নেত্রকোনা সংবাদদাতা : পাহাড়ের মৃত ছড়ার একটি গর্ত থেকে এক কলসি পানি সংগ্রহ করে প্রশান্তির হাসি হেসে মল্লিকা মিচেং বললেন, ‘বেসিস্ত। ফানির হস্ত।’ যার অর্থ দাঁড়ায়, বেশি কষ্ট, পানির কষ্ট। প্রতিদিন ৩০ মিনিট পাহাড়ি পথ হেঁটে এখানেই পানি নিতে আসেন দুর্গাপুর উপজেলার বাডামবাড়ী গ্রামের ষাটোর্ধ মল্লিকা মিচেং। গর্ত থেকে চুইয়ে চুইয়ে বের হয় সামান্য পানি। সেই পানি বাটিতে তুলে একটু একটু করে কলস ভরেন তিনি। শীতকাল থেকে পাহাড়ে শুরু হয় পানির কষ্ট। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-মে ছয় মাস এই কষ্ট করেই চলতে হয় মল্লিকা মিচেংদের। খাবার পানি, ধোয়ামোছা এবং গোসলের পানির জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় প্রাকৃতিক উৎস পাহাড়ি ঝর্ণার ওপর। শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ ঝরনার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের পানি সংগ্রহ করতে হয় পাহাড়ি ছড়ার ময়লাযুক্ত ঘোলা পানি কিংবা টিলার নিচে তৈরি অগভীর কুয়া থেকে। অগভীর কুয়ায় চুইয়ে আসা পানি বাটিতে করে তুলে ছেঁকে কলসি ভরতে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘসময়। এভাবেই নিত্যকার পানি সংগ্রহে রীতিমতো সংগ্রাম চলে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা দুর্গাপুর-কলমাকান্দার গারো, হাজং অধ্যুষিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের। দুর্ভোগের শিকার বাডামবাড়ী, দাহাপাড়া, গোপালপুর, নলুয়াপাড়া, ভবানীপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, নিজেদের উদ্যোগে টিউবওয়েল এবং গভীর কুয়ো স্থাপন করলেও পানিতে অতিরিক্ত আর্সেনিকের কারণে ব্যবহার অনুপযোগী। যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের টিলাঘেরা চেংগ্নীর টেংরা টিলাপাড়া, বাঙ চাকুয়া, বাতানগ্রী, কনকোণা, ধলধলা পাড়ার বাসিন্দারা জানান, ওপারের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা চেংগ্নী ছড়ার ময়লাযুক্ত পানিই কাপড় দিয়ে ছেঁকে পান করতেন। কিন্তু এখন সেই সুযোগও পান না তারা। পাড়ার দরিদ্র বাসিন্দারা নিজেরা চাঁদা তুলে বন বিভাগের টিলার নিচে অগভীর কুয়া বসিয়ে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করছেন। এই অগভীর কুয়াতে বছরের ৬ মাস পানিই থাকে না। এ কারণে সে সময় চেংগ্নী ছড়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। একসময় সেই ছড়ার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে বলে ছড়ার উৎসমুখ জিরো লাইন থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে হয়। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা পাহাড়ি এলাকায় মাটির ৪০ থেকে ৫০ ফুট নিচে শক্ত পাথর থাকায় অন্যান্য এলাকার মতো গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। পাহাড়ে বসবাস করা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে বিকল্প উৎস হিসেবে পার্শ্ববর্তী গ্রামে গভীর নলকূপ স্থাপন করে উৎপাদন এবং পরীক্ষামূলক ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম চালু করার উপযোগিতা যাচাই-বাছাই চলছে। তিনি জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাস করা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।