ঢাকা ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫

পাহাড়ের বিদ্রোহ: ‘একমাত্র উপায়’ মিথের আড়ালে

  • আপডেট সময় : ০৬:২৮:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

জিএম আহমেদ

পাহাড়কে প্রথম দেখায় প্রশান্তির প্রতিচ্ছবি মনে হতে পারে; যেন অপার সৌন্দর্য আর অনাদি স্থিতির প্রতীক। তাই বলে পাহাড়ের শান্ত নীরবতা সব সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ইঙ্গিত দেয় না। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এর জীবন্ত উদাহরণ। এখানে জমে আছে দীর্ঘ টানাপড়েন আর অশান্তির ইতিহাস। এই ইতিহাস শুধু জমি বা রাজনীতির কাহিনি নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশার গল্প, অধিকার খোঁজার লড়াই আর ভাঙা-গড়া স্বপ্নের নিত্যপথচলা। এরই মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচিত অধ্যায় হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহ। তাদের দাবি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়েছিল অস্ত্র ধরতে। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর বাইরেও পাহাড় ও সমতলের আপামর জনগণের অনেকের কণ্ঠে এই দাবি প্রায়ই অনুরণিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দাবির রূঢ় সত্যতা কতটা? পাহাড়ের সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রকৃত শুরুটা কোথায়?

ইতিহাসের পাতায় তাকালেই বোঝা যায়, মূল গল্পটা অনেক বেশি জটিল। এটা কেবল সাদা-কালো নয়; বরং নানা স্তর, নানা ব্যাখ্যা আর এক গভীর বাস্তবতার মিশ্রণ।

সত্যিই কি সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল শেষ বিকল্প: সন্তু লারমা, পিসিজেএসএসের বর্তমান সভাপতি ও শান্তি বাহিনীর সাবেক ফিল্ড কম্যান্ডার একাধিকবার বলেছেন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলনের সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি ৭ জানুয়ারি ১৯৭৩ তারিখটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, যেদিন তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ ছাড়া পিসিজেএসএসের ওয়েবসাইটে এখনো দাবি করা হচ্ছে যে, শান্তিপূর্ণ পথ শেষ হলে অস্ত্রই ছিল ‘একমাত্র উপায়’ তাদের জনগণকে রক্ষা করার। কিন্তু এই দাবির পেছনে কি সব কিছু সত্যিই সংগতিপূর্ণ? বাংলাদেশের এই পাহাড়ি অঞ্চলে কি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পথ সত্যিই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? হয়তো না।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ ও খোলাখুলি আলোচনা করতে পারতেন এবং তা করেছিলেনও। অন্যদিকে, এমনকি সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার পরেও কোনো সরকারই এই অঞ্চলে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেনি। এই প্রেক্ষাপটের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়। কেননা পিসিজেএসএস নিজেই নিয়মিত এর সব কার্যক্রম যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছিল। আর কিছু না হলেও এটুকু স্পষ্ট যে অন্তত ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়গুলো সংগঠনগুলোর জন্য পুরোপুরি অবারিত ছিল। এক্ষেত্রে ‘শান্তি বাহিনী’ গঠন করা কি সত্যিই বিকল্প হিসেবে যুক্তিসঙ্গত ছিল?

এমএন লারমা ওই সশস্ত্র বিদ্রোহের মূল স্থপতি ছিলেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্বেচ্ছায় বাকশালে যোগ দেন। তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তিনি পাহাড়ের গুমোট পরিবেশে শান্তির সুবাতাস বইবে বলে আশাবাদী ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রকাশ্যে সরকারি দলে যোগ দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা প্রকাশ করার পাশাপাশি গোপনে সশস্ত্র কার্যক্রম চালানো নিঃসন্দেহে এক পরস্পরবিরোধী অবস্থান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, সশস্ত্র বিদ্রোহ ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যা একদিকে অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয় এবং অন্যদিকে ‘শেষ আশ্রয়’ বা ‘একমাত্র উপায়’ থেকে প্রত্যাশিত ধীর, ক্রমান্বয়ে শুরুর ধারণার বিরোধী। তাই ‘গণতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক স্থান না থাকায় অস্ত্রধারণ’ তত্ত্বটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। এক্ষেত্রে প্রশ্নটা রয়েই যায়- আসলে শান্তিপূর্ণ পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, নাকি অস্ত্রধারণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত?

শিকড়ের গভীরে কাপ্তাই বাঁধ- ক্ষোভের শুরু এবং রাজনৈতিক জাগরণ: পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহের শিকড় খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে পাকিস্তান আমলে, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে। তখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। কিন্তু এই বাঁধের ফলে পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক মানুষ বাস্তুচ্যুত; তলিয়ে যায় তাদের চাষাবাদের জমি ও বসতভিটা। যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় সৃষ্টি হয়, হতাশা ও ক্ষোভ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে সরকারের শিক্ষা বিস্তারমূলক পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং স্থানীয়দের মনে রাজনৈতিক সচেতনতার উম্মেষ ঘটে। কিন্তু প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব, বিশেষ করে সবচেয়ে প্রভাবশালী চাকমা সার্কেল চিফ জনগণের স্বার্থে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। ফলে জনগণ তাদের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষিত যুবকরা উপলব্ধি করেন, নিজেদেও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কণ্ঠ প্রয়োজন।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তারা গঠন করেন উপজাতীয় কল্যাণ পরিষদ। একই সময়ে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষক সমিতি। যদিও নাম শুনতে সামাজিক বা পেশাজীবী সংগঠনের মতো; এর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ি মানুষের রাজনৈতিক অধিকার অর্জন। খুব শিগগির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এক মাত্রা দেখা দেয় সশস্ত্র পন্থা। কিছু নেতা শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিকে সমর্থন করলেও বামপন্থী ধারার প্রাভাবে অনেকে মনে করতেন, শুধু অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের অধিকার রক্ষা সম্ভব। তাই উপজাতীয় কল্যাণ পরিষদের গঠনকে এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশের সঙ্গে তুলনা করে ভ্যান সেন্দেল (১৯৯২) সুনির্দিষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন যে এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রবক্তাগণ সামনে এসে দাঁড়ায়।

দ্য ব্লাইন্ড স্পট- মার্কসবাদী চিন্তা ও গোপন বিপ্লবী সংগঠনের উত্থান: এরপরের ঘটনা প্রবাহ দ্রুত নানা মাত্রিক মোড় নিতে থাকে। ছয় দফা ও এগারো দফা আন্দোলন, সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা- সবই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঢেউ তোলে; বিশেষ করে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সমর্থন করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার হয়। এই সময় শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এম এন লারমা পাহাড়ি জনগণকে রাজনীতিতে সচেতন ও সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। প্রবীণ নেতৃবৃন্দ বা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহায়তা না পেলেও তিনি হাল ছাড়েননি।

ব্রিটিশ আমল থেকে ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ ঘোষিত থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত অনুপস্থিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ফলে শামন্তপ্রভুরা সাধারণ মানুষের অভিযোগ খুব একট আমলে নিতেন না, জীবনমান উন্নয়নের জন্যও কোনো উদ্যোগ নিতেন না। এর ফলে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ধারণা জন্ম নেয়, পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমে সামন্তপ্রভুদের প্রভাব কমাতে হবে। কিন্তু শাসন্তপ্রভুরা যেহেতু সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা পেতেন, তাই জনগণকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদার করার বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না। তবে স্থানীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে টেনে আনার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বাস্তব সীমাবদ্ধতা ছিল। তা হলো প্রথমত, এ অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয়ত, ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে সবাইকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র কিংবা ধর্মভিত্তিক কোনো আদর্শের অধীনে একত্র করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তৃতীয়ত, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের মধ্যে একাত্ববোধ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ একই রকম ছিল না।

ওই প্রেক্ষাপটে এমএন লারমা আশার আলো খুঁজে পেলেন মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারায়। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং পাহাড়ি জনগণের সমস্যার স্বতন্ত্র চরিত্র তাকে ভাবায়। শেষ পর্যন্ত তিনি পৃথক, অঞ্চলভিত্তিক একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে মনস্থির করেন। এর পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করতে তিনি নতুন কৌশল হিসেবে একসাথে দুটি সংগঠন দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। তা হলো প্রকাশ্য একটি সংগঠন হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা পাহাড়ি স্বার্থ নিয়ে সচেতন ও কাজ করতে আগ্রহী, তারা এতে যুক্ত হতে পারবেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এরা কোনো ভাবেই গোপন সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানবে না। অন্যদিকে, আরেকটি গোপন সংগঠনে কেবল মার্ক্সবাদী তত্ত্বে দীক্ষিত কর্মীরা থাকবেন। এই সংগঠনের হাতে থাকবে মূল নেতৃত্ব। এটি আসলে হবে এক ধরনের ছায়াত্রন্ত্র, যার সুত থাকবে গোপন নেতৃত্বের হাতে।

ওই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে। সেদিন রাঙামাটিতে এক গোপন বৈঠকে গঠিত হয় ‘রাঙামাটি কমিউনিস্ট পার্টি’ (আরসিপি)। বৈঠকে ঠিক করা হয়, পাহাড়িদের সামাজিক সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করা হবে। এ নিয়ে সিদ্ধার্থ চাকমা বলেন, ‘যদিও দলের নামকরণ সেই মুহূর্তেই হয়নি তবু বলা যেতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ওই গোপন সভার ফল’ (১৩৯২ বঙ্গাব্দ; পৃষ্ঠা-১০০)।

আদর্শেও উত্তরাধিকার- গণমুক্তি ফৌজ থেকে শান্তি বাহিনী: আরসিপি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শান্তি বাহিনীর আদর্শিক ও সংগঠনিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারিতে প্রকাশিত প্রচারপত্র ‘রাঙামাটির কমিউনিস্ট পার্টির লাল ঝান্ডা এগিয়ে চলেছে’ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিল, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক রাঙামাটি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রাম চলবেই।’ প্রচারপত্রটিতে ‘দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম’ এবং ‘লাল ফৌজ বাহিনী’ গঠনের মাধ্যমে সরকারের শাসনযন্ত্র উৎখাতের অঙ্গীকার করা হয়। এই লক্ষ্যে পার্টির সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং মার্ক্সসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সে তুং-এর চিন্তাধারায় দীক্ষিত হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের (১৯৯৬) অভিমত- লারমা ভ্রাতৃদ্বয় পাকিস্তানের পতনের পর বাঙ্গালি ও পাহাড়িদের মধ্যে স্বার্থসংঘাতের সম্ভাবনা অনুমান করেছিলেন। তাই তারা একটি গোপন দল ও গেরিলা বাহিনী গড়ার পরিকল্পনা নেন; যা ভবিষ্যতে পাহাড়ি অধিকার রক্ষায় ব্যবহার করা হবে। পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোয়, এমনকি ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের আগে, সন্তু লারমা পাহাড়ি যুবকদের গোপনে আরসিপিতে নিয়োগ শুরু করেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের পরপরই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংগঠনিক কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে গঠিত হয় আরসিপির সশস্ত্র শাখা-পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বা গণ মুক্তি ফৌজ। আফতাব আহমাদ (১৯৯৩) নিশ্চিত করেছেন, গণ মুক্তি ফৌজের ব্যানারে আরসিপি তার সশস্ত্র ক্যাডারদের সংগঠিত করেছিল। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আরসিপির প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেব আত্মপ্রকাশ করে পিসিজেএসএস। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি এর সশস্ত্র শাখা ‘গণ মুক্তি ফৌজ’ (পি.এল.এ) খাগড়াছড়ির ইটছড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে বিভিন্ন গবেষক, লেখক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক সূত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, পিসিজেএসএস-এর এই সশস্ত্র শাখা ‘গণ মুক্তি ফৌজ’ নামে পরিচিত ছিল এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই অর্থাৎ শান্তিবহিনীর অনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই- কার্যকরভাবে সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে ইল্লেখযোগ্য- কাজী মন্টু (১৯৮০), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (১৯৮০), এম কিউ জামান (১৯৮২), এন্টি-স্ল্যাভারি সোসাইটি (১৯৮৪), এস মাহমুদ আলী (১৯৯৩), সুবীর ভৌমিক (১৯৯৬), সৈয়দ মুর্তজা আলী (১৯৯৬), সৈয়দ সেরাজুল ইসলাম (২০০৩, ২০১৫), ড. অরুণ কুমার নায়ক (২০১৫), এবং সিআইএ-এর ডিক্লাসিফাইড রিপোর্ট (১৯৮২, ১৯৮৬)। বস্তুত ১৯৭২ সালে সক্রিয় এই ‘গণ মুক্তি ফৌজ’-ই সময়ের প্রবাহে ১৯৭৩ সালের পর থেকে ‘শান্তি বাহিনী’ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে।

অল্প কথায় বলতে গেলে শান্তি বাহিনীর কার্যক্রম, আদর্শ ও নেতৃত্ব সরাসরি আরসিপি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আরসিপি ছিল আদর্শিক ভিত্তি, গণমুক্তি ফৌজ ছিল সশস্ত্র সূচনা, পিসিজেএসএস ছিল রাজনৈতিক প্রকাশ। আর ওই ধারাবাহিকতারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল ‘শান্তি বাহিনী’। অর্থাৎ শান্তি বাহিনী কোনো আকস্মিক সংগঠন নয়; বরং আরসিপি থেকে পিসিজেএসএস হয়ে গণমুক্তি ফৌজের মাধমে গড়ে ওঠা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক- সামরিক ধারাবাহিকতার ফলাফল। তবে প্রকাশ্যে শান্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং আড়ালে সশস্ত্র কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকা রাজনৈতিক ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই পরস্পরবিরোধী।

সুবীর ভৌমিক (১৯৯৬) ওই অবস্থানকে ‘দ্বৈত নীতি ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যভাবে একে দ্বিমূখী কৌশল কিংবা নৈতিক দ্ব্যর্থতা বলেও অভিহিত করা যায়। অর্থ্যৎ এটি শুধু একটি কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল না, বরং এম এন লারমার প্রকাশ্য অঙ্গীকার ও গোপন কর্মযজ্ঞের মধ্যে নিহিত গভীর অসামঞ্জস্যের প্রতিফলন।

ওই আখ্যান কেন আজও প্রচলিত: ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের আগে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পথ খোলা ছিল এবং পরেও তা ছিল। সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পরও বাংলাদেশে সরকার পার্বত্য চ্ট্টগ্রামে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেনি। এমনকি পিসিজেএসএস নিজেও তাদের নিয়মিত রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছিল। তাহলে আবারো প্রশ্ন আসে, শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকলেও কেন অস্ত্র হাতে নেওয়া হলো? এর উত্তর পাওয়া যায় আরসিপি’র বিপ্লবী পরিকল্পনায়। তাদের লক্ষ্য ছিল গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা এবং যুদ্ধের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা: প্রেরণ হিসেবে কাজ করেছিল মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদ। আরসিপি গঠন থেকে শুরু করে শান্তি বাহিনীর উত্থান-সবই ছিল ধারাবাহিকভাবে সাজানো পদক্ষেপ। তাই অস্ত্র হাতে নেওয়া কোনো অনিবার্য পদক্ষেপ ছিল না; এটি একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। শান্তির দুয়ার খোলা থাকলে ও তার অস্ত্র হাতে তুলে ইতিহাসে যুদ্ধের অধ্যায় লিখন-যেখানে একপক্ষের খলনায়ক, অন্যপক্ষের মহানায়ক। এই প্রেক্ষাপটে ‘শেষ অবলম্বন’ বা ‘একমাত্র উপায়’ আখ্যান পিসিজেএসএসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণে। তা হলো-

সহিসংসতার ন্যায়্যতা: আখ্যানটি সশস্ত্র বিদ্রোহকে ন্যায্যতা প্রদান করে, বিদ্রোহকে বৈধ প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখায়; পরিকল্পিত পছন্দ হিসেবে নয়।

ইতিহাসের সরলীকর: জটিল ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে সহজ মানব মনের সহজাত মনোযোগ আকর্ষণকারী গল্পে রূপান্তরিত করে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং পাহাড়িদের প্রতি সহানুভূতিশীল গবেষকদেও স্বতঃস্ফূর্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে- যারা অন্যথায় সংগ্রামের গভীর আদর্শগত শিকড় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতেন। ঐক্য ও ভুক্তভোগী পরিচ- অন্যায় সহ্য করার কথিত ও অকথিত অভিজ্ঞতা এবং সব বিকল্প নিঃশেষ হওয়ায় গল্প সদস্যদের মধ্যে ঐক্য ও লড়াইয়ের মনোবল বাড়ায়। এটি ভুক্তভোগী (ভিক্টিম) পরিচয়কে দৃঢ় ও শক্তিশালী করে; যাতে তারা নিজেদের অধিকার ও সংগ্রামের ন্যায্যতা আরও বাস্তবসম্মতভাবে অনুভব করে।

আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ অংশ: ‘অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য’ হওয়ার আখ্যান শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহের পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি নেতাদের বিপ্লবী আদর্শ এবং স্থানীয় জনগণের দীর্ঘদিনের অভিযোগের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

নৃতাত্ত্বিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব: পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও পরিচয়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অসন্তোষ ও রাজনৈতিক সচেতনতা জাগিয়েছেন, যা বিদ্রোহকে শুধু রাজনৈতিক বা সামজিক দাবি নয়, বরং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিরোধ হিসেবে তুলে ধরে। একই সঙ্গে সীমান্তসংলগ্ন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক প্রভাব এই আখ্যানকে আঞ্চলিক/আন্তর্জাতিক মাত্রায় যুক্তিযুক্ত প্রতিরোধ হিসেবে ব্যাখ্যার সুযোগ দিয়েছে।

শেষ কথা: পাহাড়ের ইতিহাসের গভীরতা এবং বর্তমানের ছায়া—পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহ কোনো অপ্রত্যাশিত বাধ্যবাধকতার ফল নয়। কাপ্তাই বাঁধের ক্ষোভ, পাকিস্তান আমলে আরসিপির গোপন গঠন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম, স্বাধীনতার পর পিসিজেএসএসের ঘোষণা এবং ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তি বাহিনীর প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ সবই এক ধারাবাহিক ঘটনার অংশ। শান্তিপূর্ণ পথ থাকা সত্বের, স্থানীয় নেতৃত্ব সচেতনভাবে সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছিলেন লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে। রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে মার্ক্সসবাদ, লেনিনবাদ এবং মাওবাদ বিদ্রোহের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

‘একমাত্র উপায়’ আখ্যানটি পিসিজেএসএসের সশস্ত্র বিদ্রোহকে বৈধ হিসেবে উপস্থাপন করার একটি প্রয়াস। এটি তাদের কার্যক্রমকে আপাত বহিরাগত নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখানোর সুযোগ দেয় এবং নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে। তবে এই আখ্যানে পুরো সত্যটি প্রতিফলিত হয়নি। শান্তি বাহিনী শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল না; এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিপ্লবী চিন্তা এবং সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল একটি জটিল অধ্যায় হিসেবে স্থায়ী ছাপ রেখেছে। এই জটিলতা না বুঝলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো চিত্র অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এই অঞ্চলের সশস্ত্র তৎপরতায় বহ পাহাড়ি ও বাঙালি মানুষ প্রিয়জন, বাড়িঘর এবং শান্তি হারিয়েছেন। তাই সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস কেবল ঘটনার তালিকা নয়; এটি মানষের যন্ত্রণার, সংগ্রামের এবং স্বপ্নের অমীমাংসিত গল্প। প্রতিটি হারানো জীবন, প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি, প্রতিটি লঙ্ঘিত অধিকার সবই কালের গর্ভে চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে আছে। এগুলো স্বরণ করিয়ে দেয় যে শান্তি ও সমাধানের পথ এখনও যেন অধরা। তবে তা অসাধ্য নয়- এগুলো অর্জন করতে হবে সততা, স্বচ্ছতা এবং সত্যের সঙ্গে; মিথ্যা দাবি বা প্রোপাগান্ডার প্রলোভন এড়িয়ে। এই পথ খুঁজে বের করা হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের দায়িত্ব, যারা অতীত থেকে পাঠ নিয়ে ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে; গড়ে তুলবে সমৃদ্ধ সভ্যতা ও মানবিক জনপদ।

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম অনুরাগী ও গবেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

পাহাড়ের বিদ্রোহ: ‘একমাত্র উপায়’ মিথের আড়ালে

আপডেট সময় : ০৬:২৮:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫

জিএম আহমেদ

পাহাড়কে প্রথম দেখায় প্রশান্তির প্রতিচ্ছবি মনে হতে পারে; যেন অপার সৌন্দর্য আর অনাদি স্থিতির প্রতীক। তাই বলে পাহাড়ের শান্ত নীরবতা সব সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ইঙ্গিত দেয় না। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এর জীবন্ত উদাহরণ। এখানে জমে আছে দীর্ঘ টানাপড়েন আর অশান্তির ইতিহাস। এই ইতিহাস শুধু জমি বা রাজনীতির কাহিনি নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশার গল্প, অধিকার খোঁজার লড়াই আর ভাঙা-গড়া স্বপ্নের নিত্যপথচলা। এরই মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচিত অধ্যায় হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহ। তাদের দাবি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়েছিল অস্ত্র ধরতে। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর বাইরেও পাহাড় ও সমতলের আপামর জনগণের অনেকের কণ্ঠে এই দাবি প্রায়ই অনুরণিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দাবির রূঢ় সত্যতা কতটা? পাহাড়ের সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রকৃত শুরুটা কোথায়?

ইতিহাসের পাতায় তাকালেই বোঝা যায়, মূল গল্পটা অনেক বেশি জটিল। এটা কেবল সাদা-কালো নয়; বরং নানা স্তর, নানা ব্যাখ্যা আর এক গভীর বাস্তবতার মিশ্রণ।

সত্যিই কি সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল শেষ বিকল্প: সন্তু লারমা, পিসিজেএসএসের বর্তমান সভাপতি ও শান্তি বাহিনীর সাবেক ফিল্ড কম্যান্ডার একাধিকবার বলেছেন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলনের সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি ৭ জানুয়ারি ১৯৭৩ তারিখটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, যেদিন তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ ছাড়া পিসিজেএসএসের ওয়েবসাইটে এখনো দাবি করা হচ্ছে যে, শান্তিপূর্ণ পথ শেষ হলে অস্ত্রই ছিল ‘একমাত্র উপায়’ তাদের জনগণকে রক্ষা করার। কিন্তু এই দাবির পেছনে কি সব কিছু সত্যিই সংগতিপূর্ণ? বাংলাদেশের এই পাহাড়ি অঞ্চলে কি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পথ সত্যিই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? হয়তো না।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ ও খোলাখুলি আলোচনা করতে পারতেন এবং তা করেছিলেনও। অন্যদিকে, এমনকি সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার পরেও কোনো সরকারই এই অঞ্চলে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেনি। এই প্রেক্ষাপটের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়। কেননা পিসিজেএসএস নিজেই নিয়মিত এর সব কার্যক্রম যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছিল। আর কিছু না হলেও এটুকু স্পষ্ট যে অন্তত ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়গুলো সংগঠনগুলোর জন্য পুরোপুরি অবারিত ছিল। এক্ষেত্রে ‘শান্তি বাহিনী’ গঠন করা কি সত্যিই বিকল্প হিসেবে যুক্তিসঙ্গত ছিল?

এমএন লারমা ওই সশস্ত্র বিদ্রোহের মূল স্থপতি ছিলেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্বেচ্ছায় বাকশালে যোগ দেন। তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তিনি পাহাড়ের গুমোট পরিবেশে শান্তির সুবাতাস বইবে বলে আশাবাদী ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রকাশ্যে সরকারি দলে যোগ দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা প্রকাশ করার পাশাপাশি গোপনে সশস্ত্র কার্যক্রম চালানো নিঃসন্দেহে এক পরস্পরবিরোধী অবস্থান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, সশস্ত্র বিদ্রোহ ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যা একদিকে অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয় এবং অন্যদিকে ‘শেষ আশ্রয়’ বা ‘একমাত্র উপায়’ থেকে প্রত্যাশিত ধীর, ক্রমান্বয়ে শুরুর ধারণার বিরোধী। তাই ‘গণতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক স্থান না থাকায় অস্ত্রধারণ’ তত্ত্বটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। এক্ষেত্রে প্রশ্নটা রয়েই যায়- আসলে শান্তিপূর্ণ পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, নাকি অস্ত্রধারণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত?

শিকড়ের গভীরে কাপ্তাই বাঁধ- ক্ষোভের শুরু এবং রাজনৈতিক জাগরণ: পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহের শিকড় খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে পাকিস্তান আমলে, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে। তখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। কিন্তু এই বাঁধের ফলে পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক মানুষ বাস্তুচ্যুত; তলিয়ে যায় তাদের চাষাবাদের জমি ও বসতভিটা। যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় সৃষ্টি হয়, হতাশা ও ক্ষোভ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে সরকারের শিক্ষা বিস্তারমূলক পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং স্থানীয়দের মনে রাজনৈতিক সচেতনতার উম্মেষ ঘটে। কিন্তু প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব, বিশেষ করে সবচেয়ে প্রভাবশালী চাকমা সার্কেল চিফ জনগণের স্বার্থে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। ফলে জনগণ তাদের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষিত যুবকরা উপলব্ধি করেন, নিজেদেও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কণ্ঠ প্রয়োজন।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তারা গঠন করেন উপজাতীয় কল্যাণ পরিষদ। একই সময়ে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষক সমিতি। যদিও নাম শুনতে সামাজিক বা পেশাজীবী সংগঠনের মতো; এর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ি মানুষের রাজনৈতিক অধিকার অর্জন। খুব শিগগির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এক মাত্রা দেখা দেয় সশস্ত্র পন্থা। কিছু নেতা শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিকে সমর্থন করলেও বামপন্থী ধারার প্রাভাবে অনেকে মনে করতেন, শুধু অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের অধিকার রক্ষা সম্ভব। তাই উপজাতীয় কল্যাণ পরিষদের গঠনকে এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশের সঙ্গে তুলনা করে ভ্যান সেন্দেল (১৯৯২) সুনির্দিষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন যে এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রবক্তাগণ সামনে এসে দাঁড়ায়।

দ্য ব্লাইন্ড স্পট- মার্কসবাদী চিন্তা ও গোপন বিপ্লবী সংগঠনের উত্থান: এরপরের ঘটনা প্রবাহ দ্রুত নানা মাত্রিক মোড় নিতে থাকে। ছয় দফা ও এগারো দফা আন্দোলন, সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা- সবই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঢেউ তোলে; বিশেষ করে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সমর্থন করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার হয়। এই সময় শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এম এন লারমা পাহাড়ি জনগণকে রাজনীতিতে সচেতন ও সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। প্রবীণ নেতৃবৃন্দ বা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহায়তা না পেলেও তিনি হাল ছাড়েননি।

ব্রিটিশ আমল থেকে ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ ঘোষিত থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত অনুপস্থিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ফলে শামন্তপ্রভুরা সাধারণ মানুষের অভিযোগ খুব একট আমলে নিতেন না, জীবনমান উন্নয়নের জন্যও কোনো উদ্যোগ নিতেন না। এর ফলে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ধারণা জন্ম নেয়, পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমে সামন্তপ্রভুদের প্রভাব কমাতে হবে। কিন্তু শাসন্তপ্রভুরা যেহেতু সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা পেতেন, তাই জনগণকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদার করার বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না। তবে স্থানীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে টেনে আনার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বাস্তব সীমাবদ্ধতা ছিল। তা হলো প্রথমত, এ অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয়ত, ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে সবাইকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র কিংবা ধর্মভিত্তিক কোনো আদর্শের অধীনে একত্র করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তৃতীয়ত, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের মধ্যে একাত্ববোধ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ একই রকম ছিল না।

ওই প্রেক্ষাপটে এমএন লারমা আশার আলো খুঁজে পেলেন মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারায়। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং পাহাড়ি জনগণের সমস্যার স্বতন্ত্র চরিত্র তাকে ভাবায়। শেষ পর্যন্ত তিনি পৃথক, অঞ্চলভিত্তিক একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে মনস্থির করেন। এর পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করতে তিনি নতুন কৌশল হিসেবে একসাথে দুটি সংগঠন দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। তা হলো প্রকাশ্য একটি সংগঠন হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা পাহাড়ি স্বার্থ নিয়ে সচেতন ও কাজ করতে আগ্রহী, তারা এতে যুক্ত হতে পারবেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এরা কোনো ভাবেই গোপন সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানবে না। অন্যদিকে, আরেকটি গোপন সংগঠনে কেবল মার্ক্সবাদী তত্ত্বে দীক্ষিত কর্মীরা থাকবেন। এই সংগঠনের হাতে থাকবে মূল নেতৃত্ব। এটি আসলে হবে এক ধরনের ছায়াত্রন্ত্র, যার সুত থাকবে গোপন নেতৃত্বের হাতে।

ওই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে। সেদিন রাঙামাটিতে এক গোপন বৈঠকে গঠিত হয় ‘রাঙামাটি কমিউনিস্ট পার্টি’ (আরসিপি)। বৈঠকে ঠিক করা হয়, পাহাড়িদের সামাজিক সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করা হবে। এ নিয়ে সিদ্ধার্থ চাকমা বলেন, ‘যদিও দলের নামকরণ সেই মুহূর্তেই হয়নি তবু বলা যেতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ওই গোপন সভার ফল’ (১৩৯২ বঙ্গাব্দ; পৃষ্ঠা-১০০)।

আদর্শেও উত্তরাধিকার- গণমুক্তি ফৌজ থেকে শান্তি বাহিনী: আরসিপি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শান্তি বাহিনীর আদর্শিক ও সংগঠনিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারিতে প্রকাশিত প্রচারপত্র ‘রাঙামাটির কমিউনিস্ট পার্টির লাল ঝান্ডা এগিয়ে চলেছে’ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিল, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক রাঙামাটি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রাম চলবেই।’ প্রচারপত্রটিতে ‘দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম’ এবং ‘লাল ফৌজ বাহিনী’ গঠনের মাধ্যমে সরকারের শাসনযন্ত্র উৎখাতের অঙ্গীকার করা হয়। এই লক্ষ্যে পার্টির সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং মার্ক্সসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সে তুং-এর চিন্তাধারায় দীক্ষিত হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের (১৯৯৬) অভিমত- লারমা ভ্রাতৃদ্বয় পাকিস্তানের পতনের পর বাঙ্গালি ও পাহাড়িদের মধ্যে স্বার্থসংঘাতের সম্ভাবনা অনুমান করেছিলেন। তাই তারা একটি গোপন দল ও গেরিলা বাহিনী গড়ার পরিকল্পনা নেন; যা ভবিষ্যতে পাহাড়ি অধিকার রক্ষায় ব্যবহার করা হবে। পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোয়, এমনকি ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের আগে, সন্তু লারমা পাহাড়ি যুবকদের গোপনে আরসিপিতে নিয়োগ শুরু করেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের পরপরই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংগঠনিক কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে গঠিত হয় আরসিপির সশস্ত্র শাখা-পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বা গণ মুক্তি ফৌজ। আফতাব আহমাদ (১৯৯৩) নিশ্চিত করেছেন, গণ মুক্তি ফৌজের ব্যানারে আরসিপি তার সশস্ত্র ক্যাডারদের সংগঠিত করেছিল। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আরসিপির প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেব আত্মপ্রকাশ করে পিসিজেএসএস। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি এর সশস্ত্র শাখা ‘গণ মুক্তি ফৌজ’ (পি.এল.এ) খাগড়াছড়ির ইটছড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে বিভিন্ন গবেষক, লেখক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক সূত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, পিসিজেএসএস-এর এই সশস্ত্র শাখা ‘গণ মুক্তি ফৌজ’ নামে পরিচিত ছিল এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই অর্থাৎ শান্তিবহিনীর অনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই- কার্যকরভাবে সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে ইল্লেখযোগ্য- কাজী মন্টু (১৯৮০), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (১৯৮০), এম কিউ জামান (১৯৮২), এন্টি-স্ল্যাভারি সোসাইটি (১৯৮৪), এস মাহমুদ আলী (১৯৯৩), সুবীর ভৌমিক (১৯৯৬), সৈয়দ মুর্তজা আলী (১৯৯৬), সৈয়দ সেরাজুল ইসলাম (২০০৩, ২০১৫), ড. অরুণ কুমার নায়ক (২০১৫), এবং সিআইএ-এর ডিক্লাসিফাইড রিপোর্ট (১৯৮২, ১৯৮৬)। বস্তুত ১৯৭২ সালে সক্রিয় এই ‘গণ মুক্তি ফৌজ’-ই সময়ের প্রবাহে ১৯৭৩ সালের পর থেকে ‘শান্তি বাহিনী’ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে।

অল্প কথায় বলতে গেলে শান্তি বাহিনীর কার্যক্রম, আদর্শ ও নেতৃত্ব সরাসরি আরসিপি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আরসিপি ছিল আদর্শিক ভিত্তি, গণমুক্তি ফৌজ ছিল সশস্ত্র সূচনা, পিসিজেএসএস ছিল রাজনৈতিক প্রকাশ। আর ওই ধারাবাহিকতারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল ‘শান্তি বাহিনী’। অর্থাৎ শান্তি বাহিনী কোনো আকস্মিক সংগঠন নয়; বরং আরসিপি থেকে পিসিজেএসএস হয়ে গণমুক্তি ফৌজের মাধমে গড়ে ওঠা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক- সামরিক ধারাবাহিকতার ফলাফল। তবে প্রকাশ্যে শান্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং আড়ালে সশস্ত্র কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকা রাজনৈতিক ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই পরস্পরবিরোধী।

সুবীর ভৌমিক (১৯৯৬) ওই অবস্থানকে ‘দ্বৈত নীতি ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যভাবে একে দ্বিমূখী কৌশল কিংবা নৈতিক দ্ব্যর্থতা বলেও অভিহিত করা যায়। অর্থ্যৎ এটি শুধু একটি কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল না, বরং এম এন লারমার প্রকাশ্য অঙ্গীকার ও গোপন কর্মযজ্ঞের মধ্যে নিহিত গভীর অসামঞ্জস্যের প্রতিফলন।

ওই আখ্যান কেন আজও প্রচলিত: ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের আগে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পথ খোলা ছিল এবং পরেও তা ছিল। সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পরও বাংলাদেশে সরকার পার্বত্য চ্ট্টগ্রামে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেনি। এমনকি পিসিজেএসএস নিজেও তাদের নিয়মিত রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছিল। তাহলে আবারো প্রশ্ন আসে, শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকলেও কেন অস্ত্র হাতে নেওয়া হলো? এর উত্তর পাওয়া যায় আরসিপি’র বিপ্লবী পরিকল্পনায়। তাদের লক্ষ্য ছিল গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা এবং যুদ্ধের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা: প্রেরণ হিসেবে কাজ করেছিল মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদ। আরসিপি গঠন থেকে শুরু করে শান্তি বাহিনীর উত্থান-সবই ছিল ধারাবাহিকভাবে সাজানো পদক্ষেপ। তাই অস্ত্র হাতে নেওয়া কোনো অনিবার্য পদক্ষেপ ছিল না; এটি একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। শান্তির দুয়ার খোলা থাকলে ও তার অস্ত্র হাতে তুলে ইতিহাসে যুদ্ধের অধ্যায় লিখন-যেখানে একপক্ষের খলনায়ক, অন্যপক্ষের মহানায়ক। এই প্রেক্ষাপটে ‘শেষ অবলম্বন’ বা ‘একমাত্র উপায়’ আখ্যান পিসিজেএসএসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণে। তা হলো-

সহিসংসতার ন্যায়্যতা: আখ্যানটি সশস্ত্র বিদ্রোহকে ন্যায্যতা প্রদান করে, বিদ্রোহকে বৈধ প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখায়; পরিকল্পিত পছন্দ হিসেবে নয়।

ইতিহাসের সরলীকর: জটিল ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে সহজ মানব মনের সহজাত মনোযোগ আকর্ষণকারী গল্পে রূপান্তরিত করে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং পাহাড়িদের প্রতি সহানুভূতিশীল গবেষকদেও স্বতঃস্ফূর্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে- যারা অন্যথায় সংগ্রামের গভীর আদর্শগত শিকড় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতেন। ঐক্য ও ভুক্তভোগী পরিচ- অন্যায় সহ্য করার কথিত ও অকথিত অভিজ্ঞতা এবং সব বিকল্প নিঃশেষ হওয়ায় গল্প সদস্যদের মধ্যে ঐক্য ও লড়াইয়ের মনোবল বাড়ায়। এটি ভুক্তভোগী (ভিক্টিম) পরিচয়কে দৃঢ় ও শক্তিশালী করে; যাতে তারা নিজেদের অধিকার ও সংগ্রামের ন্যায্যতা আরও বাস্তবসম্মতভাবে অনুভব করে।

আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ অংশ: ‘অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য’ হওয়ার আখ্যান শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহের পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি নেতাদের বিপ্লবী আদর্শ এবং স্থানীয় জনগণের দীর্ঘদিনের অভিযোগের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

নৃতাত্ত্বিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব: পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও পরিচয়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অসন্তোষ ও রাজনৈতিক সচেতনতা জাগিয়েছেন, যা বিদ্রোহকে শুধু রাজনৈতিক বা সামজিক দাবি নয়, বরং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিরোধ হিসেবে তুলে ধরে। একই সঙ্গে সীমান্তসংলগ্ন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক প্রভাব এই আখ্যানকে আঞ্চলিক/আন্তর্জাতিক মাত্রায় যুক্তিযুক্ত প্রতিরোধ হিসেবে ব্যাখ্যার সুযোগ দিয়েছে।

শেষ কথা: পাহাড়ের ইতিহাসের গভীরতা এবং বর্তমানের ছায়া—পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহ কোনো অপ্রত্যাশিত বাধ্যবাধকতার ফল নয়। কাপ্তাই বাঁধের ক্ষোভ, পাকিস্তান আমলে আরসিপির গোপন গঠন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম, স্বাধীনতার পর পিসিজেএসএসের ঘোষণা এবং ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে শান্তি বাহিনীর প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ সবই এক ধারাবাহিক ঘটনার অংশ। শান্তিপূর্ণ পথ থাকা সত্বের, স্থানীয় নেতৃত্ব সচেতনভাবে সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছিলেন লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে। রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে মার্ক্সসবাদ, লেনিনবাদ এবং মাওবাদ বিদ্রোহের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

‘একমাত্র উপায়’ আখ্যানটি পিসিজেএসএসের সশস্ত্র বিদ্রোহকে বৈধ হিসেবে উপস্থাপন করার একটি প্রয়াস। এটি তাদের কার্যক্রমকে আপাত বহিরাগত নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখানোর সুযোগ দেয় এবং নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে। তবে এই আখ্যানে পুরো সত্যটি প্রতিফলিত হয়নি। শান্তি বাহিনী শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল না; এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিপ্লবী চিন্তা এবং সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল একটি জটিল অধ্যায় হিসেবে স্থায়ী ছাপ রেখেছে। এই জটিলতা না বুঝলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো চিত্র অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এই অঞ্চলের সশস্ত্র তৎপরতায় বহ পাহাড়ি ও বাঙালি মানুষ প্রিয়জন, বাড়িঘর এবং শান্তি হারিয়েছেন। তাই সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস কেবল ঘটনার তালিকা নয়; এটি মানষের যন্ত্রণার, সংগ্রামের এবং স্বপ্নের অমীমাংসিত গল্প। প্রতিটি হারানো জীবন, প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি, প্রতিটি লঙ্ঘিত অধিকার সবই কালের গর্ভে চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে আছে। এগুলো স্বরণ করিয়ে দেয় যে শান্তি ও সমাধানের পথ এখনও যেন অধরা। তবে তা অসাধ্য নয়- এগুলো অর্জন করতে হবে সততা, স্বচ্ছতা এবং সত্যের সঙ্গে; মিথ্যা দাবি বা প্রোপাগান্ডার প্রলোভন এড়িয়ে। এই পথ খুঁজে বের করা হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের দায়িত্ব, যারা অতীত থেকে পাঠ নিয়ে ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে; গড়ে তুলবে সমৃদ্ধ সভ্যতা ও মানবিক জনপদ।

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম অনুরাগী ও গবেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ