আবু মকসুদ : শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একসময় আমার পছন্দের বিচারক ছিলেন, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ভদ্রলোকের আপসহীন মনোভাব তার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কিছু রায় আমি পড়েছি, সেগুলোতে মনে হয়েছে তিনি ন্যায়বিচারের প্রতি সত্যিকারের অনুগত ছিলেন। অপরাধীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী রায় দিয়েছেন। তার সেই সময়ের কাজগুলো ছিল সাহসী এবং ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পরিচায়ক।
তবে ২০১৫ সালে অবসরে যাওয়ার পর তার আচরণে পরিবর্তন আমাকে হতবাক করেছে। কেন এবং কীভাবে তিনি একজন সম্মানিত বিচারক থেকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলেন, তা আমার কাছে আজও অস্পষ্ট। আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির এমন বিবর্তন সত্যিই বিস্ময়ের, বিশেষ করে একজন মানুষ, যিনি একসময় ন্যায়ের প্রতীক ছিলেন। তার সাম্প্রতিক কার্যকলাপ তাকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন একজন প্রতিবন্ধী বলে মনে করিয়েছে, যিনি আর আগের সেই সম্মান ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে সক্ষম নন।
‘কুকুর তার মনিবের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে’—সেটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু মানুষ হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতি তার এই বিশ্বস্ততা এতটাই অন্ধ যে তিনি নিজের মানবিকতা ও বিবেক বিসর্জন দিয়েছেন। এই আনুগত্যের জন্য নিজের বিচারবোধ এবং নীতিকে বিসর্জন দিতে দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। একসময়ের এই শ্রদ্ধেয় বিচারক শেষ পর্যন্ত একজন মানসিক ভারসাম্যহীন রাজনৈতিক জোকারে পরিণত হয়েছেন। শেখ হাসিনার সান্নিধ্যে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেছে। তিনি হয়তো স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হবেন, কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনকে কলুষিত করার জন্য তিনি ইতিহাসে চিরদিন নিন্দিত হয়ে থাকবেন। তার এমন পরিণতি একটি দুঃখজনক অধ্যায়, যা একজন মেধাবী বিচারকের অসাধারণ অবদানকে ম্লান করে দিয়েছে। পরিণামে এই পরিবর্তিত সময়ে আমরা কী দেখলাম? আদালতে হাজির করার সময় পুলিশের হাতে থাকা অবস্থায়ই মানিক কিছু আইনজীবী ও জনতার হামলার শিকার হলেন।
এটা নতুন ঘটনা, তা কিন্তু মোটেই না। আগেও এমন হয়েছে। এই লেখার সঙ্গে আমি দুটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই-যার একটি ২০১৮ সালের, আরেকটি ২০২৪ সালের। ছয় বছর আগে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, আজ আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
২০১৮ সালে ভিন্নমত পোষণকারীদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপরও আক্রমণ হয়েছি। ঠিক তেমনি ২০২৪ সালে আওয়ামীপন্থি বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপরও একদল মানুষ আক্রমণ চালিয়েছে। মানিককে আদালতে তোলা হলে, সেখানেই একদল মানুষ তার ওপর কিল-ঘুষি এবং লাথি মেরে আঘাত করার চেষ্টা করে। এই ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সহিংসতা এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা এখনও পরিবর্তিত হয়নি। আওয়ামী লীগ যে ‘পুণ্য’ সঞ্চয় করেছিল—যা ছিল ভিন্নমতকে আক্রমণ করার মতো এক ধরনের পাপ—সেই পুণ্যই আজ তাদের কাছে ফিরে আসছে। আমি বহুবার বলেছি, প্রকৃতিতে কোনও কিছুই হারায় না, কোনও কিছু ভুলে যায় না। প্রকৃতি সবকিছুর গুনে গুনে হিসাব আদায় করে। ২০১৮ সালে মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে বিচারালয়ে যে অন্যায় করা হয়েছিল, তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমার এই মৃদু প্রতিবাদই তথাকথিত আওয়ামী দলান্ধদের আক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল; তারা তখন আমাকে ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়েছিল। এই ঘটনা এবং আজকের শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর হামলার ঘটনা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, আওয়ামী লীগ কতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তবে মনে রাখবেন, পাপ কখনও কাউকে ছাড়ে না। একে একে সব পাপের হিসাব তাদের দিতে হবে এবং প্রকৃতি কড়ায়-গন্ডায় সে হিসাব আদায় করবে।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক।