ঢাকা ১০:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

পুত্র সন্তানের জন্য স্ত্রীর ওপর এখনো নির্যাতন চালায় বহু পুরুষ

  • আপডেট সময় : ০৬:৪০:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

মানুষ মরে গেলে তার জীবন সেখানেই শেষ। খুব প্রতিষ্ঠিত কেউ হলে বংশ টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন দুই-এক জেনারেশনের মধ্যে থাকে। এরপর সব শেষ। সম্পত্তি, পরিচয়, নাম-নিশানা কিছুই থাকে না। আর সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাও থাকে না। বৃদ্ধ বয়সে ছেলে সন্তান দেখাশোনা করবে- এখন এই ধারণাও আর চলে না। মায়ের গর্ভে পুরুষের জন্ম; কন্যা সন্তানের বাবাও একজন পুরুষ; পুরুষের ভালোবাসার জন একজন নারী, স্ত্রী অথবা প্রেমিকা। তাহলে কন্যা সন্তানের প্রতি অনেক পুরুষের এত অনীহা ও ঘৃণা কেন? এই পৃথিবী বাসযোগ্য হয়েছে নারী-পুরুষের সমান্তরাল অবস্থানে। এরপরও পুত্র সন্তানের প্রতি টানের কারণে পুরুষদের একটা অংশ স্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়োগ ও নির্যাতন চালাতেও কুণ্ঠিত হয় না। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার

পৃথিবীর ১ কোটি ৪২ লাখ নারী বিশ্বাস করেন, শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে তারা পরিবার ও সমাজ থেকে নিগৃহীত হয়েছেন। বেশির ভাগ সময় পরিবার থেকে শুনতে হয়, তাদের পরিবার একজন মেয়ে নয়; বরং ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করেছিল।

সমাজে এখনো মেয়ে সন্তান কতা অপাঙ্ক্তেয়, এর আরেকটি প্রমাণ শাহজাদী বেগম। ১১ দিন বয়সি কন্যাসন্তানকে নিয়ে তার স্থান হয়েছিল কারাগারে। আদালতে শাহজাদী বেগমের পক্ষে আইনজীবীর জামিন আবেদন না থাকায় এবং শুনানী না হওয়ায় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল শাহজাদী বেগমকে। অবশেষে শাহজাদী বেগমের জামিন হয়েছে।

শাহজাদী বেগমের দোষ উনি হাসপাতালে অন্য এক মায়ের পুত্র সন্তান চুরি করেছেন। শাহজাদীর সংসারে চার কন্যা রয়েছে। আবারো অন্তঃসত্ত্বা হন শাহজাদী। তবে অনাগত সন্তান যেন ছেলে হয় এমন প্রত্যাশা ছিল স্বামী ও তার পরিবারের। যদিও অনাগত সন্তান কন্যা না পুত্র হবে, এটা মায়ের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে বাবার উপর। কিন্তু এই কথা অধিকাংশ মানুষ জানে না, জানলেও মানে না। তাই শাহজাদী বেগমকে কন্যাসন্তান হলে বিয়ে বিচ্ছেদের হুমকি দিয়েছিল স্বামী। এই অবস্থায় সিজারিয়ানের মাধ্যমে শাহজাদীর কন্যা সন্তানের জন্ম দানের সংবাদ শুনেই হাসপাতাল ত্যাগ করে সিরাজুল ইসলাম। পরের দিনগুলোতে সেই বাবা আর হাসপাতালে আসেনি। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও রাখেনি।

স্বামী, পরিবার ও নানামুখী চাপে দিশাহারা শাহজাদী একই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া আরেক নারীর ছেলে সন্তান চুরি করতে বাধ্য হন। তিনি ভেবেছেন এই করে হয়তো তার সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তার স্বামী ও স্বামীর পরিবার এতগুলো কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার দায়ে শাহজাদী বেগমকে গ্রহণ করবে না।

শাহজাদী বেগমের দোষ উনি হাসপাতালে অন্য এক মায়ের পুত্রসন্তান চুরি করেছেন। শাহজাদীর সংসারে চার কন্যা রয়েছে। আবারো অন্তঃসত্ত্বা হন শাহজাদী। তবে অনাগত সন্তান যেন ছেলে হয় এমন প্রত্যাশা ছিল স্বামী ও তার পরিবারের। যদিও অনাগত সন্তান কন্যা না পুত্র হবে, এটা মায়ের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে বাবার উপর। কিন্তু এই কথা অধিকাংশ মানুষ জানে না, জানলেও মানে না। তাই শাহজাদী বেগমকে কন্যাসন্তান হলে বিয়ে বিচ্ছেদের হুমকি দিয়েছিল স্বামী।

নিজের সন্তানকে অগ্রাহ্য করে অন্যের ছেলে সন্তান চুরি করার দায় কি একা শাহজাদীর? তার স্বামী, পরিবার ও সমাজ তাকে বাধ্য করেছে এরকম একটি গর্হিত কাজ করতে। অথচ কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার দায় কিন্তু নারীর নয়। এই বৈজ্ঞানিক ধ্রুব সত্যটা এ দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না, মানে না। বিপরীতে নারীর ওপর নেমে আসে খড়্গ হস্ত। একই কারণে মুন্সিগঞ্জে বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ফেলে ছয় মাস বয়সি যমজ দুই শিশু কন্যাকে হত্যা করেছেন মা শান্তা বেগম। বিয়ের প্রায় দুই বছর পর কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ায় স্বামী তা মেনে নিতে না পারেনি। পারিবারিক কলহের জেরে মা নিজেই যমজ শিশু কন্যাকে পুকুরের পানিতে ফেলে হত্যা করেন। এখানেও মা এই অমানবিক কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন স্বামীর অত্যাচারের জের ধরে। এই ঘটনায় মা আসামি ঠিকই কিন্তু স্নেহ মাকে আসামি হতে বাধ্য করছে কে বা কারা? তাদের কোনো দায় থাকে না, থাকে না কোনো জবাবদিহিতা। কন্যাসন্তান হওয়ার কারণে মাকে যে উপর্যুপরি নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, মানসিকভাবে ট্রমাটাইজড করা হচ্ছে, এর কোনো বিচার নেই।

মেয়ে সন্তানের জন্ম যে অনেক পরিবারেই কাক্সিক্ষত নয়, তা আমরা জানি। শুধু গ্রামে নয়, শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও পুত্র সন্তানের ব্যাপক চাহিদা। প্রায় সবারই ধারণা ছেলে সন্তান বংশের বাতি, সম্পত্তি রক্ষা করবে ও বাবা-মায়ের দেখাশোনা করবে। আর পরিবারে এই ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার দায়িত্ব নারীর অর্থাৎ মায়ের। ঠিক একইভাবে ‘অপয়া’ কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধ মায়েরই।

বাংলাদেশে যখন এই অবস্থা, সেখানে বিশ্বব্যাপী বাবা-মায়েদের মানসিকতায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঐতিহ্যগতভাবে পুত্রসন্তানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, আর তার জায়গা দখল করছে কন্যাসন্তানের প্রতি আগ্রহ। বিশেষ করে জনসংখ্যায় শীর্ষস্থানীয় দুই দেশ চীন ও ভারতে। একসময় এই দুই দেশে আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিপুলসংখ্যক কন্যাভ্রƒণ গর্ভেই হত্যা করা হতো।

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য টাইমস জানিয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বের অন্তত ২ কোটি কন্যাশিশু জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। তবে এই ধারা পাল্টাতে শুরু করেছে। গবেষণা বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বে কন্যাভ্রূণ গর্ভপাতের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে মাত্র ১ লাখ ৭ হাজারে; যেখানে ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৬ হাজার অর্থাৎ সাত গুণ হ্রাস।

ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ জার্নালের ২০২৩ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ইউরোপের দেশগুলোতেও মনোভাবের এই পরিবর্তন স্পষ্ট। বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্সে দেখা গেছে, প্রথম সন্তান কন্যা হলে অনেক বাবা-মা দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। অর্থাৎ তারা কন্যা সন্তানকেই চূড়ান্ত পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জাপানে যেসব দম্পতি এক সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের ৭৫ শতাংশই কন্যা সন্তান চান- যেখানে ১৯৮২ সালে এই হার ছিল ৫০ শতাংশের নিচে।

এখন মা-বাবা কেন কন্যা সন্তান বেশি পছন্দ করছেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, কন্যা সন্তানদের সাধারণত যত্নশীল, পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনের মতো দেশে অতিরিক্ত ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়ার কারণে বিয়ে ও সামাজিক স্থিতি নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। ব্রিটেনে ছেলেদের মধ্যে বেকারত্ব, অপরাধপ্রবণতা ও শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার কন্যাসন্তানকে ‘নিরাপদ ভবিষ্যৎ’ মনে করছেন। (তথ্যসূত্র : দ্য টাইমস, ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান)।

কুড়িগ্রামের প্রসূতি আছমা বেগমের অভিযোগ ছিল, ‘বিয়ের পর থেকে আমার স্বামী আমাকে নির্যাতন করতো। আমার গর্ভে সন্তান এসেছে, এ খবর জানার পর আরও বেশি নির্যাতন করতো। বলতো, ছেলে হলে সুখ পাবে, আর মেয়ে হলে দুঃখ পাবে। পরে আমার মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। এ সংবাদ পেয়ে আমার স্বামী আমাদের বাড়িতে বালু ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে।

বাংলাদেশে পুরুষ একা নয়, নারীও এই অবৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্বাস করেন এবং নিজেকে দায়ী মনে করেন। অথচ সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে এই প্রক্রিয়াটি নিজের মতো কাজ করে এবং তা বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীদের দায়ী করার কোনো মানে হয় না। সন্তানের লিঙ্গের উপর মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কারণ এটি গর্ভধারণের সময় নির্ধারিত হয়। আর সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে লিঙ্গ নির্বিশেষে, প্রতিটি সন্তান সমানভাবে মূল্যবান।

মাকে দায়ী করার এই প্রবণতা নারীর প্রতি সামাজিক কলঙ্ক আরোপ এবং দুর্ব্যবহারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য অনেক পরিবারে মায়েদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা এবং হয়রানিও করার হয়। এই কারণে মায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার জন্য মাকে দায়ী করা পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত। মাকে দায়ী করার পাশাপাশি এরা কন্যাশিশুর জন্মকেও অস্বীকার করে।

প্রশ্ন উঠে মায়েরা কেন ছেলে সন্তান চাইছেন, কেন মেয়ে সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করছেন? কারণ সমাজের চাপ এবং শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। তারাও মেয়ে সন্তানকে ‘কম লাভজনক’ মনে করছেন। সেইসাথে তারা ভাবছেন মেয়েসন্তান জন্ম দেয়ার দায়ে তারা নির্যাতিত হতে পারেন।

মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে পরিবার যদি জানতে পারে কোন গর্ভবতী নারীর কন্যা হবে, তাহলে সেই নারীর কম যত্ন নেয়া হয়, খাওয়া কম দেওয়া হয়। আর গর্ভে পুত্র সন্তান থাকলে তার যত্ন বেশি নেওয়া হয়। সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। একাধিক কন্যা সন্তানের মায়েরা দুর্ব্যবহার, বিবাহ বিচ্ছেদ বা এমনকি প্রাণ হারানোর ভয়ও করেন।

কন্যা সন্তান জন্মের পর যৌতুকের চাপ বাড়তে পারে। ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে (২০২১) উল্লেখ করা হয়েছিল যে খুলনার একটি গ্রামে একজন মা কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে অতিরিক্ত যৌতুকের জন্য চাপ দিয়েছিল। তারা মনে করতো কন্যাসন্তান পরিবারের জন্য ‘অর্থনৈতিক বোঝা’। এই ধরনের ঘটনা মাকে দায়ী করার পাশাপাশি তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়া কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় মাকে সামাজিক কটূক্তির মুখে পড়তে হয়।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

পুত্র সন্তানের জন্য স্ত্রীর ওপর এখনো নির্যাতন চালায় বহু পুরুষ

আপডেট সময় : ০৬:৪০:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫

মানুষ মরে গেলে তার জীবন সেখানেই শেষ। খুব প্রতিষ্ঠিত কেউ হলে বংশ টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন দুই-এক জেনারেশনের মধ্যে থাকে। এরপর সব শেষ। সম্পত্তি, পরিচয়, নাম-নিশানা কিছুই থাকে না। আর সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাও থাকে না। বৃদ্ধ বয়সে ছেলে সন্তান দেখাশোনা করবে- এখন এই ধারণাও আর চলে না। মায়ের গর্ভে পুরুষের জন্ম; কন্যা সন্তানের বাবাও একজন পুরুষ; পুরুষের ভালোবাসার জন একজন নারী, স্ত্রী অথবা প্রেমিকা। তাহলে কন্যা সন্তানের প্রতি অনেক পুরুষের এত অনীহা ও ঘৃণা কেন? এই পৃথিবী বাসযোগ্য হয়েছে নারী-পুরুষের সমান্তরাল অবস্থানে। এরপরও পুত্র সন্তানের প্রতি টানের কারণে পুরুষদের একটা অংশ স্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়োগ ও নির্যাতন চালাতেও কুণ্ঠিত হয় না। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার

পৃথিবীর ১ কোটি ৪২ লাখ নারী বিশ্বাস করেন, শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে তারা পরিবার ও সমাজ থেকে নিগৃহীত হয়েছেন। বেশির ভাগ সময় পরিবার থেকে শুনতে হয়, তাদের পরিবার একজন মেয়ে নয়; বরং ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করেছিল।

সমাজে এখনো মেয়ে সন্তান কতা অপাঙ্ক্তেয়, এর আরেকটি প্রমাণ শাহজাদী বেগম। ১১ দিন বয়সি কন্যাসন্তানকে নিয়ে তার স্থান হয়েছিল কারাগারে। আদালতে শাহজাদী বেগমের পক্ষে আইনজীবীর জামিন আবেদন না থাকায় এবং শুনানী না হওয়ায় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল শাহজাদী বেগমকে। অবশেষে শাহজাদী বেগমের জামিন হয়েছে।

শাহজাদী বেগমের দোষ উনি হাসপাতালে অন্য এক মায়ের পুত্র সন্তান চুরি করেছেন। শাহজাদীর সংসারে চার কন্যা রয়েছে। আবারো অন্তঃসত্ত্বা হন শাহজাদী। তবে অনাগত সন্তান যেন ছেলে হয় এমন প্রত্যাশা ছিল স্বামী ও তার পরিবারের। যদিও অনাগত সন্তান কন্যা না পুত্র হবে, এটা মায়ের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে বাবার উপর। কিন্তু এই কথা অধিকাংশ মানুষ জানে না, জানলেও মানে না। তাই শাহজাদী বেগমকে কন্যাসন্তান হলে বিয়ে বিচ্ছেদের হুমকি দিয়েছিল স্বামী। এই অবস্থায় সিজারিয়ানের মাধ্যমে শাহজাদীর কন্যা সন্তানের জন্ম দানের সংবাদ শুনেই হাসপাতাল ত্যাগ করে সিরাজুল ইসলাম। পরের দিনগুলোতে সেই বাবা আর হাসপাতালে আসেনি। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও রাখেনি।

স্বামী, পরিবার ও নানামুখী চাপে দিশাহারা শাহজাদী একই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া আরেক নারীর ছেলে সন্তান চুরি করতে বাধ্য হন। তিনি ভেবেছেন এই করে হয়তো তার সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তার স্বামী ও স্বামীর পরিবার এতগুলো কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার দায়ে শাহজাদী বেগমকে গ্রহণ করবে না।

শাহজাদী বেগমের দোষ উনি হাসপাতালে অন্য এক মায়ের পুত্রসন্তান চুরি করেছেন। শাহজাদীর সংসারে চার কন্যা রয়েছে। আবারো অন্তঃসত্ত্বা হন শাহজাদী। তবে অনাগত সন্তান যেন ছেলে হয় এমন প্রত্যাশা ছিল স্বামী ও তার পরিবারের। যদিও অনাগত সন্তান কন্যা না পুত্র হবে, এটা মায়ের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে বাবার উপর। কিন্তু এই কথা অধিকাংশ মানুষ জানে না, জানলেও মানে না। তাই শাহজাদী বেগমকে কন্যাসন্তান হলে বিয়ে বিচ্ছেদের হুমকি দিয়েছিল স্বামী।

নিজের সন্তানকে অগ্রাহ্য করে অন্যের ছেলে সন্তান চুরি করার দায় কি একা শাহজাদীর? তার স্বামী, পরিবার ও সমাজ তাকে বাধ্য করেছে এরকম একটি গর্হিত কাজ করতে। অথচ কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার দায় কিন্তু নারীর নয়। এই বৈজ্ঞানিক ধ্রুব সত্যটা এ দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না, মানে না। বিপরীতে নারীর ওপর নেমে আসে খড়্গ হস্ত। একই কারণে মুন্সিগঞ্জে বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ফেলে ছয় মাস বয়সি যমজ দুই শিশু কন্যাকে হত্যা করেছেন মা শান্তা বেগম। বিয়ের প্রায় দুই বছর পর কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ায় স্বামী তা মেনে নিতে না পারেনি। পারিবারিক কলহের জেরে মা নিজেই যমজ শিশু কন্যাকে পুকুরের পানিতে ফেলে হত্যা করেন। এখানেও মা এই অমানবিক কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন স্বামীর অত্যাচারের জের ধরে। এই ঘটনায় মা আসামি ঠিকই কিন্তু স্নেহ মাকে আসামি হতে বাধ্য করছে কে বা কারা? তাদের কোনো দায় থাকে না, থাকে না কোনো জবাবদিহিতা। কন্যাসন্তান হওয়ার কারণে মাকে যে উপর্যুপরি নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, মানসিকভাবে ট্রমাটাইজড করা হচ্ছে, এর কোনো বিচার নেই।

মেয়ে সন্তানের জন্ম যে অনেক পরিবারেই কাক্সিক্ষত নয়, তা আমরা জানি। শুধু গ্রামে নয়, শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও পুত্র সন্তানের ব্যাপক চাহিদা। প্রায় সবারই ধারণা ছেলে সন্তান বংশের বাতি, সম্পত্তি রক্ষা করবে ও বাবা-মায়ের দেখাশোনা করবে। আর পরিবারে এই ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার দায়িত্ব নারীর অর্থাৎ মায়ের। ঠিক একইভাবে ‘অপয়া’ কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধ মায়েরই।

বাংলাদেশে যখন এই অবস্থা, সেখানে বিশ্বব্যাপী বাবা-মায়েদের মানসিকতায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঐতিহ্যগতভাবে পুত্রসন্তানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, আর তার জায়গা দখল করছে কন্যাসন্তানের প্রতি আগ্রহ। বিশেষ করে জনসংখ্যায় শীর্ষস্থানীয় দুই দেশ চীন ও ভারতে। একসময় এই দুই দেশে আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিপুলসংখ্যক কন্যাভ্রƒণ গর্ভেই হত্যা করা হতো।

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য টাইমস জানিয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বের অন্তত ২ কোটি কন্যাশিশু জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। তবে এই ধারা পাল্টাতে শুরু করেছে। গবেষণা বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বে কন্যাভ্রূণ গর্ভপাতের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে মাত্র ১ লাখ ৭ হাজারে; যেখানে ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৬ হাজার অর্থাৎ সাত গুণ হ্রাস।

ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ জার্নালের ২০২৩ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ইউরোপের দেশগুলোতেও মনোভাবের এই পরিবর্তন স্পষ্ট। বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্সে দেখা গেছে, প্রথম সন্তান কন্যা হলে অনেক বাবা-মা দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। অর্থাৎ তারা কন্যা সন্তানকেই চূড়ান্ত পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জাপানে যেসব দম্পতি এক সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের ৭৫ শতাংশই কন্যা সন্তান চান- যেখানে ১৯৮২ সালে এই হার ছিল ৫০ শতাংশের নিচে।

এখন মা-বাবা কেন কন্যা সন্তান বেশি পছন্দ করছেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, কন্যা সন্তানদের সাধারণত যত্নশীল, পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনের মতো দেশে অতিরিক্ত ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়ার কারণে বিয়ে ও সামাজিক স্থিতি নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। ব্রিটেনে ছেলেদের মধ্যে বেকারত্ব, অপরাধপ্রবণতা ও শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার কন্যাসন্তানকে ‘নিরাপদ ভবিষ্যৎ’ মনে করছেন। (তথ্যসূত্র : দ্য টাইমস, ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান)।

কুড়িগ্রামের প্রসূতি আছমা বেগমের অভিযোগ ছিল, ‘বিয়ের পর থেকে আমার স্বামী আমাকে নির্যাতন করতো। আমার গর্ভে সন্তান এসেছে, এ খবর জানার পর আরও বেশি নির্যাতন করতো। বলতো, ছেলে হলে সুখ পাবে, আর মেয়ে হলে দুঃখ পাবে। পরে আমার মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। এ সংবাদ পেয়ে আমার স্বামী আমাদের বাড়িতে বালু ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে।

বাংলাদেশে পুরুষ একা নয়, নারীও এই অবৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্বাস করেন এবং নিজেকে দায়ী মনে করেন। অথচ সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে এই প্রক্রিয়াটি নিজের মতো কাজ করে এবং তা বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীদের দায়ী করার কোনো মানে হয় না। সন্তানের লিঙ্গের উপর মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কারণ এটি গর্ভধারণের সময় নির্ধারিত হয়। আর সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে লিঙ্গ নির্বিশেষে, প্রতিটি সন্তান সমানভাবে মূল্যবান।

মাকে দায়ী করার এই প্রবণতা নারীর প্রতি সামাজিক কলঙ্ক আরোপ এবং দুর্ব্যবহারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য অনেক পরিবারে মায়েদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা এবং হয়রানিও করার হয়। এই কারণে মায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার জন্য মাকে দায়ী করা পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত। মাকে দায়ী করার পাশাপাশি এরা কন্যাশিশুর জন্মকেও অস্বীকার করে।

প্রশ্ন উঠে মায়েরা কেন ছেলে সন্তান চাইছেন, কেন মেয়ে সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করছেন? কারণ সমাজের চাপ এবং শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। তারাও মেয়ে সন্তানকে ‘কম লাভজনক’ মনে করছেন। সেইসাথে তারা ভাবছেন মেয়েসন্তান জন্ম দেয়ার দায়ে তারা নির্যাতিত হতে পারেন।

মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে পরিবার যদি জানতে পারে কোন গর্ভবতী নারীর কন্যা হবে, তাহলে সেই নারীর কম যত্ন নেয়া হয়, খাওয়া কম দেওয়া হয়। আর গর্ভে পুত্র সন্তান থাকলে তার যত্ন বেশি নেওয়া হয়। সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। একাধিক কন্যা সন্তানের মায়েরা দুর্ব্যবহার, বিবাহ বিচ্ছেদ বা এমনকি প্রাণ হারানোর ভয়ও করেন।

কন্যা সন্তান জন্মের পর যৌতুকের চাপ বাড়তে পারে। ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে (২০২১) উল্লেখ করা হয়েছিল যে খুলনার একটি গ্রামে একজন মা কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে অতিরিক্ত যৌতুকের জন্য চাপ দিয়েছিল। তারা মনে করতো কন্যাসন্তান পরিবারের জন্য ‘অর্থনৈতিক বোঝা’। এই ধরনের ঘটনা মাকে দায়ী করার পাশাপাশি তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়া কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় মাকে সামাজিক কটূক্তির মুখে পড়তে হয়।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ