প্রত্যাশা ডেস্ক: সস্প্রতি দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে লোকজনকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, তিনি নিজে যখন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তখনও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আর ভারত এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘উসকানি’ দিচ্ছে বলেও মনে করেন না তিনি।
বাংলাদেশ-ভারত জলসীমার সুরক্ষা বাড়াতে সুন্দরবনের গহীনে শনিবার (১৭ মে) নতুন একটি ভসমান সীমান্ত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র-বিওপি উদ্বোধন করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
সাতক্ষীরার শ্যমনগর উপজেলাধীন রায়মঙ্গল নদী ও বয়েসিং খালের সংযোগস্থলে ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’ এমন এক সময়ে উদ্বোধন করল বিজিবি, যখন দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রায় প্রতিদিনিই লোকজনকে সীমান্ডের এপারে ঠেলে দিচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ।
গত রোববার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে বিএসএফ ৭৮ জন ‘বাংলাভাষীকে’ ফেলে যায়, পরে তাদেরকে উদ্ধার করে শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করে কোস্টগার্ড। সেই মান্দারবাড়িয়া চরের প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা বিজিবির নতুন এই বিওপি উদ্বোধন করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, তার কাছে ভারতের এই ‘পুশ ইনকে উস্কানিমূলক’ মনে হয়নি।
‘এটা ওরকম উসকানিমূলক মনে হচ্ছে না। যেহেতু এর আগেও উনারা একসময় এটা করেছিল অনেক আগে; যে সময় আমি ডিজি বিজিবি ছিলাম, সেই সময়ে।’
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) মহাপরিচালক ছিলেন। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপালনকালে আবারও ভারত থেকে বাংলা ভাষাভাষি লোকজনকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা তাদের জানিয়েছি- আমাদের বাংলাদেশি যদি কেউ ইন্ডিয়ায় থেকে থাকে, আপনারা প্রপার চ্যানেলে পাঠান। প্রত্যেকটার একটা প্রপার চ্যানেল আছে। যেমন আমারও ইন্ডিয়ান যারা বাংলাদেশে আছে তাদেরও প্রপার চ্যানেলে পাঠাই। আমরা কিন্তু কাউরে পুশ ইন করি না। এজন্য তাদেরও বলা হইছে, তারা প্রপার চ্যানেলে যদি বাংলাদেশিরা থাকে তাদের পাঠাক।’
‘পুশ ইন’ ঠেকাতে কূটনৈতিক সমাধানের অংশ হিসেবে ভারতকে চিঠি লেখার কথা জানিয়েছেন উপদেষ্টা। একইসঙ্গে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের দূত, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে বলে জানান তিনি। ‘পুশ ইনের’ কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে শুনছেন যে গুজরাটে একটা কলোনির মতো ছিল বাঙালি কলোনির মতো, বাঙালি বস্তি। ওইটা ওরা ভেঙে দিছে। ভেঙে দেওয়ার পরেই এটা শুরু হইছে।’
এরপর থেকে বাংলাদেশের কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ অন্তত ৩৭০ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার তথ্য দিয়েছে বিজিবি।
ইউএনএসিআরের কার্ডধারীদেরও ‘পুশ ইন’ করার বিষয়ে প্রতিবাদ পাঠানোর কথা জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এর ভেতর কিছু রোহিঙ্গাও চলে আসছে। এসব রোহিঙ্গা আবার আমাদের দেশেও ছিল, ওরাও গেছে। আবার যারা ইন্ডিয়ার রোহিঙ্গা, তাদেরও পাঠায়ে দিচ্ছে। এজন্য আমরা এটার প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছে।’
বাংলাদেশে অবৈধ ভারতীয় থাকলে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশেও অবৈধ ভারতীয় একেবারেই নাই আমি বলব না, বাট আমি আপনাদের অনুরোধ করব যদি থাকে আমাদের জানান আমরাও যেন প্রপারপথে পাঠায় দিতে পারি। আমরা ওদেরমতো অবৈধপথে পাঠাব না, প্রপারভাবে পাঠাব।’
বাংলাদেশের ‘পুশ ব্যাকের’ চিন্তার রয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এরা যদি আমার দেশের নাগরিক হয়, পুশব্যাক করার কোনো অধিকার নাই। অবৈধভাবে ইন্ডিয়ান যারা আছে, তাদের আমরা এভাবে পুশব্যাক করব না, আমরা যে প্রপার চ্যানেল আছে, ওইভাবে পাঠাব। অবৈধভাবে পাঠানোটা কিন্তু আইনত সিদ্ধ নয়।’
এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’ একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ অপারেশনাল প্লাটফর্ম, যা জলপথে সীমান্ত এলাকায় টহল ও নজরদারি জোরদার করবে। এই উদ্যোগ সীমান্তে নতুন নিরাপত্তা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এবং কার্যকর বর্ডার ম্যানেজমেন্টে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন তিনি।
বাংলাদেশ-ভারতের ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৮০ কিলোমিটার জলসীমা, যার মধ্যে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার এলাকা সুন্দরবনের অন্তর্গত। এর আগে সুন্দরবনের সীমান্ত সুরক্ষায় কাঁচিকাটা ও আঠারোবেকিতে দুটি ভাসমান বিওপি স্থাপন করা হয়েছে। কৈখালী স্থলের বিওপি ও কাঁচিকাটা ভাসমান বিওপির মধ্যকার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারেরও বেশি হওয়ায় মধ্যেবর্তী স্থান বয়েসিংয়ে তৃতীয় ভাসমান বিওপি স্থাপন করল বাহিনীটি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, সীমান্তে কার্যকর জলভিত্তিক নজরদারি নিশ্চিত করতে বিজিবির অধীনে একটি বিশেষ ‘রিভারাইন বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন’ গঠনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ভবিষ্যতে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে বিজিবির ‘রিভারাইন বর্ডার গার্ড কোম্পানি’ ১টি স্থল বিওপি, ৩টি ভাসমান বিওপি, ১টি জাহাজ ও কিছু সংখ্যক জলযানের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
‘পুশ ইন’ প্রতিরোধের ‘চেষ্টার’ কথা বললেন বিজিবি ডিজি: নতুন বিওপি উদ্বোধন শেষে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘মূলত পুশ ইন যে এলাকাগুলো দিয়ে হচ্ছে এটা সিলেটের বিয়ানীবাজার, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ ওই এলাকায়। আর এদিকে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী যেদিকে চর এলাকা, প্রত্যন্ত এলাকা সেদিক দিয়ে মূলত হচ্ছে, আর পার্বত্য চট্টগ্রামের যেদিকে জনবসতি নাই সেদিকে কিছুটা হচ্ছে। এটা প্রতিরোধ করার আমরা চেষ্টা করছি, সত্যি কথা বলতে আজকে সকালেও কিছু পুশ ইন হয়েছে। আমাদের বর্ডারটা এতো বিস্তৃত আসলে প্রতিটি জায়গাতো গার্ড করা সম্ভব না, এজন্য আমরা জনগণের সাহায্য চেয়েছি, আনসারের সাহায্য নিচ্ছি।’
বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এবং সীমান্তে বিজিবির ‘সার্বিক চেষ্টার’ কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ফ্ল্যাগ মিটিং, প্রতিবাদলিপি এবং এ ধরণের রুটিন যেগুলো আছে সেগুলো চলছে।
জনসাধারণকে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জনগণও যদি খেয়াল রাখে তাদের সীমান্তের কাছাকাছি যে ওইদিকে, কারও পুশইন করার জন্য… প্রথমেতো তারা এসে একটা জায়গায় রাখে তারপর হয়তো পুশ ইন করায়। এটা যদি স্থানীয় জনগণ খেয়াল করে আমাদের পেট্রোলকে খবর দিলে ওইদিকে কুইকলি যেতে পারে।’
এছাড়া নিজেদের টহল ও জনবল বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে জনসাধারণের কাছে ‘তথ্য সহায়তা’ চেয়েছেন তিনি। পুশ ইনের মধ্যে জঙ্গি বা অপরাধী দেশে প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে কি না জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘কোনোকিছুর সম্ভানাকেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবদিক থেকে সকল সম্ভানা রয়ে যায়। তবে আমাদের দেশের জন্য জাতির জন্য ক্ষতিকর হবে এমন কোনোকিছুই যাতে না হয় সেজন্য আমরা জোরদার নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি।’ এই ভাসমান বিওপিটি দেশেই নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডে তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এর মাধ্যমে এ এলাকায় অপরাধ এবং চোরাচালান আরো সুন্দরভাবে প্রতিহত করার আশা রাখি।