ঢাকা ১২:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

পুরান ঢাকাকে আধুনিক করার উদ্যোগ

  • আপডেট সময় : ১০:৩৪:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ মার্চ ২০২২
  • ৮৫ বার পড়া হয়েছে

মহানগর প্রতিবেদন : ব্লকভিত্তিক পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগে বদলে যাবে পুরান ঢাকা। যদিও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, বাসযোগ্যতার সূচকে পুরান ঢাকা অনেক নি¤œ অবস্থানে। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। তবে নাগরিক সুবিধা ও পরিষেবা নিশ্চিত করে পুরান ঢাকার পুনঃউন্নয়ন সম্ভব। তার আগে এর সুফল সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে হবে। অর্জন করতে হবে আস্থা। এছাড়া যথাসময়ে প্রকল্প কাজ শেষ এবং আনুপাতিক হারে উন্নয়ন করা সম্পত্তির ভাগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকল্প চলাকালীন জমি মালিকদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে ক্ষতিপূরণের।
ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে প্রথমে (১৯৯৫-২০১৫) একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুনে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হলেও তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পরে ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সাত মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে সরকার। তখন আবারও ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা। পরে ২০১৫ সালের মার্চে আগের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন এবং স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি জনবান্ধব ও বাস্তবসম্মত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ড্যাপ পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। পরে তা অনুমোদন এবং মতামতের জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) পুরান ঢাকা পুনঃউন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। চলতি মাসে ড্যাপ চূড়ান্ত বা গেজেট হওয়ার কথা। গেজেটের পরপরই পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার এক কাঠা-দুই কাঠা জমিতে অপরিকল্পতিভাবে বহুতল অসংখ্য ভবন গড়ে উঠছে। এমনও দেখা গেছে, এক দেওয়ালে দুই ভবন তৈরি করতে। ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা নেই। এমন ছোট জমিগুলো একত্র করে ব্লকভিত্তিক পুনঃউন্নয়ন করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে পুরান ঢাকার মানুষের মতামতকে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আটটি থানার ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরান ঢাকার বিস্তৃতি। এর প্রধান এলাকাগুলো হচ্ছে- লালবাগ, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, সূত্রাপুর, সদরঘাট, কোতোয়ালি, ইসলামপুর, বাবুবাজার, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, শাঁখারীবাজার, গোলনগর, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতিবাজার ও বাংলাবাজার। ড্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় ৫ ফুট প্রশস্তের নিচে ১০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার, ৫-১০ ফুটের ৪৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, ১০-১৫ ফুটের ৩২ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার, ১৫-২০ ফুটের ১৬ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার, ২০-৩০ ফুটের ১২ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার, ৩০-৫০ ফুটের ৩ দশমিক ৬০ কিলোমিটার, ৫০ থেকে ১০০ ফুট প্রশস্তের ৪ দশমিক ৩১ কিলোমিটার এবং ১০০ ফুট প্রশস্তের ওপরে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, যা একটি আদর্শ নগরের মানদ-ের চেয়ে অনেক কম।
এছাড়া ড্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় মোট এক হাজার ১৩১ দশমিক ৪৬ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে আবাসিক হিসেবে ৩৪ দশমিক ৫৪ একর, মিশ্র হিসেবে ২৩ দশমিক ৩৬, পরিবহন ও যোগাযোগের জন্য ১০ দশমিক ৩২, শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ৮ দশমিক ৮৯, বাণিজ্যিক হিসেবে ৭ দশমিক ২৭, কমিউনিটি ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে ৪ দশমিক ১৯, উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ৩ দশমিক ৭৩, সংরক্ষিত হিসেবে ২ দশমিক ১৭, জলাশয় হিসেবে ২ দশমকি ৮, শিল্প হিসেবে ১ দশমিক ৬৬, প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে শূন্য দশমিক ৪৯, স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে শূন্য দশমিক ৩১, খালি জায়গা হিসেবে শূন্য দশমিক ৩০ এবং প্রশাসনিক হিসেবে শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহার হচ্ছে।
পুরান ঢাকা নিয়ে ড্যাপের সুপারিশ : ড্যাপে পুরান ঢাকা নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করে পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা, বুড়িগঙ্গা নদী ঘিরে পুরান ঢাকার জন্য সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি, সংস্কৃতিভিত্তিক শহর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ভূমির পুনঃউন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে এ এলাকায় মৌলিক সুবিধাদির ব্যবস্থা করা, জনমানুষের নিরাপত্তায় রাসায়নিক গুদাম পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর এবং পুরাতন জেলখানা এলাকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরে জনপরিসর গড়ে তোলা। পাশাপাশি পর্যাপ্ত গাছপালাযুক্ত পার্ক, খেলার মাঠসহ খোলা জায়গা সৃষ্টি হবে। যদিও এখন পুরান ঢাকার আদর্শ মানদ-ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জনবসতি রয়েছে। একটি আদর্শ আবাসিক এলাকায় প্রতি একরে ১২০ জন বাস করার কথা। এখন এ এলাকায় গড়ে ৪২০ জন করে বসবাস করছেন।
পুরান ঢাকার বিদ্যমান সমস্যা : বর্তমানে পুরান ঢাকায় কী কী ধরনের সমস্যা আছে, ড্যাপে তা উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে জরাজীর্ণ ভবন, সংকীর্ণ রাস্তা, ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত নাগরিক উন্মুক্ত স্থান, উচ্চ ঘনত্ব, নি¤œমানের জীবনযাপন, ভূমিকম্প ও অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ড্যাপে বলা হয়েছে, নগরে ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা রয়েছে। কিন্তু পুরান ঢাকার এসব এলাকায় তা মানা হয়নি। যে যার মতো বহুতল ভবন তৈরি করেছেন। তারা রাস্তার জন্য জায়গা ছাড়ছেন না। ফলে অগ্নিকা-ের সময় ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারছে না। এমন অবস্থায় পুরান ঢাকার ছোট প্লটগুলোকে একত্র করে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন জরুরি।
এসব সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যমান ভবন ও অবকাঠামো পুনর্র্নিমাণ, পুনর্বিন্যাস করা যাবে বলে মনে করেন পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের বাসিন্দা মোস্তাকিম বিল্লাহ। তিনি বলেন, রাস্তা চওড়া ও পরিকল্পিত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। এতে ভূমিকম্প, অগ্নিদুর্ঘটনা কমবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ধাপ : রাজউক সূত্র জানায়, ড্যাপ গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর পুরান ঢাকা পুনঃউন্নয়নে কাজ শুরু হবে। প্রথম বছর— সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বিশদ নকশা প্রণয়ন, প্রকল্প অনুমোদন ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে চুক্তি হবে। দ্বিতীয় বছর— মূলত বাণিজ্যিক এলাকা ও রাস্তা নির্মাণ করা। তৃতীয় বছর— স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট, ইউটিলিটি লাইট সম্পন্ন করা এবং চতুর্থ ও পঞ্চম বছর স্কুল, কলেজ, মসজিদ, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্রসহ কমিউনিটি সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা। পাশাপাশি অ্যাপার্টমেন্টগুলো মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া।
পুনর্র্নিমাণে প্রধান চ্যালেঞ্জ : এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দেখছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, পুরান ঢাকা নিয়ে সরকারকে বহু উদ্যোগ নিতে দেখেছি। কিন্তু তেমন কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো পুরান ঢাকার প্রধান সমস্যা যানজট। এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ জরুরি। বিশেষ করে পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে প্রাথমিক আর্থিক তহবিল নির্ধারণ ও নাগরিকদের জন্য প্রাথমিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও লাগবে। অন্যথায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সফল হবে না।
প্রতিটি শহরের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অ্যালামনাই আয়েশা সাঈদ বলেন, চাইলেই পুরান ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুর করা যাবে না। তবে একে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পুনঃউন্নয়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি স্থাপনার নিজস্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে পুনঃউন্নয়ন করতে হবে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুরান ঢাকার উন্নয়নে অবশ্যই ব্লকভিত্তিক পদ্ধতিতে আসতে হবে। বিশ্বের অনেক শহরে এমন নজির রয়েছে। আমরা সেজন্যই একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছি। ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর প্রকল্প তৈরি ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ দেওয়া হবে।
‘প্রকল্প এলাকার সীমানা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ভৌত ও আর্থ-সামাজিক জরিপ, পরিবেশ ও পরিবহনগত প্রভাব এবং সামাজিক প্রভাব সমীক্ষার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি সম্পাদন করা হবে। এর আগে বাড়ির মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দফতর ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে শুরু করা হবে প্রকল্পের কাজ।’-

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

পুরান ঢাকাকে আধুনিক করার উদ্যোগ

আপডেট সময় : ১০:৩৪:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ মার্চ ২০২২

মহানগর প্রতিবেদন : ব্লকভিত্তিক পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগে বদলে যাবে পুরান ঢাকা। যদিও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, বাসযোগ্যতার সূচকে পুরান ঢাকা অনেক নি¤œ অবস্থানে। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অধিক জনঘনত্ব। তবে নাগরিক সুবিধা ও পরিষেবা নিশ্চিত করে পুরান ঢাকার পুনঃউন্নয়ন সম্ভব। তার আগে এর সুফল সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে হবে। অর্জন করতে হবে আস্থা। এছাড়া যথাসময়ে প্রকল্প কাজ শেষ এবং আনুপাতিক হারে উন্নয়ন করা সম্পত্তির ভাগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকল্প চলাকালীন জমি মালিকদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে ক্ষতিপূরণের।
ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে প্রথমে (১৯৯৫-২০১৫) একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুনে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হলেও তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পরে ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সাত মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে সরকার। তখন আবারও ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা। পরে ২০১৫ সালের মার্চে আগের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন এবং স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি জনবান্ধব ও বাস্তবসম্মত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ড্যাপ পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। পরে তা অনুমোদন এবং মতামতের জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) পুরান ঢাকা পুনঃউন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। চলতি মাসে ড্যাপ চূড়ান্ত বা গেজেট হওয়ার কথা। গেজেটের পরপরই পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে পুনঃউন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার এক কাঠা-দুই কাঠা জমিতে অপরিকল্পতিভাবে বহুতল অসংখ্য ভবন গড়ে উঠছে। এমনও দেখা গেছে, এক দেওয়ালে দুই ভবন তৈরি করতে। ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা নেই। এমন ছোট জমিগুলো একত্র করে ব্লকভিত্তিক পুনঃউন্নয়ন করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে পুরান ঢাকার মানুষের মতামতকে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আটটি থানার ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরান ঢাকার বিস্তৃতি। এর প্রধান এলাকাগুলো হচ্ছে- লালবাগ, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, সূত্রাপুর, সদরঘাট, কোতোয়ালি, ইসলামপুর, বাবুবাজার, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, শাঁখারীবাজার, গোলনগর, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতিবাজার ও বাংলাবাজার। ড্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় ৫ ফুট প্রশস্তের নিচে ১০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার, ৫-১০ ফুটের ৪৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, ১০-১৫ ফুটের ৩২ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার, ১৫-২০ ফুটের ১৬ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার, ২০-৩০ ফুটের ১২ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার, ৩০-৫০ ফুটের ৩ দশমিক ৬০ কিলোমিটার, ৫০ থেকে ১০০ ফুট প্রশস্তের ৪ দশমিক ৩১ কিলোমিটার এবং ১০০ ফুট প্রশস্তের ওপরে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, যা একটি আদর্শ নগরের মানদ-ের চেয়ে অনেক কম।
এছাড়া ড্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় মোট এক হাজার ১৩১ দশমিক ৪৬ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে আবাসিক হিসেবে ৩৪ দশমিক ৫৪ একর, মিশ্র হিসেবে ২৩ দশমিক ৩৬, পরিবহন ও যোগাযোগের জন্য ১০ দশমিক ৩২, শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ৮ দশমিক ৮৯, বাণিজ্যিক হিসেবে ৭ দশমিক ২৭, কমিউনিটি ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে ৪ দশমিক ১৯, উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ৩ দশমিক ৭৩, সংরক্ষিত হিসেবে ২ দশমিক ১৭, জলাশয় হিসেবে ২ দশমকি ৮, শিল্প হিসেবে ১ দশমিক ৬৬, প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে শূন্য দশমিক ৪৯, স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে শূন্য দশমিক ৩১, খালি জায়গা হিসেবে শূন্য দশমিক ৩০ এবং প্রশাসনিক হিসেবে শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহার হচ্ছে।
পুরান ঢাকা নিয়ে ড্যাপের সুপারিশ : ড্যাপে পুরান ঢাকা নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করে পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা, বুড়িগঙ্গা নদী ঘিরে পুরান ঢাকার জন্য সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি, সংস্কৃতিভিত্তিক শহর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ভূমির পুনঃউন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে এ এলাকায় মৌলিক সুবিধাদির ব্যবস্থা করা, জনমানুষের নিরাপত্তায় রাসায়নিক গুদাম পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর এবং পুরাতন জেলখানা এলাকার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরে জনপরিসর গড়ে তোলা। পাশাপাশি পর্যাপ্ত গাছপালাযুক্ত পার্ক, খেলার মাঠসহ খোলা জায়গা সৃষ্টি হবে। যদিও এখন পুরান ঢাকার আদর্শ মানদ-ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জনবসতি রয়েছে। একটি আদর্শ আবাসিক এলাকায় প্রতি একরে ১২০ জন বাস করার কথা। এখন এ এলাকায় গড়ে ৪২০ জন করে বসবাস করছেন।
পুরান ঢাকার বিদ্যমান সমস্যা : বর্তমানে পুরান ঢাকায় কী কী ধরনের সমস্যা আছে, ড্যাপে তা উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে জরাজীর্ণ ভবন, সংকীর্ণ রাস্তা, ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত নাগরিক উন্মুক্ত স্থান, উচ্চ ঘনত্ব, নি¤œমানের জীবনযাপন, ভূমিকম্প ও অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ড্যাপে বলা হয়েছে, নগরে ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা রয়েছে। কিন্তু পুরান ঢাকার এসব এলাকায় তা মানা হয়নি। যে যার মতো বহুতল ভবন তৈরি করেছেন। তারা রাস্তার জন্য জায়গা ছাড়ছেন না। ফলে অগ্নিকা-ের সময় ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারছে না। এমন অবস্থায় পুরান ঢাকার ছোট প্লটগুলোকে একত্র করে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন জরুরি।
এসব সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যমান ভবন ও অবকাঠামো পুনর্র্নিমাণ, পুনর্বিন্যাস করা যাবে বলে মনে করেন পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের বাসিন্দা মোস্তাকিম বিল্লাহ। তিনি বলেন, রাস্তা চওড়া ও পরিকল্পিত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। এতে ভূমিকম্প, অগ্নিদুর্ঘটনা কমবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ধাপ : রাজউক সূত্র জানায়, ড্যাপ গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর পুরান ঢাকা পুনঃউন্নয়নে কাজ শুরু হবে। প্রথম বছর— সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বিশদ নকশা প্রণয়ন, প্রকল্প অনুমোদন ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে চুক্তি হবে। দ্বিতীয় বছর— মূলত বাণিজ্যিক এলাকা ও রাস্তা নির্মাণ করা। তৃতীয় বছর— স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট, ইউটিলিটি লাইট সম্পন্ন করা এবং চতুর্থ ও পঞ্চম বছর স্কুল, কলেজ, মসজিদ, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্রসহ কমিউনিটি সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা। পাশাপাশি অ্যাপার্টমেন্টগুলো মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া।
পুনর্র্নিমাণে প্রধান চ্যালেঞ্জ : এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দেখছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, পুরান ঢাকা নিয়ে সরকারকে বহু উদ্যোগ নিতে দেখেছি। কিন্তু তেমন কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো পুরান ঢাকার প্রধান সমস্যা যানজট। এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ জরুরি। বিশেষ করে পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে প্রাথমিক আর্থিক তহবিল নির্ধারণ ও নাগরিকদের জন্য প্রাথমিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও লাগবে। অন্যথায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সফল হবে না।
প্রতিটি শহরের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অ্যালামনাই আয়েশা সাঈদ বলেন, চাইলেই পুরান ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুর করা যাবে না। তবে একে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পুনঃউন্নয়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি স্থাপনার নিজস্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে পুনঃউন্নয়ন করতে হবে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুরান ঢাকার উন্নয়নে অবশ্যই ব্লকভিত্তিক পদ্ধতিতে আসতে হবে। বিশ্বের অনেক শহরে এমন নজির রয়েছে। আমরা সেজন্যই একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছি। ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর প্রকল্প তৈরি ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ দেওয়া হবে।
‘প্রকল্প এলাকার সীমানা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ভৌত ও আর্থ-সামাজিক জরিপ, পরিবেশ ও পরিবহনগত প্রভাব এবং সামাজিক প্রভাব সমীক্ষার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি সম্পাদন করা হবে। এর আগে বাড়ির মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দফতর ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে শুরু করা হবে প্রকল্পের কাজ।’-