নিজস্ব প্রতিবেদক : সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন জাফর হোসেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। আগে পাসপোর্ট করিয়েছিলেন জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে। সেই পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। জাফর বলেন, তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, তাই এখন নতুন পাসপোর্ট তাকে করতেই হবে।
কাজটি দ্রুত করার জন্য ‘দালাল’র শরণ নিয়েছেন তিনি। বললেন, “দালাল ধরেছি, দেখা যাক কী হয়।” এমন বিভিন্নজনের পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের প্রায় সব অফিসেই দেখা মেলে যাদের, তাদের সাধারণভাবে দালাল বলা হয়। এটা বৈধ কোনো পেশা নয়; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হতে হয় যখন-তখন। র্যাবের চলমান দালালবিরোধী অভিযানেও বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিস থেকে অনেককে আটক করা হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাও হয়েছে তাদের। তবে এরমধ্যেই পাসপোর্ট অফিসের দালালদের নিবন্ধনের আওতায় এনে তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
নানা পদক্ষেপেও পাসপোর্ট দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে না পারার মধ্যে এই উদ্যোগ নেওয়ার কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, পাসপোর্ট আবেদনকারী অনেকে নিজেরা ফরম পূরণ করতে পারেন না, অনলাইনে ফরম পূরণেও অভ্যস্ত হয় অনেকে। তাদের সাহায্যকারী লাগে। এখন আইনিভাবে কেউ তা করতে পারে না বলে তাদের বৈধতা দিতে এই উদ্যোগ। এই উদ্যোগে পাসপোর্ট আবেদনকারীদের সেবা দিতে ‘এজেন্ট’ নিয়োগের একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) শিহাব উদ্দিন খান গত মঙ্গলবার বলেন, “আমাদের মতামত চেয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। আমাদের মহাপরিচালক বর্তমানে দেশের বাইরে, তিনি আসলেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমরা মতামত পাঠাব।”
বিভিন্ন ভূমি অফিসের সামনে যেমন দলিল লেখক থাকে, পাসপোর্ট অফিসের ক্ষেত্রেও তেমনই পরিকল্পনা। এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখলে পাসপোর্ট করিয়ে দিতে এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারবেন দালালরা। একটি নির্ধারিত ফির বিনিময়ে তারা পাসপোর্ট তৈরির কাজে সহায়তা করতে পারবেন। তবে এখন যেভাবে পাসপোর্ট দেওয়া হয়, তাতে দালালদের প্রয়োজন পড়ার কথা নয় বলে মনে করেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, “একটু সচেতন হলেই পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারীকে দালালের কাছে যেতে হয় না। আর এখন ই-পাসপোর্টের জন্য দালালের কাছে যাওয়ার কোনো সুযোগও নেই।”
এজেন্ট নিয়োগে কী সুবিধা? ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসের সামনে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করছেন মিজানুর রহমান। তার অধীনে প্রায় ২৫ জন কর্মী আছেন, যারা পাসপোর্ট নিয়ে কাজ করেন। তবে নিজেকে কিংবা এই কর্মীবাহিনীকে দালাল বলতে নারাজ মিজান। র্যাবের অভিযানে সোমবার পাবনার পাসপোর্ট অফিসে গ্রেপ্তার দালাল।র্যাবের অভিযানে সোমবার পাবনার পাসপোর্ট অফিসে গ্রেপ্তার দালাল।
তিনি বলেন, “কথিত এক ধরনের দালাল আছে, যারা সহজ-সরল মানুষকে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কথা বলে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করে পালিয়ে যায়। “আমরা শুধু আবেদনকারীকে পরামর্শ দিই, প্রযোজনে ফরম পূরণ এবং ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। আবেদনকারী নিজেই তার আবেদন জমা দেন, ছবি তোলান।”
এই সহায়তার জন্য দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা নেন বলে জানান মিজান। তিনি বলেন, আবার কাউকে কাউকে টাকা ছাড়াই সাহায্য করা হয়। সরকার যে এজেন্ট নিয়োগের পরিকল্পনা করছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, “নিবন্ধন হলে একটা গতি আসবে কাজে। টাকা নির্ধারিত থাকবে। কোনো ঝামেলা থাকবে না। পুলিশ বা র্যাবের দ্বারা কেউ হয়রানি হবে না।” একই ধরনের কাজ করেন মুনসুর আহমেদ শাহিন। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে সরকারি জায়গার তার একটি টিনশেড দোকান আছে। দীর্ঘদিন ধরে এখানে দুটি কম্পিউটার রেখে কাজ করছেন। তবে নিবন্ধনে কোনো লাভ হবে বলে শাহিন মনে করেন না। তার ভাষ্যে, “যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক, নিবন্ধন হলেও কোনো লাভ নেই। আর এসব নিয়ে অনেক আগে থেকেই কথা হচ্ছে। কিছু হবে বলে মনে হয় না।”
দালাল-পাসপোর্টকর্মী যোগসাজশ : এখন দালালরা যে কাজ করিয়ে দিচ্ছেন, তাতে পাসপোর্ট অফিসের অনেক কর্মী তাদের সঙ্গে জড়িত থাকছেন। ফলে অবৈধ কাজে যুক্ত হওয়ায় পাসপোর্ট অফিসের কর্মীদের শাস্তিও হচ্ছে। আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন।আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন।
দালালের সঙ্গে যোগসূত্র থাকাসহ বিভিন্ন অপরাধে এভাবে গত এক যুগে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি হারাতে হয়েছে। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে অধিদপ্তরের প্রতিটি কক্ষ সিটি টিভির আওতাভুক্ত হওয়ায় দালালের দৌরাত্ম্য কমেছে। তবে দালাল নেই বা কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সঙ্গে তাদের যোগসূত্র নেই, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান জানান, গত ১২-১৩ বছরে অন্তত ২৫ জনের চাকরি চলে গেছে। সর্বশেষ গত বছর রাজশাহীতে একজন চাকরিচ্যুতি হয়। দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে আঙুলের চাপ নিয়ে জালিয়াতি, পাসপোর্ট আবেদনকারীর তথ্য গোপনসহ বিভিন্ন অভিযোগে এদের চাকরিচ্যুত করা হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা। চাকরিচ্যুতি ছাড়াও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে বলেও জানান তিনি। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী সম্প্রতি বলেছিলেন, পাসপোর্ট সংক্রান্ত যে সব অভিযোগ পাওয়া যায়, তার ৯০ শতাংশই দালাল সংক্রান্ত। দালালদের এজেন্ট করে নিয়মের অধীনে আনা গেলে অনিয়ম কমিয়ে আনার আশা করা হচ্ছে।
ই-পাসপোর্টে জোর : পাসপোর্ট অধিদপ্তর এখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইস্যু না করার কৌশল নিয়ে সবাইকে ই পাসপোর্টমুখী করতে চাইছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এমআরপি বন্ধ রাখেননি, সেভাবে খোলাও রাখেননি। নতুন করে আগের মতো চালু করার পরিকল্পনাও নেই।
পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এখন আর এমআরপি পাসপোর্টের আবেদন তেমন আসছে না। যেখানে প্রতি মাসে আগে ৪ শতাধিক হত, সেখানে গত অগাস্ট মাসে মাত্র ৪৩টি এমআরপি পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে।
বিপরীতে ই পাসপোর্ট প্রতিদিন দেড় শতাধিক ইস্যু হচ্ছে বলে জানান তিনি। তৌফিকুল বলেন, “যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে কিছু সমস্যা আছে, তাদের মানবিক বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে অসুস্থ এবং প্রবাসীদের ক্ষেত্রে এমআরপি ইস্যু করা হচ্ছে।”
ই-পাসপোর্ট দালাল নির্ভরতা কমিয়ে দিতেও ভূমিকা রাখছে বলে মত তার। তৌফিকুল বলেন, “ই-পাসপোর্ট সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে হচ্ছে। অনলাইনে ফরম পূরণ করে আবেদনকারী নির্ধারিত তারিখ পেয়ে থাকেন। ব্যাংকে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে ওই তারিখে এসে তিনি ছবি তোলাসহ প্রয়োজনীয় কাজ করবেন। এখানে দালালের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।”
পাসপোর্ট দালালদের এজেন্ট হওয়ার কত দূর?
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ




















