নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারের দেড় দশকের অনিয়ম শনাক্তে ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন ব্রোকারদের নেতা সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, “২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত পুঁজিবাজারে কোন কোন অনিয়ম হয়েছে- তার একটা খতিয়ান থাকা উচিত। পুঁজিবাজারেও ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা উচিত।
“ যে পরিমাণ জালিয়াতি বা জুলুম হয়েছে, তার বিষয়ে জানি না। এগুলো ডকুমেন্টেড করা দরকার।’’ গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা ক্লাবে পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে আয়োজিত ‘সংবাদ সম্মেলনে’ তিনি এ কথা বলেন। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ আয়োজিত এ অনুষ্ঠান মোটাদাগে মতবিনিময় সভায় রূপ নেয়।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতে সংস্কারের উদ্যোগে ব্যাংকসহ সব খাতেই ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি খাতগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে। “আগামীতে কী করতে হবে, তার একটি ধারণা ওইসব তথ্য থেকে পাওয়া যাবে।
সংস্কারের পরেও নতুন করে এসব সমস্যা যাতে না আসে, তার জন্য হলেও এই কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।’’ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তার পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করে বাজারের উন্নয়নে কাজ করবে-এমন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “এখন কমিশন মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করে কাজ করছে। যেকোনো বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই বলে দেওয়া হয়, ‘ওমুক মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখবে’। অথচ কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।” ঢাকা স্টক একচেঞ্জের বিভিন্ন বিভাগের সমস্যা এবং করণীয় নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেন সংস্থার চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “অতীতে অনেক কিছু রেগুলেটরের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি করতে গিয়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে, অনেক সময় বাজারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
“আমরা বাজারে হস্তক্ষেপ করছি না, করব না। বাজার বাজারের মত চলবে। বিনিয়োগকারীদের আচরণের সঙ্গে বাজার চলবে।” দেড় দশকে পুঁজিবাজারে সুশাসন তলানিতে ঠেকেছে মনে করেন মমিনুল ইসলাম। পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির শেয়ারদরে সর্বনিম্ন সীমা বা ফ্লোর প্রাইস বসানোকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বর্ণনা করে তিনি বলেন, “মার্কেটের বেসিক ফ্রেবিকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
এত পরিমাণ অনিয়ম হয়েছে যে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। এত সক্ষমতাও এখন নেই আমাদের।” পরিস্থিতির উত্তরণে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে ডিএসই তার পরিকল্পনা তুলে ধরবে বলে জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন পর্যালোচনা করা হচ্ছ। বিনিয়োগ ও বাজারবান্ধব করতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। একইসঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের নীতিমালা সংশোধন, বাজার পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন ডিএসই চেয়ারম্যান।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ পুঁজিবাজারবান্ধব বর্ণনা করে মমিনুল বলেন, আগামী বাজেটে কর ছাড়সহ পুঁজিবাজারের জন্য বেশ কিছু সুবিধা আসবে।
দুই স্টক এক্সচেঞ্জ একীভূত নিয়ে আলোচনা
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের একীভূত করার পক্ষে অনুষ্ঠানে যুক্তি তুলে ধরেন ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল। তিনি বলেন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্সের মতো দেশে একটি স্টক এক্সচেঞ্জ রয়েছে।
বাংলাদেশের মতো অগভীর বাজারে দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ থাকার যৌক্তিকতা নেই মন্তব্য করে মমিনুল বলেন, “দুটিকে একটি করলে বেশি ইফিসিয়েন্টে হয় কি না- তা আমরা দেখব। তাদের (সিএসই) সঙ্গে আলোচনা করে দেখা যাক।”
এই প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান বলেন, “গত অক্টোবরে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অদৃশ্য কোনো চাপের দেখা এখনো পাইনি। পুঁজিবাজার উন্নয়নে সবাকেই সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই।’’ তিনি বলেন, “দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনলাইন স্টক এক্সচেঞ্জ হচ্ছে সিএসই। চট্টগ্রাম এক্সচেঞ্জে যে পরিমাণ লেনদেন হয় তা ডিএসইর মাত্র ৪ শতাংশ। “আমরা বুঝেছি, প্রচলিত কোনো পণ্য দিয়ে সিএসই এগিয়ে যেতে পারবে না। আমরা কমোডিটি মার্কেট দিয়ে এগিয়ে যাব, কমোডিটি মার্কেট চালু হয়েছে। এখন বাজার এগিয়ে যাবে।’’
জুলাইয়ের মধ্যে ‘ডিআর’
২০২৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন সফটওয়্যারে বড় ধরনের বিভ্রাট দেখা দেয়। সবশেষ গত ৫ জানুয়ারি লেনদেন দেড় ঘণ্টা পরে শুরু হয়। ডিএসইর সফটওয়্যার হালনাগাদ ও ব্যাকআপ রাখতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে ডিজাস্টার রিকভারি বা ডিআর সার্ভার চালুর পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান মমিনুল। স্বাভাবিক লেনদেনের সব তথ্য পৃথকভাবে সংরক্ষণ করে থাকে ডিআর সার্ভার। কখনো মূল সার্ভারে কারিগরি সমস্যা দেখা দিলে ব্যাকআপ সার্ভার হিসেবে কাজ করা রিকভারি সার্ভার ব্যবহার করে লেনদেন সচল রাখা সম্ভব। গত অক্টোবরে ডিএসই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া মমিনুল ইসলাম বলেন, “ডিএসইতে পর্ষদ সদস্যরা মিলে ভোটের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে। আমরা প্রভাবমুক্ত, আমরা চেষ্টা করব- বাজারকে ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে।’’ অতীতের কারসাজির সঙ্গে জড়িত ডিএসই কর্মকর্তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন প্রশ্নে মমিনুল বলেন, “আমরা নদীর মাঝখানে এসে জানতে পারছি, নৌকার মাঝি দুর্নীতিগ্রস্ত।
তাকে তো নৌকা থেকে নামিয়ে দিতে পারব না এখন। তীরে নিয়ে গিয়ে বিচার করা হবে।” ডিএসই কর্মকর্তাদের ইনসাইডার ট্রেডিং ঠেকাতে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আগে তাদের জবাবদিহিতা ছিল না। এখন দেখা হবে কার দায় কতোটুকু ছিল। “তবে হুট করেই নয়। একটি প্রসেস ফলো (প্রক্রিয়া অনুসরণ) করে বিচার করা হবে।” প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ডিএসইতে গত ১০ বছরে ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে উল্লেখ করে ডিএসইর শেয়ারধারী পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, “এর বেশিরভাগ কোম্পানির অবস্থা খারাপ।
” দুর্নীতির মাধ্যমে এসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “গত ১০ বছরে যেসব আইপিও এসেছে, তার উপর একটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। একটা মূল্যায়ন থাকা দরকার আসলে কী হয়েছে।
’’ ডিএসইর বর্তমান পর্ষদ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রভাবমুক্ত মন্তব্য করে মিনহাজ মান্নান বলেন, “এই বোর্ড আগারগাঁও প্রভাবমুক্ত। আগের কমিশন ৬০টি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিয়ে জঞ্জালে পরিণত করেছে। তাদের অনেকেই এখন কাজ করতে পারছে না।”