লীনা পারভীন : প্রেম একটি শ্বাশত বিষয়। এটিকে কেউ চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কখন কে কার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে সেটিও আগে থেকে বলা মুশকিল। স্মৃতিতে একজন যোগ্য প্রেমের গল্প মানেই শিরি ফরহাদ, ইউসুফ জুলেখার কাহিনি। রাধাকৃষ্ণ মানেই যুগলের আদর্শ। একজন কবি চন্ডিদাস ধোপি রজকিনির অপেক্ষায় পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকতেন। আজকাল তো ডিজিটাল প্রেমও দেখা যায়। প্রেমের টানে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যাচ্ছে মানুষ। প্রেম কোনো দিন জাত, পাত, লিঙ্গ, ধর্ম বা প্রতিপত্তি কিছুই দেখে না। মনের টানটাই এখানে মুখ্য থাকে। একজন প্রেমিক যদি সত্যিকার অর্থেই কাউকে প্রেম দিতে চায় তাহলে সেই প্রেম হয় নিঃস্বার্থ। পেলাম কি পেলাম না সেই হিসাবকে মাথায় রেখেই আগায় একজন প্রেমিক। আবার একজনের পছন্দ হলেই যে আরেকজন সেই ডাকে সাড়া দেবে তেমনটা ভাবাও অজ্ঞতার লক্ষণ। অথচ আমরা প্রায়শই সংবাদ দেখি প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় খুন করে ফেলছে একজন আরেকজনকে। কি বীভৎস চিন্তাভাবনা। পরপর কয়েকটা সংবাদ আমাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মিশু নামের একজন গার্মেন্টসকর্মীকে ছুরিকাঘাত করেছে সহকর্মী জাহিদ। মিশুর বয়স ২০ আর জাহিদের বয়স ৩০।
আরেক সংবাদ বলছে, গাজীপুরে কলেজছাত্রী রাবেয়াকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করে গৃহশিক্ষক সাইদুল ইসলাম। রাবেয়ার বয়স ২১ আর সাইদুলের বয়স ২৫। সাইদুল কেবল রাবেয়াকেই কোপায়নি, রাবেয়াকে রক্ষা করতে আসা মা ও তিন বোনকেও জখম করেছে। রাবেয়ার মা বর্তমানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। কতটা জঘন্য হলে একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থে একটা পরিবারকে শেষ করে দিতে পারে। জানা যায়, রাবেয়ার পরিবার তার ছোট দুই বোনকে কোরআন পড়ানোর জন্য সাইদুলকে গৃহশিক্ষক হিসেবে রেখেছিল। সাইদুল রাবেয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় কিন্তু রাবেয়ার পরিবার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে সাইদুলকে পড়াতে আসতে না করে দেয়। প্রতিশোধ হিসেবে সাইদুল বাসায় ঢুকে রাবেয়া, তার মা আর দুই বোনকে জখম করে; ফলে রাবেয়া অকালেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। সাইদুল যেহেতু কোরআনের শিক্ষক হিসেবে এসেছিল তার মানে সে একজন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ। একজন ধর্ম শিক্ষক যিনি সবাইকে ধর্মীয় নৈতিকতা শেখান। যার কাছ থেকে তার ছাত্রীরা ধর্মের মহৎ বাণী শেখার কথা সে কি না প্রেমের নামে এমন অপরাধ করতে পিছ পা হলো না?
আরও একটি জঘন্য সংবাদে চোখ আটকে গেলো। নেত্রকোনার বারহাট্টায় দশম শ্রেণির ছাত্রী মুক্তি রানী বর্মনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে কাউছার নামের এক যুবক। মুক্তির বয়স মাত্র ১৬ আর কাউছারের বয়স ১৮। কাউছার মুক্তিকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেও মুক্তি রাজি হয়নি। এতেই কাউছারের পৌরষত্বে লেগে যায়। স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তায়ই ধারালো দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় এবং একপর্যায়ে হাসপাতালে নেওয়ার পর মুক্তির মৃত্যু হয়। উপরের যে ঘটনাগুলো বলা হলো তার সবকটিই প্রেম সংক্রান্ত হত্যাকা-। আমি ভাবছি একজন প্রেমিক কি কখনও খুনি হতে পারে? আর যে খুনি সে কি কোনো দিন প্রেমিক হতে পারে? প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হওয়া বা না হওয়া তো প্রতিটা মানুষের অধিকার। প্রেমে পড়া যেমন দোষের কিছু নয় ঠিক তেমনি প্রেমে প্রত্যাখ্যান হওয়াও তো স্বাভাবিক। তাহলে কেন কাউছারের মতো এত অল্প বয়সী বাচ্চারা বা সাইদুলের মতো একজন কোরআন পড়ানো লোক খুনের মতো এত হিংসার রাস্তা বেছে নিচ্ছেন? কীসের অভাব তাদের? শিক্ষার না নৈতিকতার? নাকি অপরাধ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব? আইনের শাসন দিয়ে কি ঠেকানো যাবে এইসব ঘটনা? নাকি নারীদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধের অভাব? আমার মনে হয় কেবল আইন দিয়ে এমন ঘটনা ঠেকানো যাবে না। আইন, শাস্তি, সচেতনতার চেয়েও বড় অসুখ মানসিকতা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা ধরেই নেয় নারীদের নিজস্ব কোনো মতামত থাকতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক ইগো তাকে নারীর মুখে ‘ন ‘ শুনতে দেয় না। তারা মনে করে নারীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান হওয়া মানেই তার পৌরষত্বকে হেয় করা হয়। সমাজও তাদের এভাবেই শিখিয়েছে। তারা অভ্যস্ত হয় তাদের পরিবারে চলতে থাকা পুরুষশাসিত ব্যবস্থা দেখে। না হলে ১৮ বছর বয়সী কাউছারের এত সাহস কেমন করে হয়, যে প্রকাশ্যে রাস্তায় সবার সামনে মুক্তিকে কুপিয়ে মেরে ফেললো। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোথাও এখনও আলাদা করে জেন্ডার শিখায় না। সামাজিক বৈষম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একদল কেবল ক্ষমতার বলে আরেক দলকে অধীনস্ত করতে চায়। পুরুষতান্ত্রিকতাও ক্ষমতারই হাতিয়ার। সরকার পাঠ্যক্রমকে আধুনিক করতে চেয়েছিল। প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়ে খুব সুন্দর করে নারী পুরুষের বিষয়গুলোকে যুক্ত করেছিল। জেন্ডার, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাঠ্যক্রমে যুক্ত করেছিল বলে জেনেছিলাম। তীব্র প্রতিবাদ আসা শুরু করে দিল মৌলবাদের ঘর থেকে। জানি না সেগুলো এখনও বইয়ে আছে না উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কুপুমন্ডুক পাঠ্যক্রম দিয়ে আধুনিক চিন্তার মানুষ তৈরি করা যায় না। একজন মানুষের মনোজগতের কাঠামো তাকে পরিচালনা করে। তার বিশ্বাসকে গাইড করে। পারিবারিকভাবে কোন চর্চাকে সে গ্রহণ করবে সেটাও কিন্তু নির্ভর করে সেই মানুষটির মানসিকতার গঠনের ওপর। তাই মুক্তিদের বাঁচাতে হলে আমাদের কাজ করতে হবে কাউছারদের মতো বিকৃত মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য।
পুরুষতান্ত্রিক প্রেমের বলি যখন নারীরা
জনপ্রিয় সংবাদ