ঢাকা ০৮:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পূজা উদযাপন পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

পূজায় হামলার বিচার হচ্ছে কি না, সেটাই বিবেচ্য

  • আপডেট সময় : ০৯:২৯:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ২৫ বার পড়া হয়েছে

শুক্রবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ’ ও ‘মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি’ আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা -ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা ‘নির্বিঘ্ন’ করতে প্রশাসনের নানা পদক্ষেপে ‘আশ্বস্ত’ হওয়ার কথা জানিয়ে পূজা উদযাপন পরিষদ বলছে, তাদের ‘সে অর্থে উৎকণ্ঠা’ নেই। এ উৎসব শুরুর আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনার বিষয়ে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দের ভাষ্য, দুর্বৃত্তরা হামলা ‘করতেই পারে’। ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা ধড়া পড়ছে কি না, বিচার হচ্ছে কি না- সেটিই তাদের ‘বিবেচ্য বিষয়’।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ’ ও ‘মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি’ আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়। এ সময় নেতৃবৃন্দ দুর্গাপূজা ‘নির্বিঘ্নে’ উদযাপিত হওয়ার আশা প্রকাশ করে পূজার দিনগুলোতে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং ঢাকায় অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু রাখার দাবি জানান।

দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন জেলার সাত শতাধিক মণ্ডপকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা গেল গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট। অন্যদিকে দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে দেশের ২৯ জেলাকে ‘ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নাগরিক সমাজের নবগঠিত প্লাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’।
শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনেও পূজা শুরুর আগেই ১৩টি জেলায় প্রতিমা ভাংচুর ও মন্দিরে হামলার তথ্য দেওয়া হয়েছে।
জেলাগুলো হচ্ছে- কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নেত্রকোণা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রতিমা প্রস্তুত করার সময় মন্দিরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়িয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা দেড় দশক ধরে চলছে বলে জানান বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর। তিনি বলেন, আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কিছু ছড়িয়ে দিয়ে, ধর্ম বিদ্বেষের ভুয়া মিথ্যা একটা বার্তা দিয়ে যে হামলা করা হয়েছে এটা ২০০৯-১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ গঙ্গাচড়ার ঘটনাসহ এমন ঘটনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ‘উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে’ তুলে ধরার কথা জানিয়ে বাসুদেব বলেন, “তারা আমাদের বলেছে, কঠোর অবস্থানে থাকবে, আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় প্রতিমা এবং মন্দিরে হামলার ঘটনার পর অনেক দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যাচ্ছে, প্রশাসনের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
তো আমরা এটাই চেয়েছিলাম যে, হামলা দুর্বৃত্তরা করতেই পারে। কিন্তু এটার বিচার হচ্ছে কি না, দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ছে কি না- এটাই আমাদের আমাদের দেখার বিষয়। আমরা চাই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা নানাভাবে দেখেছি গত ৫৩ বছর। আমরা চাই না এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকুক।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব বিষয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও ধর্ম উপদেষ্টা, আইজিপি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান বাসুদেব ধর। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই (বিচারহীনতার) সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটুক। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এবং তাদের আশ্বাসের বিভিন্ন প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি।

প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন জেলায় এবং ঢাকায় যে সমস্ত স্থানে বিসর্জন দেওয়া হয়, বিশেষ করে প্রধান বিসর্জন স্থল হচ্ছে আমাদের বুড়িগঙ্গা। সেখানে অত্যন্ত সুন্দর ব্যবস্থা গতবারও ছিল, এবারও সরকারের তরফ থেকে এটা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা এটাতে সহযোগিতা করছে। যাতে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয়, আমরা তো সেটাই চাইব। সরকারও তাই চেয়েছে এবং একেবারে সর্বাঙ্গীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাজেই উৎকণ্ঠা আপনারা যেভাবে বলছেন, সে অর্থে উৎকণ্ঠা নেই। আমরা পূজোর আয়োজন করছি, আমরা জানি সবাই আমাদের পাশে রয়েছে।

গেল এক বছর ধরে ঢালাও মামলার মাধ্যমে সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের অনেককে ‘হয়রানি করা হচ্ছে’ দাবি করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব বলেন, এটা আমরা সরকারকে জানিয়েছি এবং সেনাবাহিনীকেও আমরা জানিয়েছি। বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু ঘটনা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নিরসন হয়েছে। আমরা চাই, যেগুলো হয়নি সেগুলো সরকার এবং প্রশাসনের যেই অংশটি এটা দেখে তারা যেন পুজোর আগে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করেন।
তাদের নেতৃবৃন্দ এবং পূজা সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর কমিটি ছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই এই মামলার ‘শিকার হয়েছেন’। তারা যেন ‘নিশ্চিন্তে’ এই দুর্গাপূজায় অংশ নিতে পারেন, সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী’ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন আবার ‘অতিরিক্ত কিছু’ করে না ফেলেন। তারা অবশ্যই আমাদের দেখভাল করবেন, কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করতে গিয়ে আবার সাধারণ জনগণের মধ্যে, যারা বিভিন্ন মন্ডপে যাতায়াত করেন পরিবার নিয়ে, তাদের মধ্যে যেন একটা ভয়ভীতির সৃষ্টি না হয়। সেই ব্যাপারে একটু লক্ষ্য রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা যে নতুন করে যে সংস্কৃতি চালু করছি, যেখন যেখানে ঘটনা ঘটবে সেখানেই যাতে সকলকে আইনের আওতায় আনা হয় এবং বিচারে সোপর্দ করা হয়।

গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশে যে ‘বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি’ চালু হয়েছে, সেখান থেকে জাতিকে মুক্ত করতে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠিন এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান সুব্রত চৌধুরী। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের নির্ধারিত এলাকার সকল পূজা মন্ডপে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে ও বৈঠক হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সুব্রতর প্রত্যাশা, এবার পূজাতে সারা দেশের ১৮ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা এই আনন্দের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করব। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার এটার পরিবর্তে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ শীর্ষক ‘অমোঘ বাণী’ চালু করার কথা জানান তিনি, যার মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন সুব্রত চৌধুরী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সনাতনীদের আর পঞ্জিকা দেখতে হয় না, কবে জন্মাষ্টমী উৎসব আর কবে দুর্গাপূজা। চারিদিকে যখন ভাংচুর শুরু হয়ে যায়, আমাদের প্রতিমাগুলো তখনই আমরা বলতে পারি সামনে একটা কোন উৎসব আসতেছে।
এইবারও দুর্গাপূজার সময় যে ১৩টি ঘটনার কথা বলছেন বা দুইদিনের মধ্যে আরো ঘটতেছে শেষ পর্যন্ত; তার মানে একদিকে দুর্গাপূজার প্রতিমাগুলো ভাংচুরের ঘটনা হচ্ছে, আরেকদিকে আমরা সবাইকে বলছি, আনন্দ উৎসবের সাথে আপনারা অংশগ্রহণ করেন। আমরা আশা করব যে, বাংলাদেশে এই পূজা মন্ডপে হামলার পরে কেউ বলবেন না এটা বাতাসে ভেঙে গিয়েছে। আর যখন যাকে ধরা হয় কুমিল্লার ঘটনা থেকে সব জায়গায় বলা হতো, উন্মাদ এবং সে নেশাখোর। এসবের মধ্য দিয়ে ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। আমরা আশা করব আপনাদের প্রশাসন থেকে যেন এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া না হয়। অপরাধী যে হোক তাকে আইনে আওতায় নিয়ে আসেন এবং একটা বিচারের ব্যবস্থা করেন।
এ সময় বাসুদেব ধর জানান, বেশ কয়েকটি জেলায় দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য সরকার ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ ব্যবস্থা নিয়েছে। এর আগে লিখিত বক্তব্যে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব শনিবার বোধনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু এবং বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী ও শোভাযাত্রা পালনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উৎসব শেষের কথা জানান।

এবার ঢাকায় গতবারের তুলনায় ৭টি বেড়ে মোট ২৫৯টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। আর সারাদেশে মোট মণ্ডপের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৫৫টি, যা গতবারের তুলনায় প্রায় হাজারখানেক বেশি। এ সময় জয়ন্ত কুমার দেব পূজার আগে বেশকিছু মন্দিরে হামলা ও পূজা উপলক্ষ্যে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তার প্রত্যাশা, আমরা এমন একটি সমাজের অপেক্ষায় আছি, যে সমাজে ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমাসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সার্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, কোন ধরণের ভয়ভীতি এবং পুলিশি পাহারা ব্যাতিরেকে অনুষ্ঠিত হবে।

লিখিত বক্তব্যে তিনি সারাদেশে পূজা উদযাপন করা মণ্ডপ ও কমিটিগুলোর প্রতি ২২ দফা নির্দেশনার কথা তুলে ধরেন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ‘স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায়’ আট দফা দাবির কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। রোববার মহালয়ার মাধ্যমে এবারের দুর্গোৎসবের প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার মহালয়ার সপ্তম দিন অর্থাৎ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে পাঁচদিনের দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর সপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর অষ্টমী, অক্টোবরের ১ তারিখ নবমী এবং ২ অক্টোবর দশমীর সন্ধ্যায় বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি হবে। এবার দেবী দুর্গার আগমন হবে গজে অর্থাৎ হাতির পিঠে চড়ে। গজে আগমন বা গমন হলে বসুন্ধরা শস্য শ্যামলা হয়। দশমীতে দেবীর মর্ত্যলোক ছাড়বেন দোলায় চড়ে। আর দোলায় দেবীর গমনকে মহামারি বা মড়কের ইঙ্গিত ধরা হয়।
সানা/আপ্র/২৬/০৯/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

পূজা উদযাপন পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

পূজায় হামলার বিচার হচ্ছে কি না, সেটাই বিবেচ্য

আপডেট সময় : ০৯:২৯:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা ‘নির্বিঘ্ন’ করতে প্রশাসনের নানা পদক্ষেপে ‘আশ্বস্ত’ হওয়ার কথা জানিয়ে পূজা উদযাপন পরিষদ বলছে, তাদের ‘সে অর্থে উৎকণ্ঠা’ নেই। এ উৎসব শুরুর আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনার বিষয়ে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দের ভাষ্য, দুর্বৃত্তরা হামলা ‘করতেই পারে’। ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা ধড়া পড়ছে কি না, বিচার হচ্ছে কি না- সেটিই তাদের ‘বিবেচ্য বিষয়’।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ’ ও ‘মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি’ আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়। এ সময় নেতৃবৃন্দ দুর্গাপূজা ‘নির্বিঘ্নে’ উদযাপিত হওয়ার আশা প্রকাশ করে পূজার দিনগুলোতে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং ঢাকায় অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু রাখার দাবি জানান।

দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন জেলার সাত শতাধিক মণ্ডপকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা গেল গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট। অন্যদিকে দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে দেশের ২৯ জেলাকে ‘ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নাগরিক সমাজের নবগঠিত প্লাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’।
শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনেও পূজা শুরুর আগেই ১৩টি জেলায় প্রতিমা ভাংচুর ও মন্দিরে হামলার তথ্য দেওয়া হয়েছে।
জেলাগুলো হচ্ছে- কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নেত্রকোণা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রতিমা প্রস্তুত করার সময় মন্দিরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়িয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা দেড় দশক ধরে চলছে বলে জানান বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর। তিনি বলেন, আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কিছু ছড়িয়ে দিয়ে, ধর্ম বিদ্বেষের ভুয়া মিথ্যা একটা বার্তা দিয়ে যে হামলা করা হয়েছে এটা ২০০৯-১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ গঙ্গাচড়ার ঘটনাসহ এমন ঘটনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ‘উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে’ তুলে ধরার কথা জানিয়ে বাসুদেব বলেন, “তারা আমাদের বলেছে, কঠোর অবস্থানে থাকবে, আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় প্রতিমা এবং মন্দিরে হামলার ঘটনার পর অনেক দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যাচ্ছে, প্রশাসনের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
তো আমরা এটাই চেয়েছিলাম যে, হামলা দুর্বৃত্তরা করতেই পারে। কিন্তু এটার বিচার হচ্ছে কি না, দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ছে কি না- এটাই আমাদের আমাদের দেখার বিষয়। আমরা চাই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা নানাভাবে দেখেছি গত ৫৩ বছর। আমরা চাই না এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকুক।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব বিষয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও ধর্ম উপদেষ্টা, আইজিপি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান বাসুদেব ধর। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই (বিচারহীনতার) সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটুক। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এবং তাদের আশ্বাসের বিভিন্ন প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি।

প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন জেলায় এবং ঢাকায় যে সমস্ত স্থানে বিসর্জন দেওয়া হয়, বিশেষ করে প্রধান বিসর্জন স্থল হচ্ছে আমাদের বুড়িগঙ্গা। সেখানে অত্যন্ত সুন্দর ব্যবস্থা গতবারও ছিল, এবারও সরকারের তরফ থেকে এটা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা এটাতে সহযোগিতা করছে। যাতে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয়, আমরা তো সেটাই চাইব। সরকারও তাই চেয়েছে এবং একেবারে সর্বাঙ্গীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাজেই উৎকণ্ঠা আপনারা যেভাবে বলছেন, সে অর্থে উৎকণ্ঠা নেই। আমরা পূজোর আয়োজন করছি, আমরা জানি সবাই আমাদের পাশে রয়েছে।

গেল এক বছর ধরে ঢালাও মামলার মাধ্যমে সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের অনেককে ‘হয়রানি করা হচ্ছে’ দাবি করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব বলেন, এটা আমরা সরকারকে জানিয়েছি এবং সেনাবাহিনীকেও আমরা জানিয়েছি। বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু ঘটনা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নিরসন হয়েছে। আমরা চাই, যেগুলো হয়নি সেগুলো সরকার এবং প্রশাসনের যেই অংশটি এটা দেখে তারা যেন পুজোর আগে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করেন।
তাদের নেতৃবৃন্দ এবং পূজা সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর কমিটি ছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই এই মামলার ‘শিকার হয়েছেন’। তারা যেন ‘নিশ্চিন্তে’ এই দুর্গাপূজায় অংশ নিতে পারেন, সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী’ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন আবার ‘অতিরিক্ত কিছু’ করে না ফেলেন। তারা অবশ্যই আমাদের দেখভাল করবেন, কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করতে গিয়ে আবার সাধারণ জনগণের মধ্যে, যারা বিভিন্ন মন্ডপে যাতায়াত করেন পরিবার নিয়ে, তাদের মধ্যে যেন একটা ভয়ভীতির সৃষ্টি না হয়। সেই ব্যাপারে একটু লক্ষ্য রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা যে নতুন করে যে সংস্কৃতি চালু করছি, যেখন যেখানে ঘটনা ঘটবে সেখানেই যাতে সকলকে আইনের আওতায় আনা হয় এবং বিচারে সোপর্দ করা হয়।

গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশে যে ‘বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি’ চালু হয়েছে, সেখান থেকে জাতিকে মুক্ত করতে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠিন এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান সুব্রত চৌধুরী। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের নির্ধারিত এলাকার সকল পূজা মন্ডপে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে ও বৈঠক হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সুব্রতর প্রত্যাশা, এবার পূজাতে সারা দেশের ১৮ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা এই আনন্দের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করব। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার এটার পরিবর্তে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ শীর্ষক ‘অমোঘ বাণী’ চালু করার কথা জানান তিনি, যার মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন সুব্রত চৌধুরী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সনাতনীদের আর পঞ্জিকা দেখতে হয় না, কবে জন্মাষ্টমী উৎসব আর কবে দুর্গাপূজা। চারিদিকে যখন ভাংচুর শুরু হয়ে যায়, আমাদের প্রতিমাগুলো তখনই আমরা বলতে পারি সামনে একটা কোন উৎসব আসতেছে।
এইবারও দুর্গাপূজার সময় যে ১৩টি ঘটনার কথা বলছেন বা দুইদিনের মধ্যে আরো ঘটতেছে শেষ পর্যন্ত; তার মানে একদিকে দুর্গাপূজার প্রতিমাগুলো ভাংচুরের ঘটনা হচ্ছে, আরেকদিকে আমরা সবাইকে বলছি, আনন্দ উৎসবের সাথে আপনারা অংশগ্রহণ করেন। আমরা আশা করব যে, বাংলাদেশে এই পূজা মন্ডপে হামলার পরে কেউ বলবেন না এটা বাতাসে ভেঙে গিয়েছে। আর যখন যাকে ধরা হয় কুমিল্লার ঘটনা থেকে সব জায়গায় বলা হতো, উন্মাদ এবং সে নেশাখোর। এসবের মধ্য দিয়ে ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। আমরা আশা করব আপনাদের প্রশাসন থেকে যেন এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া না হয়। অপরাধী যে হোক তাকে আইনে আওতায় নিয়ে আসেন এবং একটা বিচারের ব্যবস্থা করেন।
এ সময় বাসুদেব ধর জানান, বেশ কয়েকটি জেলায় দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য সরকার ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ ব্যবস্থা নিয়েছে। এর আগে লিখিত বক্তব্যে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব শনিবার বোধনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু এবং বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী ও শোভাযাত্রা পালনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উৎসব শেষের কথা জানান।

এবার ঢাকায় গতবারের তুলনায় ৭টি বেড়ে মোট ২৫৯টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। আর সারাদেশে মোট মণ্ডপের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৫৫টি, যা গতবারের তুলনায় প্রায় হাজারখানেক বেশি। এ সময় জয়ন্ত কুমার দেব পূজার আগে বেশকিছু মন্দিরে হামলা ও পূজা উপলক্ষ্যে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তার প্রত্যাশা, আমরা এমন একটি সমাজের অপেক্ষায় আছি, যে সমাজে ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমাসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সার্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, কোন ধরণের ভয়ভীতি এবং পুলিশি পাহারা ব্যাতিরেকে অনুষ্ঠিত হবে।

লিখিত বক্তব্যে তিনি সারাদেশে পূজা উদযাপন করা মণ্ডপ ও কমিটিগুলোর প্রতি ২২ দফা নির্দেশনার কথা তুলে ধরেন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ‘স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায়’ আট দফা দাবির কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। রোববার মহালয়ার মাধ্যমে এবারের দুর্গোৎসবের প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার মহালয়ার সপ্তম দিন অর্থাৎ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে পাঁচদিনের দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর সপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর অষ্টমী, অক্টোবরের ১ তারিখ নবমী এবং ২ অক্টোবর দশমীর সন্ধ্যায় বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি হবে। এবার দেবী দুর্গার আগমন হবে গজে অর্থাৎ হাতির পিঠে চড়ে। গজে আগমন বা গমন হলে বসুন্ধরা শস্য শ্যামলা হয়। দশমীতে দেবীর মর্ত্যলোক ছাড়বেন দোলায় চড়ে। আর দোলায় দেবীর গমনকে মহামারি বা মড়কের ইঙ্গিত ধরা হয়।
সানা/আপ্র/২৬/০৯/২০২৫