ড. মো. মিজানুর রহমান
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক। খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা তারই অংশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তখন স্থানীয় পাহাড়ি রাজা ও সম্প্রদায়কে আঞ্চলিক শাসনের অধিকার দেওয়া হয়। জমির মালিকানা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মূলত উপজাতীয় সমাজের হাতে রাখা হয়। ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসন মজবুত ছিল।
ব্রিটিশ শাসন শেষে পাকিস্তান আমলেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক অবহেলা, বৈষম্য ও শোষণ চলতে থাকে; সেই সময় কেন্দ্রীয় শাসন স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এর ফলে জমি দখল, প্রশাসনিক নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে সামাজিক অস্থিরতার ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে; কখনো তারা নিজস্ব জাতিগত স্বার্থ রক্ষা করতে, আবার কখনো বাইরের রাজনৈতিক প্রভাবে হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে।
১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকেই ভারতে ও মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়। এই বাস্তুচ্যুতি পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের বীজ বোনা হয়। স্বাধীনতার পরেও পরিস্থিতি পালটায়নি। স্বাধীনতার পর প্রথম আওয়ামী সরকারের অধীনে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে স্থানীয় সশস্ত্র বিরোধী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হয় এবং বসতি সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় কিছু নিরীহ বাঙালি পরিবারও লক্ষ্যবস্তু হয়। তখনকার রাজনৈতিক সমর্থক ও একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিতেন এবং অনেক ঘটনাই স্থানীয় প্রশাসন ও মিডিয়ায় বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হতো; এতে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভাজন আরো গভীর হয়।
১৯৭২ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন, জমির অধিকার ও সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিতের দাবি তুলে ধরলেও সংঘাত থামেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ও পরবর্তী সামরিক শাসনের সময় পাহাড়ে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেনা অভিযান এবং স্থানীয় একশ্রেণির নেতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে বহু বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরবর্তী কয়েক দশকেও শান্তি অর্জিত হয়নি।
১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোয় শান্তিবাহিনী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ সেনা ও ৩০ হাজার বাঙালি নিহত হয়, শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত ও সম্পদ ধ্বংসের শিকার হয় এবং নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই সময়ে তথাকথিত মানবাধিকারকর্মী, বামপন্থি ও ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা ও কখনো কখনো উসকানিমূলক ভূমিকার অভিযোগও ওঠে; ফলে সংঘাত আরো জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রূপ নেয়। ১৯৯৬-৯৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সংঘাত কমার বদলে নতুন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ঘটনাবলির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবে স্থায়ী সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রশাসনিক বিভাজন, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সম্পদ লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডকে থামাতে পারেনি এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চুক্তির প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে-কিছু বিশ্লেষক এটাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
চুক্তির পর অনেক জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে; চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক দখলদারির ঘটনা নিত্যসংবাদে পরিণত হয়। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে বাস্তব উন্নয়ন কাজেও বাধা এসেছে। তবে সরকারি নীতিতে প্রায়ই ‘পাহাড়িদের উন্নয়ন’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বরং স্থানীয় বাঙালিদের দুরবস্থার বিষয়টি নানাবিধ কারণে উপেক্ষিত থেকে যায়।
উল্লেখ্য, পার্বত্য তিন জেলায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৪১ শতাংশ পাহাড়ি বলে প্রচলিত পরিমাপ রয়েছে; আবার অন্য সূত্রে কিছু ভিন্নতাও দেখা যায়। এখানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আরো দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। বলা হয়, চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলকভাবে উন্নত এবং চাকমা নারীদের মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য; অন্যদিকে কয়েকটি এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত হার কমে গেছে। এছাড়া কিছু পাহাড়ি এলাকায় জমি লিজ দেওয়া ও পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে; যা রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকারের দিক থেকে বিতর্কিত।
ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণের আলোকে দেখা যায়, ইউপিডিএফসহ কিছু সংগঠনের কার্যক্রমে বাইরের প্রভাবের উপসর্গ রয়েছে। সাম্প্রতিক খাগড়াছড়ি সংঘাতের প্রেক্ষাপটে অভিযোগ উঠেছে যে, ধর্ষণের একটি নাটক সাজিয়ে সংঘাতকে উসকে দেওয়া হয়। যদিও মেয়েদের মেডিক্যাল প্রতিবেদন ও প্রাথমিক তথ্যগুলোয় ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি, তবুও এ ধরনের ঘটনা এলাকায় অস্থিরতা ও সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করেছে। এই ধরনের কৌশলগত বিভ্রান্তি ও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামগ্রিকভাবে সমস্যাকে জটিল করে তোলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা-বিশ্লেষকরা ইউপিডিএফের সন্ত্রাস বন্ধে তৎক্ষণিক ও সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন।
গোয়েন্দা ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী সূত্রবিহীনভাবে ছড়ানো ঝুটো অভিযোগ, সীমান্তের বাইরের প্রশিক্ষণ ও সাহায্য ইত্যাদি প্রতিহত করতে হবে। তবে পুরোটাই কেবল শক্তি প্রদর্শন করে সমাধান না করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রমাণভিত্তিক তদন্ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ঐক্য রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও প্রয়োজন। একই সঙ্গে সামরিক ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি, যাতে নিরাপত্তা বজায় রেখে জনসাধারণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা যায়।
বর্তমানে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা কমাতে সেনা ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট বৃদ্ধির প্রস্তাব উঠেছে; বিশেষত কিছু সম্ভাব্য সুপারিশে খাগড়াছড়িতে ক্যাম্প সংখ্যা ২৫০-এ উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর সেনা ক্যাম্প কমানো হয়। যদিও অনেক ব্যক্তি মনে করেন, সেনা উপস্থিতি বাড়লেই নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে, তবুও অন্যরা আশঙ্কা করেন এতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই সেনা ক্যাম্প ও সেনা উপস্থিতি বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্থানীয় মতামত, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও মানবাধিকার বিবেচনা করে আসন্ন নীতি গ্রহণ করা উচিত।
সমস্যার মূলে আছে বহুমুখী ও জটিল ভূরাজনৈতিক অনুষঙ্গ-নির্দিষ্টভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপ ও সীমান্তসংলগ্ন রাজনৈতিক অবস্থা। তবে এ সংকটকে কেবল জাতিগত বা ধর্মীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলে বাস্তব সমাধান মিলবে না। এটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অংশগ্রহণমূলক নীতি-নির্ধারণের প্রশ্ন। বাংলাদেশের সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলকে ভিন্ন আইনি পরিচয়ে ভাগ করা হয়নি-সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত সমগ্র দেশের মানুষের সার্বিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
কর্তৃপক্ষ ও সমাজের ওপর এখন দায়িত্ব পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক বাতাবরণ পুনর্গঠন করা। এর মধ্যে রয়েছে তথ্যভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য নীতি প্রণয়ন; কৃষি, বনজ সম্পদ, ক্ষুদ্রশিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ; নারী ও তরুণদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন; সীমান্ত তত্ত্বাবধান উন্নতকরণ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ। এছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সন্ত্রাসবাদ ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তবে ওই ব্যবস্থা প্রমাণভিত্তিক তদন্ত ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে গ্রহণ করতে হবে।
রাজনৈতিক সংলাপ ও স্থানীয় অংশগ্রহণশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়াকে স্থায়ীভাবে রিপিয়ার করা সম্ভব। কিন্তু কেবল বন্দুকবলে নয়; সমাজিক ন্যায্যতা, বিচারপ্রাপ্তি ও সমবায়িক উন্নয়ন ছাড়া স্থায়ী শান্তি আনাটা অসম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের পরামর্শ হওয়া উচিত, পার্বত্য শান্তি নামক দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী কালো চুক্তি বাতিল করা অথবা পার্বত্য সমস্যার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে চুক্তি বা নীতি নবায়ন করা; যেখানে প্রয়োজন হলে ১৯৯৭ সালের চুক্তির দুর্বলতা শনাক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক, বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায্য কাঠামোর আওতায় নতুন সমঝোতা গঠন করা হবে।
জনগণের আস্থাভিত্তিক নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে শক্ত মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু ওই শক্তি প্রয়োগ মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; এখানে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি-সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার সমান। যে কোনো বিভাজনমূলক শব্দ বা ধারণা জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি; তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে মিলেই কাজ করতে হবে, যাতে পাহাড়ে নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও উন্নয়ন একসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে যে, সীমান্তের উভয় পাশে সংঘর্ষ-প্রবণতা ও স্বাধীনতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রয়েছে। তাই সীমান্ত তত্ত্বাবধান আরো জোরদার, গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার উৎস নির্ণয় ও সমাধান করা দরকার।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

























