্তা ও কৃষকের অর্থনীতি

আপডেট সময় : ০৬:৪০:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

ড. মিহির কুমার রায়

পেঁয়াজের একটি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে খাদ্য উপকরণে। যেমন- পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে, ক্যালসিয়াম-সালফার-ভিটামিন সংযোজনে, শরীরের তাপমাত্রা কমাতে, লিভারের হজম শক্তি বাড়াতে, ত্বকের সমস্যা নিরসনে, ক্যানসার ও ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৩৪ লাখ টন। দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন এবং প্রতিদিন সারাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন। ঢাকা শহরেই চাহিদা প্রতিদিন দেড় হাজার টন।

সাধারণভাবে তিন ঋতুতে পেঁয়াজের চাষ হলেও বর্ষায় এর চাষ বেশি হয়। যদিও বন্যার একটা অনিশ্চয়তা কিংবা বর্ষার একটি সংকট থেকেই যায়, তবুও যে বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়, সে বছর আবার কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং পরবর্তী বছরে পেঁয়াজ চাষে কৃষক আর উৎসাহিত না হয়ে অন্য ফসলে চলে যায়। ফলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায় পরবর্তী বছরে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে বছরে ২৪ লাখ টন।

উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ (প্রায় ৩০ শতাংশের মতো) বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয় বিধায় মোট ঘাটতি ৮ থেকে ৯ লাখ টন থেকেই যায়; যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। প্রতি বছরই স্বাভাবিক নিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের সিংহভাগ উৎপাদন হয় রবি মৌসুমে। এ মৌসুমে মুড়িকাটা ও হালি দুই জাতের পেঁয়াজ চাষ করেন কৃষক। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন সময়ে প্রথম দিকে কন্দ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়। এরপর চাষ করা হয় চারা বা হালি পেঁয়াজ। সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাঠ থেকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ কাটা শুরু হয়। মধ্য মার্চ থেকে পুরোদমে শুরু হয় হালি পেঁয়াজ তোলা।

হঠাৎ করে দেশের বাজারে এ বছরের মাঝামাঝি থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল; যা কেজি প্রতি দাম ছাড়ায় ১০০ টাকা। এরপর প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। এখন খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকায়; যা কয়েকদিন আগেও ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। পাইকারি বাজারেও একই চিত্র। মানভেদে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে; যা আগে বিক্রি হয়েছে ৭২ থেকে ৮৫ টাকায়।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের আড়তদাররা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।

কুমিল্লা আড়তের আড়তদার আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, ‘পাবনা ও ফরিদপুরের আড়তে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সারা দেশের পাইকারি বাজারে। আগের চেয়ে মোকামে দাম প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আসছে, তা যথেষ্ট নয়।’ চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারেও তিন দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত।

গত ৩ নভেম্বর দেখা যায়, মানভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৯০ থেকে ১০৫ টাকায়; যা গত শেষ অক্টোবরে বিক্রি হয়েছিল ৭২ থেকে ৮৫ টাকায়।খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া গণমাধ্যমে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, দেশে রবি মৌসুমের রোপণ শুরু হয়েছে দেরিতে। ফলে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে সময় লাগবে। পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো রোপণ শেষ হয়নি। সময়মতো আমদানি অনুমোদন না পেলে বাজার আরও অস্থিতিশীল হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

অন্যদিকে কৃষি অধিদপ্তর বলছে, দেশে এখন পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত আছে। এ মুহূর্তে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) বলেন, ‘এই মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যবসায়ী কারসাজি। কৃষকের হাতে এখনো পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ আছে। তাই আগামী দুই মাস কোনো সংকট হবে না।’ তিনি জানান, ‘গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে, আর ডিসেম্বরের মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজও উঠতে শুরু করবে। ফলে দাম আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ ঘাটতির চেয়ে পরিকল্পিতভাবে সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই এই দাম বাড়ানো হয়েছে। কারণ, সরকারি হিসাবে দেশে পর্যাপ্ত পিঁয়াজ মজুত আছে; এমনকি চাহিদার চেয়ে উৎপাদনও বেশি। তারা মনে করেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাবই এখন মূল সমস্যা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে বছরে ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টন। তবু বেশি মুনাফার লোভে পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে জমা পড়েছে প্রায় ৩ হাজার আমদানি অনুমতি (আইপি) আবেদন। স্থানীয় কৃষককে সুরক্ষা দিতে সেসব আইপি আবেদন স্থগিত রেখেছে মন্ত্রণালয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, আমরা সবকিছু নজরদারির ওপর রাখছি। নিম্নচাপের প্রভাবে কয়েকটি উপজেলায় বৃষ্টি হয়েছিল। সেটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে হয়তো অনেক ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকটের চেষ্টা করছেন। বেশি সংকট হলে মজুত রাখা পেঁয়াজ বাজারে ছাড়া হবে। কৃষকের কাছে যে পেঁয়াজ মজুত আছে সেগুলো বাজারে ছাড়লেই দাম আবারও কমে আসবে। মৌসুমের আগে যদি ভারতীয় পেঁয়াজ যদি বাজারে ঢুকে যায়, তাহলে কৃষক আবারও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।

পাবনার চাটমোহরের কৃষক রহমত আলী বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে ফসল তুলছি, খরচ গেছে কেজিতে ৪০ টাকা। এখন যদি ভারতীয় পেঁয়াজ আসে, তাহলে আমাদের ফসল বিক্রি হবে না। সরকার আমদানি বন্ধ না করলে আমরা টিকতে পারব না।’দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মাঝে ৫০ টন উন্নতমানের পেঁয়াজ বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে ডিএপি ও এমওপি সার। এবার ৮ হাজার ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ স্থাপন করা হয়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে পেঁয়াজ সংরক্ষণে সাহায্য করছে। এবার উৎপাদিত পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দুই দিকেই ভারসাম্য রাখা- কৃষক যেন লাভবান হন আর ভোক্তাও ন্যায্যমূল্যে পণ্য পান। তাই এখন আমদানি স্থগিতই যুক্তিযুক্ত।’

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে আড়তদার, কমিশন এজেন্ট ও দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। তারা পেঁয়াজ কিনে মজুত করছে। বাজারে ছাড়ে না। দেশে ভালো উৎপাদন হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির পাঁয়তারা করা হয়। সরকারের নজরদারি না বাড়ালে বাজারে এই সিন্ডিকেট আবারও সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলবে। এরপরও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, বিশেষত কৃষিজাত পণ্যের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরমার্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

দেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উগযোগী। বছরে ২ থেকে ৩ বার চাষ করার মতো উফশী জাতের বীজ রয়েছে। পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষ, পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় ওয়্যার হাউস নির্মাণের বিকল্প নেই। পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল; যা দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে আর ৩০ শতাংশ নিয়ে জাতির চিন্তা।

এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের ৩টি গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পেঁয়াজ এমন একটি মসলা জাতীয় ফসল- যা পৃথিবীব্যাপী উৎপন্ন হয় এবং সব চেয়ে বেশি উৎপাদন হয় ভারত ও চীনে। আমদানি বাণিজ্যে আমদানিকারকদের সকল বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে, টিসিবির কার্যক্রম ভোক্তাবান্ধব হতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বাজার স্থিতিশীল হতে হবে, সঠিক নিয়মে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে মূল্য বিপর্যয়ের কোন সম্ভাবনা থাকবে না; যা কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় হতে পারে। সর্বোপরি পেঁয়াজ উৎপাদনে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ