প্রত্যাশা ডেস্ক: এখনো খোলা আকাশের নিচে দিনযাপন করছেন ক্ষতিগ্রস্ত কড়াইল বস্তিবাসী। অর্থের অভাবে তুলতে পারছেন না ঘর। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিও এবং ব্যক্তি উদ্যোগে খাদ্য সহায়তা ও ত্রাণ দেওয়া হলেও তা বস্তিবাসীর জন্য অপ্রতুল।
এদিকে, গত ২৫ নভেম্বর লাগা সেই আগুনে ছাই হয়ে গেছে ‘মায়ের দোয়া বিদ্যানিকেতন ও হাইস্কুল’; ফলে থমকে গেছে অন্তত ৪০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান।
গত বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে বস্তিতে গিয়ে সরেজমিনে দেখে একটি সংবাদসংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বৌ-বাজার এলাকার দরিদ্র সন্তানদের এক দশকের বেশি সময় ধরে আলো ছড়ানো স্কুলটির পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। স্কুল ভবনের নিচতলায় রয়েছে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের বসার কক্ষ। সেখানে বসে ছিলেন দুই জন শিক্ষক। তাদের পাশেই বসা ছিলেন প্রধান শিক্ষক মো. মনির হোসেন।
কথা হলে তিনি বলেন, ‘তিনতলা বিশিষ্ট স্কুল ভবনের তিনতলায় ছিল স্টোর রুম। সেইসঙ্গে ছিল চারটি শ্রেণিকক্ষ। ভয়াবহ আগুনে ওপরের অংশে থাকা চেয়ার-টেবিল ও বই-খাতাসহ সবটাই পুড়ে গেছে। এছাড়া স্কুল ভবনের দেয়ালেও দেখা দিয়েছে ফাটল। ফলে ভবনটির সংস্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু টাকার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ‘বস্তির বাসিন্দাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে আমার উদ্যোগে এই স্কুলটি পরিচালিত হচ্ছে ২০১২ সাল থেকে। এই স্কুলের পড়াশোনার মাধ্যমেই বস্তির অন্তত কিছু ছেলে-মেয়ে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে প্লে থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত চলছে পাঠদান। এছাড়া রয়েছে নাইট শিফটও। যারা দিনের বেলা কাজ করেন, তারা এখানে নাইট শিফটে পড়ার সুযোগ পান।’
প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুলে অধ্যয়নের জন্য বেতন নেওয়া হচ্ছে শ্রেণি ভেদে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। সেইসঙ্গে ১২০ জন শিক্ষার্থীকে ফ্রিতে পড়ানো হচ্ছে। তাদের বই-খাতাসহ সবকিছুই স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করছে। তিনি বলেন, ‘আগুনে পুড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বছরের ফাইনাল পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। আগুন লাগার পর থানা শিক্ষা অফিসারকে পুরো বিষয়সহ ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’
মনির হোসেন আরো বলেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে বই সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তবে তা খুবই অপ্রতুল।’ এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান নিয়ে তিনি শঙ্কায় আছেন জানিয়ে বলেন, ‘এখান থেকে গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ (১৭ জন পরীক্ষায় অংশ নেন) পাশ করেছে। কিন্তু এরপরও স্কুলটিতে সরকার নজর দিচ্ছে না। করা হয় না কোনো সহযোগিতাও।’
প্রধান শিক্ষক মো. মনির হোসেন আরো বলেন, ‘আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত চেয়ার-টেবিলসহ পুরো ভবন সংস্কার করতে অন্তত ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমার একার পক্ষে বর্তমানে এটা অসম্ভব।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এই বস্তিতে আমারও চারটি ঘর ছিল। ভাড়া দেওয়া ছিল। এগুলো থেকে মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া পেতাম। কিন্তু আগুনে পুড়ে যাওয়ায় এখন সেই আয়ও বন্ধ। পাশাপাশি নতুন করে ঘরগুলো তুলতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার না করেই এসএসসি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই পরীক্ষা। যদিও ২৭ নভেম্বর থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২৭ নভেম্বরের পরীক্ষাটি ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ১০ ডিসেম্বর থেকে অল্প পরিসরে অন্য শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করা হবে।’ মনির হোসেন জানান, এই বস্তিতে আটটি স্কুল রয়েছে। এরমধ্যে সাতটি বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। আরেকটি বিদেশি একটি এনজিওর মাধ্যমে চালানো হচ্ছে। তার রয়েছে দুটি স্কুল। এর একটি হচ্ছে মায়ের দোয়া বিদ্যানিকেতন হাইস্কুল ও অন্যটি মাতৃছায়া জিনিয়াস হাই স্কুল। অন্য স্কুলগুলো অক্ষত রয়েছে।’
খোলা আকাশের নিচে ক্ষতিগ্রস্তরা: কড়াইল বস্তির বৌ-বাজার ইউনিটের আগুন পাঁচদিন দিন আগে নিভলেও তাপ এখনো স্পষ্ট দুই হাজারের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে। সব হারিয়ে অসহায় তারা। খোলা আকাশের নিচে করছেন বসবাস। কেউ কেউ আবার পরিচিতজনদের বাসায় আবার কেউবা অবস্থান করছেন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। যেখানে একসময় ছিল রঙিন টিনের ছাপরা, আধা-পাকা দোতলা ঘর। এখন সেখানে ছাই, পোড়া বাঁশ আর মানুষের আর্তনাদ। ঘরগুলো এখন এক টুকরো স্মৃতিও নেই।
বস্তির ‘খ’ ব্লকের বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন জানান, তিনি ব্লাড ক্যান্সারের রোগী। কাজ করতে পারেন না। স্ত্রী সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। আগুনে অন্য বস্তিবাসীর মতো তার ঘরটিও পুড়ে গেছে। সেইসঙ্গে পুড়েছে ঘরে থাকা আয়ের একমাত্র সম্বল সেলাই মেশিনসহ অন্য আসবাবপত্রও। সব হারানোর পর এখন তার সম্বল শুধু পরনের কাপড়টুকুই। বস্তির অপর বাসিন্দা শ্যামলী বেগম জানান, পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই বাঁচাতে পারেননি তিনি। চোখের সামনেই সবকিছু পুড়ে গেছে। তারা অন্যদের পাশে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন।
পুড়ে যাওয়া বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, আগুনে জীবনের ভিত্তিমূল ও সঞ্চয় হারিয়ে মানুষজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছেন। মাথার ওপরে টাঙিয়েছেন কাপড় বা ত্রিপল। কেউ ফুটপাতের ধার ধরে বিছানা পেতে আছেন, কেউ আবার খালি ভিটায় মাদুর পেতে অস্থায়ী আশ্রয় নিয়েছেন। পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর ছাইগুলো শুধু সরেছে। বস্তির পাশের ড্রেনগুলো পোড়া আবর্জনায় ভরে গেছে। পরিষ্কার করা হয়নি এখনো। এতে দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
গত মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ২২ মিনিটের দিকে কড়াইল বস্তির বউবাজার ইউনিটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট ১৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, আগুনে দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে ঢাকা জেলা প্রশাসন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ তালিকায় সংখ্যাটি দুই হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিটি পরিবার মানে অন্তত পাঁচ থেকে সাতজন মানুষ। সেই হিসাবে এই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ থেকে ১৪ হাজার মানুষ। তারা সকলেই বর্তমানে আশ্রয়হীন।
বস্তিবাসীর অভিযোগ, বউবাজার ‘ক’ ব্লকের মিন্টু মিয়ার বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। তিনি ভাড়া দিতেন স্থানীয় কিছু পরিবারকে। বৃহস্পতিবার বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, বস্তির ‘খ’ ব্লকের মাঝামাঝি অংশে ওপরে চাদর ও নিচে মাদুর বিছিয়ে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বসে আছেন বাসিন্দা আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, যেখানে বসে আছেন, সেখানেই ছিল তার ছয়টি রুম। এখান থেকে পাওয়া ভাড়ায় চলতো তার পরিবার। আগুনে সব পুড়ে যাওয়ায় একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। বর্তমানে পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই তার।
কোনো সাহায্য পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়ত খাবার পাচ্ছি। এছাড়া কম্বল পেয়েছি। আর কিছুই পাইনি এখন পর্যন্ত।’ সাইফুল ইসলাম নামের আরেকজন জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে বস্তিতে ভাড়া থাকেন। আগুনে সব পুড়ে যাওয়ায় স্ত্রী ও ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে খোলা আকাশই হচ্ছে তার মাথার ছাদ।
ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের অভিযোগ, অনেকে ১-২ দিনেও কোনো সংস্থার খাবার পাননি। আবার অনেকেই পেয়েছেন- কিন্তু পরিমাণে তা নগণ্য। এদিকে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় তৈরি হয়েছে পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি। এবারের আগুনে ঘর হারানো মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, ব্যক্তি উদ্যোগ বা সংগঠনের আনা সহায়তা সঠিকভাবে বণ্টন করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সহযোগিতা: বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেছে, বস্তিতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। খাবার বিতরণকারীদের একজন বলেন, ‘সেনাবাহিনীর উদ্যোগে গত পাঁচ দিন ধরে খাবার দেওয়া হচ্ছে। সকালে সিঙ্গারা, দুপুরে ভাত-মাছ ও রাতে ভাত-মাংস দেওয়া হচ্ছে। একমাস এভাবে খাবার বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাসেল সরওয়ার বলেন, ‘আগুন নির্বাপণের পর খোলা আকাশের নিচে থাকায় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে পুলিশ। দিন ও রাতে পালাক্রমে পুলিশ সদস্যরা সেখানে নিরাপত্তা দিচ্ছেন।
সানা/ওআ/আপ্র/০৫/১২/২০২৫



















