বিদেশের খবর ডেস্ক: ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় দু’দেশের নাগরিকরাই এ নিয়ে কতটা প্রভাবিত এবং উত্তেজিত ছিলেন, সেটি আগেই দেখা গেছে। সামাজিক মাধ্যমগুলো এই সংঘাত নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য ও মিম তৈরি হয়েছে। এর আগে দক্ষিণ ভারতের শহর হায়দরাবাদভিত্তিক ‘করাচি বেকারি’ নামের একটি বিখ্যাত বেকারি প্রতিষ্ঠানের নামে কেন পাকিস্তানের শহর করাচি রয়েছে, এই প্রশ্ন তুলে দোকানে ভাঙচুর চালায় একদল ‘হিন্দুত্ববাদী’। এখন বিতর্ক আবার বেঁধেছে একটি জনপ্রিয় মিষ্টির নাম নিয়ে।
দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ‘মাইসোর পাক’ মিষ্টিটিতে ‘পাক’ শব্দটা আছে বলে এর নামই বদলে দিয়েছে রাজস্থানের জয়পুরের একটি মিষ্টির দোকান। ওই মিষ্টির নতুন নাম তারা দিয়েছে ‘মাইসোর শ্রী’।
সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ তো আবার বলছেন ‘মাইসোর পাক’-এর নাম বদলিয়ে ‘মাইসোর ভারত’ দেওয়া উচিত। আবার আরেকটি মিষ্টি- যার নাম ‘মোতি পাক’, সেটিরও নাম বদল করে ‘মোতি শ্রী’ রাখা হয়েছে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ- যারা মিষ্টির নামে ‘পাক’ শব্দটি আছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন। পাকিস্তানকে অনেক সময়ে সংক্ষেপে ‘পাক’ বলা হয়ে থাকে। তবে এ দুটি মিষ্টির সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্কই নেই। দুটিই ভারতের মিষ্টি।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে রাজস্থানের জয়পুরের অন্তত তিনটি বিখ্যাত মিষ্টির দোকান তাদের মিষ্টির নাম বদলিয়েছে, সেই সব মিষ্টির নামেই ‘পাক’ শব্দটা ছিল। ‘আম পাক’-এর নাম রাখা হয়েছে ‘আম শ্রী’, ‘গোন্ড পাক’ হয়েছে ‘গোন্ড শ্রী, ‘স্বর্ণ ভস্ম পাক’-এর নতুন নাম ‘স্বর্ণ শ্রী’ এবং ‘চণ্ডী ভস্ম পাক’-এর নাম বদলিয়ে হয়েছে ‘চণ্ডী শ্রী’।
জয়পুরের বৈশালী নগর এলাকার নামকরা মিষ্টির দোকান ‘তেওহার সুইটস্-এর মালিক অঞ্জলি জৈনকে উদ্ধৃত করে পিটিআই জানিয়েছে, মিষ্টির নামে যাতে জাতীয় অহং বোধ প্রতিফলিত হয়, সেজন্যই মিষ্টির নাম বদল।
জৈনের কথায়, দেশাত্মবোধের ভাবনা শুধু সীমান্তে থাকবে কেন, প্রত্যেক ভারতীয়র ঘরে আর মনে এই ভাবনাটা থাকা দরকার।
জয়পুরেরই আরেকটি মিষ্টির দোকান মালিক মোহিত জৈন ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, প্রতিদিনই ক্রেতারা এসে আমাদের বলছিলেন নাম বদল করার কথা। ‘পাক’ শব্দটা শুনতে তাদের অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই মাথা খাটিয়ে আমরা মিষ্টিগুলোর নামে একটা ভারতীয় পরিচয় আনতে চেয়েছি।
কেন মিষ্টির নাম ‘মাইসোর পাক’: নাম শুনেই বোঝা যায় যে মাইসোর পাক মিষ্টিটির ইতিহাসের সঙ্গে কর্ণাটকের মাইসোর বা মহীশূর রাজ্যের নাম থেকে এসেছে।
মহীশূর রাজ্যে ১৯০২ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করতেন মহারাজা নলওয়াড়ি কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ার। খাবারের ব্যাপারে খুবই শৌখিন ছিলেন এই রাজা। মাঝে মাঝেই তার বাবুর্চিদের দিয়ে নতুন নতুন খাবার বানাতেন তিনি।
একদিন দুপুরে তার খাস বাবুর্চি কাকাসুর মডপ্পা মহারাজার জন্য মিষ্টি বানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। খুব কম সময়ের মধ্যে কিছু একটা মিষ্টান্ন দিতেই হবে রাজার পাতে। তাড়াতাড়ি করে বানানো ওই মিষ্টিটাই পরে পরিচিত হয় ‘মাইসোর পাক’ নামে।
সেই বাবুর্চি-কাকাসুর মডপ্পার বংশধর এস নটরাজ বিবিসির সহযোগী সংবাদদাতা ইমরান কুরেশিকে বলেছিলেন প্রথমবার কীভাবে মাইসোর পাক তৈরি হয়েছিল। তার কথায়- মিষ্টি বানানোর জন্য মডপ্পা বেসন ও ঘিয়ের মধ্যে চিনির রস মেশান। মহারাজ যখন জানতে চেয়েছিলেন যে ওই মিষ্টির নাম কী, তখন মডপ্পা বলেন যে এটাকে পাকা বলা যায়, আর মাইসোরে বানানো হয়েছে; মহারাজাকে তিনি বলেন এটা ‘মাইসোর পাক’।
নটরাজ বলছেন, কন্নড় ভাষায় বেসনের সঙ্গে চিনির রস মিশিয়ে যে মিশ্রণ তৈরি করা হয়, তাকে পাকা বলা হয়। কিন্তু যখন এটাকে ইংরেজিতে বলা বা লেখা হয়, তখন আ’টা উচ্চারণ হয় না, তাই এই মিষ্টির নাম শুধুই ‘পাক’।
কর্নাটকের রামনগরা জেলার ওয়েবসাইটেও প্রথমবার ‘মাইসোর পাক’ তৈরির কাহিনীটা ঠিক এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। কাকাসুর মডপ্পার বংশধররা এখনো ‘মাইসোর পাক’ বানিয়ে থাকেন।
নটরাজ বলছিলেন, আমাদের চতুর্থ প্রজন্ম এখন মাইসোর পাক তৈরি করে। মহারাজাই আমাদের পূর্বপুরুষ মডপ্পাকে বলেছিলেন যে এই মিষ্টি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে হবে। সেভাবেই মাইসোর শহরের অশোক রোডে প্রথম দোকান খোলা হয়।
রামনগরা জেলার ওয়েবসাইট অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতে চিরাচরিতভাবে এই মিষ্টিটি বিয়ে এবং অন্যান্য উৎসবে খাওয়া হয়ে থাকে।
‘মাইসোর পাক’ বানানোর জন্য চিনির রস গরম করা হয়। তার মধ্যে এলাচ, গোলাপের জল, মধু ইত্যাদি মেশানো হয়। কয়েকজন বাবুর্চিই মাত্র এই চিনির রস বানাতে পারদর্শী। কোনো বাবুর্চি আবার নিজের কৌশলটা গোপন রাখেন।
‘পাক’ মানে কি পাকিস্তান: ‘পাক’ শব্দটা এসেছে সংস্কৃত থেকে, তবে এখন নানা ভারতীয় ভাষাতেই পাক শব্দটার প্রচলন আছে। আবার ফার্সিতেও ‘পাক’ শব্দের ব্যবহার আছে।
বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী ‘পাক’ শব্দটির একটি অর্থ হলো রন্ধন, রন্ধনকার্য এবং অগ্নিতাপে সিদ্ধকরণ। আবার পক্বতা বা শুভ্রতা বোঝাতেও পাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বাংলা ভাষায়। অন্য অর্থে পাক শব্দটি ঘূর্ণন, আবর্তন বা প্রদক্ষিণও বোঝায়। ভাষা বিশেষজ্ঞ অজিত ওয়াডনেকার ‘শব্দোঁ কা সফর’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। ভারতে ‘পাক’ শব্দটার উৎপত্তি নিয়ে তিনি লিখছেন, ভারতীয় সংস্কৃতিতে যখনই কোনো বস্তু আগুনের মধ্যে দিয়ে পোড়ায়, সেটাকে পবিত্র বলে মনে করা হয়। যখন কোনো ধাতু আগুনে দেওয়া হয়, তখন সেটা একটা সম্পূর্ণ অন্য বস্তুতে পরিণত হয়। কোনো ধাতু গলে গেলে সেটাকে ‘পক’ অর্থাৎ পবিত্র বলা হয়। এই ‘পক’ শব্দই রূপান্তরিত হয়ে ‘পাক’ হয়েছে।
অজিত ওয়াডনেকর বলছেন, পাক শব্দের ব্যবহার ভারত আর ইরানে দেখা যায়। আবার এর সঙ্গে কিছুটা মেলে, এমন একটি শব্দ জার্মান ভাষাতেও আছে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে ইরান বা ভারতে যে ‘পাক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, সেটা জার্মানি থেকে এসেছে বা সেখানকার শব্দটা ভারত বা ইরান থেকে গেছে। তার মতে, হিন্দি আর ফার্সি- দুই ভাষাতেই ‘পাক’ শব্দের মূল অর্থ হলো পবিত্র, শুদ্ধ বা নির্মল। হিন্দিতে পাক শব্দটার দুটো অর্থ আছে- রান্না করা এবং পবিত্র। তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ