বাণিজ্য ডেস্ক : গত সপ্তাহে দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই দরপতন হয়েছে। সপ্তাহজুড়ে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেওয়া যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে, দাম কমেছে তার দ্বিগুণের বেশি প্রতিষ্ঠানের। অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের দাম কমায় মূল্যসূচকের পতন হয়েছে। একই সঙ্গে কমেছে বাজার মূলধন।
তবে কিছুটা বেড়েছে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ। গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১০৯টির স্থান হয়েছে দাম বাড়ার তালিকায়। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৩টির। এছাড়া ২৪টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ দাম বাড়ার তালিকার তুলনায় দাম কমার তালিকায় দ্বিগুণের বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে বাজার মূলধনের বেশ বড় পতন হয়েছে।
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে যা ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ৩ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৫১ শতাংশ। আগের সপ্তাহে বাজার মূলধন কমে ২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।
অর্থাৎ দুই সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমলো ৬ হাজার ১১ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার পাশপাশি গত সপ্তাহে কমেছে মূল্যসূচক। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স গত সপ্তাহে কমেছে ৬০ দশমিক ৫১ পয়েন্ট বা এক দশমিক ১৬ শতাংশ। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ৫ দশমিক ১৯ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি গত সপ্তাহে কমেছে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক। গত সপ্তাহে সূচকটি কমেছে ৩০ পয়েন্ট বা এক দশমিক ৫৬ শতাংশ।
আগের সপ্তাহের সূচকটি ৬ দশমিক ৭০ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ কমে। প্রধান ও ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত সূচক কমার পাশাপাশি কমেছে ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ সূচক। গত সপ্তাহজুড়ে এই সূচকটি কমেছে ১১ দশমিক ৩০ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। আগের সপ্তাহের সূচকটি বাড়ে ৬ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। সবকয়টি মূল্যসূচক কমলেও ডিএসইতে লেনদেনের গতি বেড়েছে। গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৩৭৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৩৪৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন বেড়েছে ৩১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে ফাইন ফুডসের শেয়ার। কোম্পানিটির শেয়ার প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা খান ব্রদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের শেয়ার প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ১২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতিদিন গড়ে ১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে গ্রামীণফোন। এছাড়া লেনদেনের শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ওরিয়ন ইনফিউশন, মিডল্যান্ড ব্যাংক, আফতাব অটোমোবাইল, মুন্নু ফেব্রিক্স, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং ওয়াইম্যাক্স ইলেকট্রোড।
মন্দা বাজারে ‘পচা’ শেয়ারের দাপট
গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই দেশের শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। এতে সপ্তাহজুড়েই দাম কমার তালিকায় নাম লিখিয়েছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। এমন পতনের বাজারে দাম বাড়ার ক্ষেত্রে দাপট দেখিয়েছে বছরের পর বছর লভ্যাংশ না দিয়ে ‘জেড’ গ্রুপ বা পচা কোম্পানির তালিকায় স্থান করে নেওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দাম বাড়ার শীর্ষ ১০টি স্থানের ৬টিই রয়েছে জেড গ্রুপের দেখলে।
এর মধ্যে রয়েছে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, সেন্ট্রাল ফার্মা, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইয়াকিন পলিমার, নিউ লাইন ক্লোথিং এবং ঢাকা ডাইং। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে পচা কোম্পানি দাপট দেখালেও সার্বিক শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। সপ্তাহজুড়ে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে ১০৯ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৩টির। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৬০ দশমিক ৫১ পয়েন্ট বা এক দশমিক ১৬ শতাংশ।
এমন পতনের বাজারে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের শীর্ষে ছিল খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। সপ্তাহজুড়ে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির বিপুল সংখ্যক শেয়ার কেনার আদেশ দেন। বিপরীতে যাদের কাছে কোম্পানিটির শেয়ার আছে তারা বিক্রি করতে চাননি। ফলে সপ্তাহজুড়েই দাম বেড়েছে এবং ডিএসইতে দাম বাড়ার শীর্ষস্থান দখল করেছে লোকসানে নিমজ্জিত হয়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারা এই কোম্পানি। গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
টাকার অঙ্কে প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩ টাকা ৮০ পয়সা। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ১০ পয়সা। যা আগের সপ্তাহের শেষে ছিল ১৩ টাকা ৩০ পয়সা। এতে এক সপ্তাহে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম সম্মিলিতভাবে বেড়েছে ২৭ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা। শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি ২০১৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালে এক শতাংশ নগদ এবং ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। ২০২০ সালের পর বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিতে না পারায় শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির স্থান হয়েছে পঁচা ‘জেড’ গ্রুপে। এমনকি কোম্পানিটি নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে না। সর্বশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান করে ১১ পয়সা।
বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারা এবং নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করা এই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছে ডিএসই। ডিএসই থেকে জনানো হয়েছে, শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটিকে নোটিন পাঠানো হয়। তবে সেই নোটিশের জবাব দেয়নি তারা।
২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডিএসই থেকে কোম্পানিটির প্রধান কার্যলয় পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে ডিএসইর প্রতিনিধিদল দেখতে পায়, কোম্পানিটির কার্যক্রম এবং উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই তথ্যটি প্রকাশ করেও বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছে ডিএসই। এরপরও শেয়ারের দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে উদ্যোক্তার কাছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
বাকি শেয়ারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশই আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে এক দশমিক ১১ শতাংশ শেয়ার। খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের পরে গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের তালিকায় ছিল সিভিও পেট্রোকেমিক্যালের শেয়ার। সপ্তাহজুড়ে এই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ১৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ দাম বাড়ার মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে জেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ফার্মা।
এছাড়া গত সপ্তাহে দাম বাড়ার শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা- মুন্নু সিরামিকের ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৪ দশমিক ৯১ শতাংশ, ইয়াকিন পলিমারের ১৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ, নিউ লাইফ ক্লোথিংয়ের ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ঢাকা ডাইংয়ের ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।-