ক্রীড়া ডেস্ক: ধ্রুপদী ক্রিকেট কী – এশিয়া কাপের এবারের ফাইনালে তা নান্দনিকভাবে দেখিয়ে দিলো ভারত। পাকিস্তানকে পাঁচ উইকেটে হারিয়ে ফাইনাল ট্রফি জিতলো এবারো।
শুভমন গিলের ক্যাচটা হ্যারিস রউফ মিড-অনে লাফিয়ে ধরার পরেই দুবাই স্টেডিয়ামের গ্যালারির দিকে ঘুরে গেল ক্যামেরা। স্তব্ধ, হতবাক ভারতীয় সমর্থকদের মুখ ইঙ্গিত দিচ্ছিল, তীরে এসে হয়তো তরী ডুবতে চলেছে। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছিল, ২০ রানের মাথায় তৃতীয় উইকেটটি হারিয়েছে ভারত। শেষ পর্যন্ত তরী ডুবলো না। টানা তৃতীয় বার পাকিস্তানকে হারালো এবং এশিয়া কাপ জিতে নিলো ভারত। তবে ফাইনাল হলো ফাইনালের মতোই। শেষ বল পর্যন্ত টান টান উত্তেজনার, রুদ্ধশ্বাস লড়াই। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও ভারতীয় দল দেখিয়ে দিল, তাদের কখনওই হিসাবের বাইরে রাখলে চলে না।
দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সপ্তদশ এশিয়া কাপ ফাইনালে উড়ন্ত সূচনা পেয়েছিল পাকিস্তান। ১১.২ ওভারে ১০০ রান তুলেও তারা চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে অলআউট হয় ১৪৬ রানে। তিলক ভার্মার ফিফটিতে ভর করে ২ বল হাতে রেখেই ভারত জয় নিশ্চিত করেছে।
যেকোনো ফরম্যাটে ভারতকে সর্বশেষ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে হারিয়েছিল পাকিস্তান। এরপর থেকে ভারতই কেবল শেষ হাসি (টানা ৮ ম্যাচে) হেসেছে। প্রথমবার এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয়েও সেই খরা কাটাতে ব্যর্থ সালমান আলি আগার দল। অবশ্য রোমাঞ্চকর এই মহারণের ফল এসেছে শেষ ওভারে। ৫ উইকেটের জয়ে নবম বারের মতো ভারত পরলো মহাদেশসেরার মুকুট ।
ভারতের ছন্দময় খেলা: এশিয়া কাপের ফাইনাল যেন রূপ নেয় নাটকীয় পতনের গল্পে। ১ উইকেটে ১১৩ রানে পাকিস্তান যখন অপ্রতিরোধ্য ভঙ্গিতে এগোচ্ছিল, তখনো কেউ ভাবেনি শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৪৬ রানে গুটিয়ে যাবে তারা। ৪৪ বল হাতে থাকা অবস্থায় পতন হয় বাকি ৯ উইকেটের। তাও আবার ধসটা হয়েছে মাত্র ৩৩ রানের ব্যবধানে! তার পরও আগের দুই লড়াইয়ের মতো সহজ হয়নি ম্যাচ। এবারের লড়াই ছড়িয়েছে রোমাঞ্চ। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচ শেষ ওভারে গিয়ে জিতেছে ভারত। ৫ উইকেটের জয়ে শিরোপা থাকলো তাদেরই হাতে। ভারত ১৪৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করেছে দুই বল হাতে রেখে।
শাহেবজাদা ফারহান ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে হাফসেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ভারতের বোলারদের চাপে ফেলে দিয়েছিলেন। কুলদীপ যাদবের প্রথম দুই ওভারে ২৩ রান নেন পাকিস্তানি ব্যাটাররা। চোটের কারণে হার্দিক পান্ডিয়ার না থাকা ভারতের জন্য ছিল উদ্বেগজনক।
কিন্তু হঠাৎ করেই সব বদলে যায়। ১৩তম থেকে ১৮তম ওভার পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ওভারে একটি করে উইকেট পড়তে থাকে পাকিস্তানের। কুলদীপ নিজের শেষ ওভারে একাই তিনটি উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন।
শেষ কাজটা সেরে দেন জসপ্রীত বুমরা। প্রথম স্পেলে পাকিস্তানি ব্যাটারদের সঙ্গে কথার লড়াইয়ের পর তিনি শেষ ওভারে হারিস রউফকে বোল্ড করেন। এরপর উদযাপনে কিছু পতনের ভঙ্গি করে রউফের আগের সপ্তাহের ইশারার জবাব দেন।
তবে ভারতের বোলিং আক্রমণের আসল নায়ক ছিলেন বরুণ চক্রবর্তী। চাপের সময়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পেল করেছেন তিনি। পাওয়ারপ্লেতে শুরুর আঘাত, এরপর ফারহানকে ফেরানো, আর মাঝপথে ফখর জামানকে আউট করে পাকিস্তানের ভরসার জায়গা ভেঙে দেন তিনি। ফারহান (৫৭) আর ফখর (৪৬) ছাড়া পাকিস্তানের আর কোনও ব্যাটার ১৫ রানও করতে পারেননি। ফারহানের ৩৮ বলের ইনিংসে ছিল ৫টি চার ও ৩টি ছয়। ফখরের ৩৫ বলের ইনিংসে ছিল ২টি চার ও ২টি ছয়।
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের ব্যাটিং ধসই ফাইনালের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। একসময় ম্যাচে এগিয়ে থেকেও এমন পতন যে কতটা হতাশাজনক, সেটা আবার প্রমাণ হলো দুবাইয়ের মঞ্চে।
কুলদীপ ৩০ রানে নেন ৪ উইকেট। দুটি করে নেন জসপ্রীত বুমরা, বরুণ চক্রবর্তী ও অক্ষর প্যাটেল।
তিলক বার্মা ও শিবাম দুবের অনবদ্য জুটি: ম্যাচের শুরুতে পাকিস্তান যেভাবে ব্যাটিং শুরু করেছিল, তাতে মনে হচ্ছিল- আজ বুঝি হাই স্কোরিং একটা ম্যাচ দেখতে পাবে ক্রিকেটপ্রেমীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাই স্কোরিংয়ে সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা ম্যাচটি পরিণত হলো লো স্কোরিংয়ে।
পাকিস্তানের করা ১৪৬ রানের সহজ ইনিংসটা পাড়ি দিতেও বেশ কষ্ট করতে হয়েছে ভারতকে। এক তিলক বার্মা যদি না দাঁড়াতেন, তাহলে জয়টা সম্ভব হতো না।
জয়ের জন্য ১৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ভারতীয় ব্যাটারদের শুরুতে বেশ চেপে ধরেছিল পাকিস্তানি বোলাররা। ২০ রানেই সেরা তিন ব্যাটার- অভিষেক শর্মা, শুভমান গিল ও সূর্যকুমার যাদবকে ফিরিয়ে দেন ফাহিম আশরাফ এবং শাহিন আফ্রিদি।
এ পরিস্থিতিতে ধুঁকতে থাকা ভারতকে টেনে তোলার দায়িত্ব নেন তিলক বার্মা এবং সাঞ্চু স্যামসন। এ দু‘জনের ৫৭ রানের জুটিতেই গড়ে ওঠে ভারতের জয়ের স্বপ্ন। একটি ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে সাঞ্জু স্যামসন সাহিবজাদা ফারহানের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান। ২১ বলে ২৪ রান করেন তিনি।
এরপর জুটি বাধেন তিলক বার্মা ও শিবাম দুবে। এ দু‘জনের ব্যাটে গড়ে ওঠে ৬০ রানের অনবদ্য এক জুটি। তাতেই নিশ্চিত হয়ে যায় ভারতের জয়। শেষ মুহূর্তে শিবাম দুবে ২২ বলে ৩৩ রান করে আউট হয়ে গেলে বাকি কাজ সারেন তিলক বার্মা এবং রিঙ্কু সিং।
পাকিস্তানি বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বাজে এবং খরুচে ছিলেন হারিস রউফ। কোনো উইকেট তো পান‘ইনি। উল্টো প্রথম তিন ওভারে দিয়েছিলেন ৩৭ রান। সেই হারিস রউফের কাঁধেই শেষ ওভারে ১০ রান রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন অধিনায়ক সালমান আগা। কিন্তু একটি করে বাউন্ডারি আর ছক্কা হজম করে ২ বল বাকি থাকতেই ভারতকে জয় উপহার দেন হারিস।
৫৩ বলে ৬৯ রানে অপরাজিত থাকেন তিলক বার্মা। ৩টি বাউন্ডারির সঙ্গে ৪টি ছক্কার মার মারেন তিনি। ফাইনাল সেরা পুরস্কারও ওঠে তিলক বার্মার হাতে।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান ১৯ ওভারে ১৪৬ রান করে অলআউট হয়। দুই ওপেনার সাহিবজাদা ফারহান ও ফাখর জামান ৯.৪ ওভারে গড়েছিলেন ৮৭ রানের জুটি। এরপরই পতন শুরু হয় পাকিস্তানের। শেষ পর্যন্ত ১৪৬ রানে অলআউট। ৫৭ রান করেন ফারহান। ৪৬ রান করেন ফাখর জামান। কুলদিপ যাদব নেন ৪ উইকেট।
সানা/আপ্র/২৯/০৯/২০২৫