প্রত্যাশা ডেস্ক : বহুল আলোচিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে জড়িত বাংলাদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার সংক্রান্ত তদন্তে নেতৃত্ব দেবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। প্রায় বছর পাঁচেক ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক এই বিষয়ে তদন্ত করলেও সম্প্রতি উচ্চ আদালতের এক আদেশে যৌথ দল গঠন করার কথা বলা হয়। পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে সিআইডির নেতৃত্বে যৌথ দল গঠন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ কারণে সিআইডির তদন্তের সঙ্গে দুদকের তিন জন কর্মকর্তাও যুক্ত থাকবেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি দুদক থেকে এ সংক্রান্ত নথিপত্র সিআইডিতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সিআইডির ইকোনোমিক ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবীর বলেন, আমরা আমাদের মতো করে অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম। ছয়টি টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার (৭ জুলাই) দুদক থেকে কিছু নথিপত্র পাঠানো হয়েছে। অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী আইনগত কার্যক্রম নেওয়া হবে।
২০১৬ সালের মে মাসে পানামা পেপার্স ও ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপার্স ফাঁসের পর দুনিয়া জুড়ে যেসব ব্যক্তিরা বিভিন্ন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়ছেন সেই তথ্য বেরিয়ে আসে। পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের ৬১ ব্যক্তি ও আটটি প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। মূলত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে তা বিদেশে পাচারের অভিযোগে তখন থেকেই অনুসন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথকভাবে অনুসন্ধান শুরু করে।
দুদক সূত্র জানায়, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশিদের নাম আসার পর ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল দুদকের উপ-পরিচালক আখতার হামিদ ভুঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। আলোচিত এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে তারা বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজাসহ অন্তত ১৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু ঘটনটি দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত থাকার কারণে তদন্ত অনেকটাই থমকে গিয়েছিল। কারণ অর্থপাচার আইন অনুযায়ী একমাত্র সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করতে পারে দুদক। একই সঙ্গে এই ঘটনায় একটি রিটের (১৪২৮/২০২১) আদেশেও উচ্চ আদালত থেকে যৌথ তদন্ত দল গঠন করতে বলা হয়।
সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাওয়ার পর সিআইডি থেকে ছয়টি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি তদন্ত টিমে দুদকের একজন করে মনোনীত কর্মকর্তা যুক্ত থাকার কথা রয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত সকল নথিপত্র এখনো দুদকের কাছ থেকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়নি। বুধবার (৭ জুলাই) কিছু নথিপত্র বুঝিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো শিগগিরই বুঝে নেওয়া হবে।
সিআইডি সূত্র জানায়, সিআইডির ছয়টি তদন্ত টিমের নেতৃত্ব দেবেন ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার আল আমিন হোসেন ও শেখ সুরাইয়া উর্মি, সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল আহসান, সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী আবু সাঈদ, ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিসানুল হক এবং ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন।
এদিকে দুদকের একটি সূত্র জানায়, আলোচিত এই ঘটনায় সিআইডির সঙ্গে যৌথ তদন্তে দুদকের তিন জন কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হয়েছে। তারা হলেন- সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেন, উপ-সহকারী পরিচালক সোমা হোড় ও কামিয়াব আফতাহি উন নবী। এছাড়া এ সংক্রান্ত সকল নথিপত্র সিআইডিতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দুদকের সর্বশেষ তদন্তের দায়িত্বে থাকা উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহীম জানান, ‘আমার কাছে যেসব নথিপত্র ছিল সব সিআইডিকে বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন সিআইডি এই ঘটনার তদন্ত করছে।’
পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে নামা আসা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- আওয়ামী লীগ নেতা জাফরুল্লাহ, তার স্ত্রী নীলুফার জাফরুল্লাহ, বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ফয়সল চৌধুরী, ওয়াই ফরিদা মোগল, শহীদ উল্লাহ, সামির আহমেদ, সিটিসেল-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরী, আইজিডাব্লিউ অপারেটর সেল টেলিকমের কফিল এইচ এস মুয়ীদ, এক্সেসটেল-এর মালিক জাইন ওমর, কিউবির অংশীদার আফজালুর রহমান, টেকনোমিডিয়ার সরকার জীবন কুমার, বাংলাট্রাকের আমিনুল হক ও তাঁর ছেলে নাজিম আসাদুল হক এবং তারিক একরামুল হক, সিটিসেল-এর সাবেক চেয়ারম্যান আজমাত মঈন, আব্দুল মোনেম গ্রুপের এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম, আসমা মোনেম, দিলীপ কুমার মোদি, মল্লিক সুধীর, কাজী রায়হান জাফর, মো. ইউসুফ রায়হান রেজা, মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী, বেনজির আহমেদ, ইসরাক আহমেদ, নভেরা চৌধুরী, সৈয়দা সামিনা মির্জা, উম্মে রুবানা, বিলকিস ফাতিমা, সালমা হক, ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, আবুল বাশার, নিজাম এম সেলিম, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, মোতাজ্জারুল ইসলাম, সেলিমুজ্জামান, সৈয়দ সিরাজুল হক, এফ এম জুবাইদুল হক, ক্যাপ্টেন এম এম জাউল, মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ, খাজা শাহাদত উল্লাহ, মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ, জুলফিকার হায়দার, মির্জা এম ইয়াহিয়া, নজরুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, এফ এম জুবাইদুল হক, এ এফ এম রহমাতুল বারী ও খাজা শাহাদাত উল্লাহ।
তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান ইনকর্পোরেশন, ইসলামিক সলিডারিটি শিপিং কোম্পানি বাংলাদেশ ইনকর্পোরেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল এজেন্সিস লিমিটেড, এসার বাংলাদেশ হোল্ডিং প্রাইভেট লিমিডেট ও টেলিকম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড, সেভেন সিজ অ্যসেটস লি., ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ (বারমুডা) লি. এবং টেরা বাংলাদেশ ফান্ড লিমিটেড, সোয়েন ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড, ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স লিমিটেড, ইউনোকল বাংলাদেশ লিমিটেডেরে একাধিক প্রতিষ্ঠান।
পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারি, তদন্তের নেতৃত্বে সিআইডি
জনপ্রিয় সংবাদ