গোলাম কিবরিয়া : কয়েক বছর আগে ফেসবুকে একটি গ্রুপে গল্প লিখেছিলাম। সেখানে গুনে গুনে বিশ শব্দে গল্প লিখতে হয়। কৌতুকধর্মী গল্পটা এখানে প্রাসঙ্গিক। তাই আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার সুবিধার্থে সেটি তুলে ধরছি-
‘স্বপ্নে পাওয়া’ সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টে অভিযুক্ত হাবুল।
সুন্দরী সহকর্মীকে বলেছে, ‘আপনাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি…।’
হাবুলের আত্মপক্ষ সমর্থন- ‘মগবাজার স্বপ্নে বাজার করি। সেখানেই দেখেছি।’
নিরীহ কৌতুকধর্মী এই গল্পটা পুরুষ মনস্তত্ত্ব বোঝার একটি মোক্ষম উপাদান হতে পারে। গল্পের নিচে জমা পড়া শতাধিক কমেন্টের একটা বড় অংশ বুঝতেই পারছেন না, কেন হাবুলকে যৌন হেনস্তার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বলাবাহুল্য, এমন কমেন্টকারীদের প্রত্যেকেই পুরুষ। তাদের যুক্তি, গল্পের হাবুল চরিত্রটি তো কুরুচিপূর্ণ কিছু বলেনি বা সরাসরি কোনো যৌন ইঙ্গিতও করেনি, তাহলে তাকে কেন অভিযুক্ত করা হবে। ভালো যুক্তি। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কোন মানুষকে আপনি কী বলতে পারবেন, আর কাকে কী বলা উচিত নয়, সেই বিবেচনা বোধটুকু তো থাকতে হবে, নাকি!
আমরা যারা পুরুষের চোখে নারীকে দেখি, তাদের পক্ষে আসলে এটা বোঝাই সম্ভব না যে একজন সহকর্মী বা স্বল্প পরিচিতাকে বলা যায় না, ‘আপনাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি।’ এটি অবশ্যই একটি ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য। পুরুষ হিসেবে আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল, আপাত নিরীহ অনেক স্তুতিবাক্য, প্রশংসা বা কৌতুকের আড়ালে লুকানো থাকে যৌন হেনস্তার হুল। আমরা বুঝে বা না বুঝে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পদে নানাভাবে নারীর জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছি।
কর্মক্ষেত্রে নারীরা যে নানা রকম হয়রানি আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তার একটা বড় কারণ হচ্ছে তাদের সমস্যা একদমই বুঝতে না পারা এবং বুঝেও তা আমলে না নেওয়া। আবার দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অনেক ক্ষেত্রে জেনে-বুঝে নারীকে যৌন হেনস্তাসহ নানা রকম হয়রানিতে ফেলা হয়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা ধরেই নিই, নারীর প্রথম দায়িত্ব ঘর-সংসার সামলানো। ফুরসত মিললে অর্থ উপার্জন বা ক্যারিয়ার গড়ে তোলার মতো অপেক্ষাকৃত ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়গুলোয় মন দেবেন তারা।
অন্যদিকে কোনো পুরুষ যদি অফিস-ব্যবসা সামলে বাড়িতে এসে ঘরের কাজে সামান্যতমও হাত লাগায়, তাহলেই চারদিক থেকে সাধু সাধু রব ওঠে। পুরুষটিও বেশ আত্মশ্লাঘা নিয়ে ভাবেন, আমার মতো উদার-মানবিক ব্যক্তি আর কে আছে! ফলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, নারী ঘর সামলে বাইরে কাজ করবে, আর পুরুষ তার সব কাজ সামলে তারপর ঘরের কাজ করবে (অবশ্য যদি তার ইচ্ছা হয়)। তাই বলাই যায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতার শুরুটি হয় মূলত ঘর থেকেই।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। কাজের পরিবেশে নারীকে মুখোমুখি হতে হয় আরও শত যুদ্ধের। তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সংসারকে প্রাধান্য দিয়ে ঘন ঘন ছুটি নেওয়ার অভিযোগ, নারী কর্মীটি ছোট শিশুর মা হলে কাজের জায়গায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র না থাকা, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া বা পেলেও সেটি বিনা বেতনে, সন্তান পালন বা ঘর-সংসার সামলানো, কর্মক্ষেত্রে শৌচাগার বা অন্যান্য সুবিধা না থাকা- এমন শত ইস্যু তো রয়েছেই, সর্বোপরি রয়েছে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির মতো গুরুতর বিষয়।
এমন নানা কারণে নারীরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে আবার অনেকে কাজে যোগ দিয়েও চাকরিটা আর ধরে রাখতে পারছেন না। কর্মক্ষেত্র নামের জটিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একবার ছিটকে পড়লে আবার ফিরে আসা বা পায়ের নিচে মাটিটুকু ফিরে পাওয়া যে কতটা কঠিন, সেটি ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ জরুরি হলেও বাংলাদেশের নারীরা এখনো এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ৫ জানুয়ারি। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কমেছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে ১৯তম আইসিএলএসের (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) ভিত্তিতে দেশের শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের হার প্রায় ৪৯ শতাংশ। পুরুষের মধ্যে অংশগ্রহণের হার প্রায় ৭৯ শতাংশ এবং নারীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ। এর আগে ২০২২ ও ২০২৩ সালে নারীর অংশগ্রহণের হার যথাক্রমে ২১ শতাংশ ও প্রায় ২৩ শতাংশ ছিল।
এই চিত্রটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের করুণ চিত্রটি। তাহলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বা টিকে থাকার উপায় কী? একটা উপায় হতে পারে, আমাদের হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন। কথাটা শুনতে বেশ উপাদেয় হলেও বাস্তবসম্মত নয় মোটেই। দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং কাজ থেকে ছিটকে পড়া নারীদের ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি। বাস্তবতা বিবেচনায় দ্বিতীয় পথটি কঠিন হলেও এটি একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে।
আশার কথা হচ্ছে, খুব অল্প পরিসরে হলেও কাজটি কিন্তু শুরু হয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক হাতে নিয়েছে এমনই একটি উদ্যোগ। নারীকে কর্মজীবনে ফেরাতে, কাজের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ নামে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রথম পর্যায়ে কয়েকজন পেশাজীবী নারীকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ একটি ছয় মাসের কার্যক্রম, যেখানে নির্বাচিত নারী প্রার্থীরা নির্ধারিত হারে বেতন পাবেন। যার যার শিক্ষা ও পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী নির্ধারিত ক্ষেত্রে কাজের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশও কাছাকাছি সময়ে এ ধরনের আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছে, যার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নারীকে কর্মপরিবেশে ফিরিয়ে আনা।
লেখক: গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী