ঢাকা ০৫:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

পিকনিকে গিয়ে লাশ ওরা ১১ জন

  • আপডেট সময় : ০৯:০২:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ জুলাই ২০২২
  • ৮৩ বার পড়া হয়েছে

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন ১১ জন। তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারের উদ্যোগে চাঁদা তুলে খৈয়াছড়া ঝরনায় পিকনিক করতে গিয়েছিলেন তারা।
গতকাল শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে মীরসরাইয়ের বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস। এতে ১১ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও পাঁচ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ১৬ জন শুক্রবার সকাল ৮টায় হাটহাজারীর আমান বাজার থেকে মাইক্রোবাসযোগে খৈয়াছড়া ঝরনায় ঘুরতে যান। ঘোরাঘুরি শেষে ফেরার পথে দুপুর পৌনে ২টার দিকে বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেন। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচ জন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী কাজী এম সাজিদ বলেন, ‘আমান বাজার এলাকার যুগিরহাটে আমাদের কোচিং সেন্টারটি অবস্থিত। কোচিং সেন্টারের ১৬ শিক্ষক-শিক্ষার্থী খৈয়াছড়া ঝরনাসহ মীরসরাইয়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র দেখতে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তুলেছিলেন। এর মধ্যে চার জন শিক্ষক ছিলেন। তারা হলেন জিসান, রিদুয়ান, সজিব ও রাকিব। বাকিরা শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছয় জন এসএসসি পরীক্ষার্থী বাকি চার জন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। একজন মাইক্রোবাসের চালক অপরজনের পরিচয় আমার জানা নেই। ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন। পাঁচ জন আহত হয়েছেন।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে বলছেন, লেভেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়া মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেন।
মীরসরাইয়ের বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস কাজী এম সাজিদ আরও বলেন, ‘পিকনিকে আমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ আমার ফুটবল ম্যাচ থাকায় যাওয়া হয়নি।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল কর্মকর্তা নিবেদিতা ঘোষ বলেন, ‘মীরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত পাঁচ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চার জন এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে এক জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
এদিকে, নিহতদের মধ্যে চার জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন হাটহাজারী উপজেলার জিয়াউর রহমান কলেজের শিক্ষার্থী আমান বাজার এলাকার শিকারপুর মোশাররফ আলী বাড়ির মো. মহিউদ্দিন মনসুরের ছেলে মো. মাহিন (১৮), একই এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে তানভীর হাসান (১৮), একই এলাকার জুনায়েদ হোসেন (১৮) ও মাইক্রোবাসচালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৮)। তিনি হাটহাজারীর চিকনদন্ডী ইউনিয়নের সাব রেজিস্ট্রার বাড়ির হাজী মো. ইউসুফ আলীর ছেলে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. হাসান চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। আরও পাঁচ যাত্রী আহত হয়েছেন। উদ্ধার তৎপরতা শেষ করেছে ফায়ার সার্ভিস। ধাক্কা দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার মাইক্রোবাসটি নিয়ে গেছে ট্রেনটি। সেটি উদ্ধার করা হয়েছে।’
ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। পাঁচ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। এতে ১৬ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন।’
চমেক হাসপাতালে নিহত ১১ জনের স্বজনদের আর্তনাদ : মিরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। কারও মা-বাবা, কারও ভাই এবং কারও বন্ধু-স্বজনদের কান্না-আর্তনাদে হাসপাতাল এলাকায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিহতরা সবাই হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকার বাসিন্দা। মাইক্রোবাসচালক ছাড়া বাকিরা ওই এলাকার যুগিপাড়ায় অবস্থিত আর অ্যান্ড কোচিং সেন্টারের ছাত্র ও শিক্ষক।
নিহত জিয়াউল হক সজীবের বাবা আবদুল হামিদ বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সজীবসহ তিন বন্ধু মিলে এ কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। চার মাস আগে এ কোচিং সেন্টার করে তারা। এখনও ওই টাকা পরিশোধ করা হয়নি। সজীব সকাল সাড়ে ৭টায় পিকনিকে যায়। সে সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। ছেলে আমার থেকে দোয়া নিয়ে গেছে। দুপুর ২টার দিকে খবর আসে তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে।’ ছেলের জন্য বিলাপ করতে করতে এই বাবা বলেন, ‘আমি মুদির দোকানে চাকরি করি। আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সজীব সবার বড়। সজীব ওমরগনি কলেজে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর অনার্সে ভর্তি করা হয়। এখনও অনার্স শেষ হয়নি। অভাবের কারণে তাকে লেখাপড়ার খরচ দিকে পারিনি। আমার ছেলে টিউশনি করতো।’ হাসপাতালে বাবার সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন, জিয়াউল হক সজীবের ছোট ভাই তৌসিফ।
এ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোছহাব আহমেদ হিসাম নামে এক ছাত্র। হিসাম ওই কোচিং সেন্টারের ছাত্র। হাটহাজারী উপজেলার কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল সে। তার মৃত্যুতে হাসপাতাল এলাকায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বজনরা। বাবার মৃত্যুর পর হিসাম চাচা মানিকের কাছে থেকে বড় হয়েছেন। চাচা মানিক বলেন, ‘আমি তার মাকে কী জবাব দেবো?’
নিহত মাহিনের চাচা আলাউদ্দিন টিপু বলেন, ‘সকালে বন্ধু ও শিক্ষকরা মিলে মাইক্রোবাসে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যায়। ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মাহিনসহ ১১ জন মারা যান। তাদের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি : চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাস আরোহী ১১ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলীকে। শুক্রবার দুপুরের দুর্ঘটনার পর এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটির প্রধান ও বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলী বলেন, এ ঘটনা কেন ঘটেছে এবং কার দায় রয়েছে, তা জানতে কমিটি কাজ করবে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন রেলের বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল হামিদ, বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। অন্য দুই কর্মকর্তার নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
গেটম্যান সাদ্দাম আটক : মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জনের নিহতের ঘটনায় ওই রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দীন এ খবর নিশ্চিত করেছেন। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ট্রেন আসার সিগন্যাল পেয়ে ওই ক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দাম বাঁশ ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। সেই বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়। এমনকি গেটম্যান লাল পতাকা উড়িয়ে মাইক্রোবাসচালককে থামার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শী মফিজুল হকসহ কয়েকজন ভিন্ন তথ্য জানান। তারা দাবি করেন, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান সাদ্দাম সেখানে ছিলেন না। তিনি জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। বাঁশ ফেলে ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড করা হয়নি বলে দাবি তাদের।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

পিকনিকে গিয়ে লাশ ওরা ১১ জন

আপডেট সময় : ০৯:০২:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ জুলাই ২০২২

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন ১১ জন। তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারের উদ্যোগে চাঁদা তুলে খৈয়াছড়া ঝরনায় পিকনিক করতে গিয়েছিলেন তারা।
গতকাল শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে মীরসরাইয়ের বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস। এতে ১১ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও পাঁচ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ১৬ জন শুক্রবার সকাল ৮টায় হাটহাজারীর আমান বাজার থেকে মাইক্রোবাসযোগে খৈয়াছড়া ঝরনায় ঘুরতে যান। ঘোরাঘুরি শেষে ফেরার পথে দুপুর পৌনে ২টার দিকে বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেন। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচ জন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী কাজী এম সাজিদ বলেন, ‘আমান বাজার এলাকার যুগিরহাটে আমাদের কোচিং সেন্টারটি অবস্থিত। কোচিং সেন্টারের ১৬ শিক্ষক-শিক্ষার্থী খৈয়াছড়া ঝরনাসহ মীরসরাইয়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র দেখতে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তুলেছিলেন। এর মধ্যে চার জন শিক্ষক ছিলেন। তারা হলেন জিসান, রিদুয়ান, সজিব ও রাকিব। বাকিরা শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছয় জন এসএসসি পরীক্ষার্থী বাকি চার জন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। একজন মাইক্রোবাসের চালক অপরজনের পরিচয় আমার জানা নেই। ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন। পাঁচ জন আহত হয়েছেন।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে বলছেন, লেভেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়া মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেন।
মীরসরাইয়ের বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস কাজী এম সাজিদ আরও বলেন, ‘পিকনিকে আমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ আমার ফুটবল ম্যাচ থাকায় যাওয়া হয়নি।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল কর্মকর্তা নিবেদিতা ঘোষ বলেন, ‘মীরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত পাঁচ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চার জন এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে এক জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
এদিকে, নিহতদের মধ্যে চার জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন হাটহাজারী উপজেলার জিয়াউর রহমান কলেজের শিক্ষার্থী আমান বাজার এলাকার শিকারপুর মোশাররফ আলী বাড়ির মো. মহিউদ্দিন মনসুরের ছেলে মো. মাহিন (১৮), একই এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে তানভীর হাসান (১৮), একই এলাকার জুনায়েদ হোসেন (১৮) ও মাইক্রোবাসচালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৮)। তিনি হাটহাজারীর চিকনদন্ডী ইউনিয়নের সাব রেজিস্ট্রার বাড়ির হাজী মো. ইউসুফ আলীর ছেলে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. হাসান চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। আরও পাঁচ যাত্রী আহত হয়েছেন। উদ্ধার তৎপরতা শেষ করেছে ফায়ার সার্ভিস। ধাক্কা দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার মাইক্রোবাসটি নিয়ে গেছে ট্রেনটি। সেটি উদ্ধার করা হয়েছে।’
ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। পাঁচ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। এতে ১৬ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন।’
চমেক হাসপাতালে নিহত ১১ জনের স্বজনদের আর্তনাদ : মিরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। কারও মা-বাবা, কারও ভাই এবং কারও বন্ধু-স্বজনদের কান্না-আর্তনাদে হাসপাতাল এলাকায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিহতরা সবাই হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকার বাসিন্দা। মাইক্রোবাসচালক ছাড়া বাকিরা ওই এলাকার যুগিপাড়ায় অবস্থিত আর অ্যান্ড কোচিং সেন্টারের ছাত্র ও শিক্ষক।
নিহত জিয়াউল হক সজীবের বাবা আবদুল হামিদ বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সজীবসহ তিন বন্ধু মিলে এ কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। চার মাস আগে এ কোচিং সেন্টার করে তারা। এখনও ওই টাকা পরিশোধ করা হয়নি। সজীব সকাল সাড়ে ৭টায় পিকনিকে যায়। সে সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। ছেলে আমার থেকে দোয়া নিয়ে গেছে। দুপুর ২টার দিকে খবর আসে তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে।’ ছেলের জন্য বিলাপ করতে করতে এই বাবা বলেন, ‘আমি মুদির দোকানে চাকরি করি। আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সজীব সবার বড়। সজীব ওমরগনি কলেজে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর অনার্সে ভর্তি করা হয়। এখনও অনার্স শেষ হয়নি। অভাবের কারণে তাকে লেখাপড়ার খরচ দিকে পারিনি। আমার ছেলে টিউশনি করতো।’ হাসপাতালে বাবার সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন, জিয়াউল হক সজীবের ছোট ভাই তৌসিফ।
এ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোছহাব আহমেদ হিসাম নামে এক ছাত্র। হিসাম ওই কোচিং সেন্টারের ছাত্র। হাটহাজারী উপজেলার কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল সে। তার মৃত্যুতে হাসপাতাল এলাকায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বজনরা। বাবার মৃত্যুর পর হিসাম চাচা মানিকের কাছে থেকে বড় হয়েছেন। চাচা মানিক বলেন, ‘আমি তার মাকে কী জবাব দেবো?’
নিহত মাহিনের চাচা আলাউদ্দিন টিপু বলেন, ‘সকালে বন্ধু ও শিক্ষকরা মিলে মাইক্রোবাসে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যায়। ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মাহিনসহ ১১ জন মারা যান। তাদের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি : চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাস আরোহী ১১ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলীকে। শুক্রবার দুপুরের দুর্ঘটনার পর এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটির প্রধান ও বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলী বলেন, এ ঘটনা কেন ঘটেছে এবং কার দায় রয়েছে, তা জানতে কমিটি কাজ করবে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন রেলের বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল হামিদ, বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। অন্য দুই কর্মকর্তার নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
গেটম্যান সাদ্দাম আটক : মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জনের নিহতের ঘটনায় ওই রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দীন এ খবর নিশ্চিত করেছেন। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ট্রেন আসার সিগন্যাল পেয়ে ওই ক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দাম বাঁশ ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। সেই বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়। এমনকি গেটম্যান লাল পতাকা উড়িয়ে মাইক্রোবাসচালককে থামার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শী মফিজুল হকসহ কয়েকজন ভিন্ন তথ্য জানান। তারা দাবি করেন, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান সাদ্দাম সেখানে ছিলেন না। তিনি জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। বাঁশ ফেলে ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড করা হয়নি বলে দাবি তাদের।