মানুষকে যুগে যুগে সমাজ শিখিয়েছে কীভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়। কিন্তু শেখায়নি কীভাবে সম্পর্ক বাঁচাতে হয়। বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক উপলব্ধি, স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও ব্যক্তিসত্তার প্রতি সম্মান; যা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো প্রায়ই অস্বীকার করে। এ অস্বীকৃতির ভেতর থেকেই নারীবাদের জন্ম- বিদ্রোহ নয়, বরং আত্মসচেতনতার আর্তি হিসেবে। নারীবাদ পুরুষের বিরোধিতা নয়; এটি মানবিক ভারসাম্যের দাবি। নারী শুধু স্নেহের উৎস বা পরিবারের প্রতীক নন, তিনি একজন ব্যক্তি; যার চিন্তা, আকাক্সক্ষা ও অভিজ্ঞতা স্বতন্ত্র। নারীবাদ ওই ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতির আন্দোলন; যা সম্পর্কের ভেতরেও সমতা খোঁজে। কারণ সম্পর্ক কেবল ভালোবাসার বিষয় নয়, এটি ক্ষমতারও বিষয়। যেখানে একজন প্রভাবশালী আর অন্যজন আনুগত্যে আবদ্ধ; সেখানে ভালোবাসা নয়, বরং কর্তৃত্ব টিকে থাকে। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার
মানুষের সভ্যতা মূলত সম্পর্কের ওপর নির্মিত- রক্তের বন্ধন, প্রেমের প্রতিশ্রুতি, সামাজিক দায় ও পারস্পরিক নির্ভরতার জটিল শৃঙ্খলে। তবু এই সম্পর্কের ভেতরই বাস করে গভীর দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ ও একাকিত্ব। সমাজ তার নীতি নির্মাণে মানুষকে এক নিয়মিত কাঠামোয় বেঁধে রাখে; যেখানে সম্পর্ক হয়ে ওঠে দায়িত্বের প্রয়োগ। কিন্তু অনেক সময় হারিয়ে যায় তার প্রাথমিক মানবিকতা।
মানুষের প্রকৃতিতে প্রেম ও সংযোগের প্রবণতা আদিম, কিন্তু সমাজ সেই প্রবৃত্তিকে রূপ দেয় নিয়মে, প্রথায়, শৃঙ্খলায়। তাই এক পক্ষ যেখানে সম্পর্কের ছোট ছোট নিশ্চয়তায় তৃপ্ত থাকে, অন্য পক্ষ বয়ে বেড়ায় অসম প্রত্যাশা ও ক্লান্তি। এই অমিল কোনো ব্যক্তিগত অক্ষমতার নয়; বরং সামাজিক বিন্যাস ও মানসিক পরিপক্বতার অমিলের ফল।
সমাজ এখনো সম্পর্ককে দেখে দায়িত্বের দৃষ্টিতে, পারস্পরিক সম্মানের নয়। একে অপরের জীবনে স্থান পেতে গিয়ে মানুষ প্রায়ই নিজের সত্তাকে বিলুপ্ত করে ফেলে। অথচ সত্যিকারের সম্পর্ক তখনই বিকশিত হয়, যখন দুজন মানুষ স্বাধীন অথচ সংযুক্ত থাকে যেখানে ভালোবাসা কোনো চুক্তি নয়, বরং পারস্পরিক প্রজ্ঞা ও সংবেদনশীলতার প্রকাশ।
নারীবাদ স্বাধীনতাকেই পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানায়। এটি বলে- সম্পর্কের সৌন্দর্য তখনই সত্য; যখন নারী তার চিন্তা, ইচ্ছা ও আত্মমর্যাদায় স্বাধীন থাকে। যে সম্পর্ক নারীর কণ্ঠকে দমন করে; তা যতই সামাজিকভাবে স্বীকৃত হোক না কেন, তার ভেতর থাকে নিঃশব্দ নিপীড়নের ইতিহাস।
ভবিষ্যতের পৃথিবী হয়তো সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। মানুষ শিখবে যে ভালোবাসা মানে অধিকার নয়, বরং একে অন্যের বিকাশে সঙ্গী হওয়া। সমাজ হয়তো একদিন বুঝবে, নারীবাদ কোনো পৃথক মতবাদ নয়, এটি মানবসভ্যতার বিবর্তিত চেতনা; যা শেখায় কীভাবে ভালোবাসতে হয় মর্যাদা রেখে, কীভাবে সম্পর্ক গড়তে হয় সমতার বোধে।
যদি সম্পর্ক এক শিল্প হয়, তাহলে নারীবাদ ওই শিল্পের নৈতিকতা। কারণ ভালোবাসা তখনই পূর্ণ হয়- যখন তা কারো স্বাধীনতাকে ছাপিয়ে যায় না, বরং সেটিকেই সৌন্দর্যের অংশ করে তোলে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ






















