প্রত্যাশা ডেস্ক: জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের নয় মাস পর প্রথমবারের মত দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠ শোনা গেল ইন্টারনেটে। ৫ আগস্ট সরকারপতনের দিন কীভাবে স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচ ঘণ্টা এক বাড়ির বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন, সেই গল্প ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দি ওয়াল নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রী।
তার ভাষ্য, সরকারপতনের পরও তিন মাস তিনি দেশে ছিলেন। পরে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা গ্রেফতার হলেও কাদের কীভাবে দেশ ছাড়তে পারলেন, সাক্ষাৎকারে তিনি সেটা খোলাসা করেননি। ওবায়দুল কাদের স্বপ্ন দেখেছেন, সময় এলে তারা আবারও দেশে ফিরবেন, আওয়ামী লীগও আবার ক্ষমতায় ফিরবে। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় বা জুলাই অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে যা ঘটে গেছে, সেজন্য ভারতে বসে ক্ষমা চাইতে তিনি রাজি নন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমন-পীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মত ওবায়দুল কাদেরের নামেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি সেই বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ দল এবং ওবায়দুল কাদের সেই দলের পলাতক এক নেতা, যার মাথার ওপর কয়েকশ হত্যা মামলা ঝুলছে।
কাদেরের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য ওয়াল নিউজের এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকার। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তার সেতুমন্ত্রী কাদের এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেন। অমল সরকারের প্রশ্নের উত্তরে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে কাদের বর্ণনা করেন ‘ষড়যন্ত্রমূলক ছাত্র উত্থান’ হিসেবে। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই ভাগ্যবান, সেদিন আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। মৃত্যু থেকে অনেক কাছে ছিলাম।’
কাদের বলেন, ঢাকায় জাতীয় সংসদ এলাকায় যে বাসায় তিনি থাকতেন, সেখান থেকে পাশের আরেকটি বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি এবং তার স্ত্রী। চারদিক থেকে মিছিল আসছিল।
শুরুতে মিছিলগুলো গণভবনকেন্দ্রিক থাকলেও পরে সংসদ এলাকাতেও তা ছড়িয়ে পড়ে, যা দেখে অবাক হওয়ার কথা বলেছেন কাদের। তার ভাষায়, সেটা কোনো রাজনৈতিক অভ্যুত্থান নয়, ‘লুটপাটের অভ্যুত্থান’ ছিল।
‘আমি যে বাসাটায় ছিলাম, তারা সে বাসাতেও হামলা করে। তবে তারা জানতো না যে সেখানে আমি আছি। আমার বাসায় তারা লুটপাট করেছে। কিন্তু যে বাসায় আমি গিয়ে আশ্রয় নিলাম, সেখানে তারা হামলা করবে এটা আমি ভাবতে পারিনি। কিন্তু সেখানেও দেখলাম যে অনেক লোকজন ঢুকল পরে এবং তারা ভাঙচুর লুটপাট করতে থাকে। আমি আমার স্ত্রীসহ আমরা বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ছিলাম, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তারপর একটা পর্যায়ে এরা তো ওই বাথরুমের ভেতর, সেখানেও কমোড, বেসিন এগুলো তো লুটপাট করেছে সবই।’
কাদের বলেন, ‘প্রথমত তাদেরকে আমার ওয়াইফ, সে বাথরুমের মুখে দাঁড়িয়ে বারবার বলছিল যে আমি অসুস্থ, এ কথা বলে তাদের ফিরিয়েছে। একটা পর্যায়ে তারা বাথরুমে যেগুলো আছে সেগুলো লুট করার জন্য জোরপূর্বক প্রবেশের হুমকি দেয়। সে সময় আমার ওয়াইফ জিজ্ঞেস করে যে কী করব? আমি বলি খুলে দাও যাও। তারপরে সাত আট জন ছেলে ঢুকল। তারা খুবই আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভঙ্গি নিয়ে। তখন হঠাৎ তারা আমার দিকে তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে ‘নেত্রী চলে গেল, আপনি যাননি কেন’। আমি কিছু বলছিলাম না।
সাবেক এই মন্ত্রীর ভাষ্য, ‘তারপরে এই ছেলেদের মধ্যে কী ভাবের উদয় হয়েছে জানি না। তারা আমাকে বলে আপনার ছবি তুলব। তারপর আমার ছবি তুলতে শুরু করল। সেলফি নিচ্ছিল, ছবি তুলেছিল। এরা ছাত্র, অনেকে আমাকে চিনতো। কী কারণে তারা.. আক্রমণাত্মক যে মনোভাবটা ছিল, সেটা নিমেষে শীতল হয়ে গেল। ঠান্ডা মাথায় কথা বলছিল। এদের মধ্যে আবার একটা গ্রুপ তারা চেয়েছিল আমাকে রাস্তায় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে। কেউ কেউ আবার এটাও চেয়েছিল যে জনতার হাতে তুলে দিতে। এটা অবশ্যই তখন একটা মানসিকভাবে ভেতরে ভেতরে খুব ভেঙে পড়েছিলাম।’
কীভাবে সেখান থেকে বের হলেন, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে কাদের বলেন, ‘এরপর এরা এদের একটা শার্ট, এদের ওই ব্যাজ, লাল পতাকা শোভিত ব্যাজ লাগিয়ে আবার কালো একটা মুখে একটা মাস্ক দিয়ে আমাকে হাঁটতে হাঁটতে সংসদ এলাকা থেকে বড় রাস্তায় গণভবন অভিমুখী রাস্তায়, ওখানে নিয়ে যায়। হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা ট্যাক্সি আসে। ইজি বাইক। সেটা খালি ছিল। ওখানে কোনো গাড়ি ঘোড়া কিছুই ছিল না। ‘ওটা হঠাৎ করে কেন যেন এসে পড়ল। হয়তো আমার ভাগ্য। এরা দুজনে আমাকে নিয়ে আমার ওয়াইফকে নিয়ে ওটাতে উঠল। আর বলতে লাগল…পথে তো অসংখ্য মানুষ, চেকআপ চেকআপ সব জায়গায়; এরা বলতে লাগল যে ‘আমাদের চাচা চাচি অসুস্থ। হাসপাতালে নিচ্ছি। ডিস্টার্ব করবা না।’ এই করে করে নিয়ে গেল অনেক দূরে একটা জায়গায়।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তো এটা হলো ভাবতেও পারিনি ওরা যখন বাথরুমে ঢুকল যে বেঁচে থাকব। বেঁচে থাকাটাই সেদিন যে একটা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আনএক্সপেক্টেডলি বেঁচে গেছি। মোস্ট ইমপরটেন্ট, সে সময় যে কোনোভাবে আমাদেরকে আর্মির হাতে তুলে দিতে পারতো। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ। সেখানে অনেকেই তো আছে আমাদের অপজিশন, মেরে ফেলতে পারতো।’
এরপর ওবায়দুল কাদের কোথায় ছিলেন, তা জানতে চেয়েছিল দ্য ওয়াল নিউজ। জবাবে তিনি বলেন, তিন মাসের মতো তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। ‘আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। যে ওখান থেকে কিছু করা যায় কিনা। কিছু একটা করা যায় কিনা। সংগঠিত করা যায় কিনা। বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ, কর্মচারীদের অসন্তোষ। এগুলো প্রতিদিনই লক্ষ্য করতাম। লোকগুলো তখন রাস্তায় নেমে আসছিল। বিশেষ করে গার্মেন্টস। তো সেই সময় ভাবলাম যে নেত্রীর সাথে যোগাযোগ করে কিছু করা যায় কিনা। এই চিন্তাতেই তিন মাস পড়ে থাকলাম। ‘এর পরে একে একে সবাই অ্যারেস্ট হচ্ছে, আমি তো নেত্রীর পরের স্থানটায়। তখনই ২১২টা খুনের মামলার আমি আসামি হইছি। তারপর এ অবস্থা, অনেকেই বলল, আবার এখান থেকেও অনেক অনুরোধ যাচ্ছিল, আমি যেন সতর্কভাবে এদিকে চলে আসি। এভাবে চিন্তা করলাম যে আসলে আমার বাইপাস সার্জারি হয়েছে, অনেকগুলো ওষুধ খেতে হয়, আমি এখানে ধরা পড়লে ওষুধ খাওয়াবে কে? অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করে…।’
ওই ছেলেগুলো কোথায় পৌঁছে দিলো? ওরা কি সেটা ফাঁস করে দেয়নি? বাংলাদেশে থাকতে কোনো সমস্যায় কি পড়তে হয়নি? এসব প্রশ্নও অমল সরকার করেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরে কাদের বলেন, ‘আমি রাতেই ওখান থেকে আবার সরে গেছি।’ অমল সরকার তখন প্রশ্ন করেন, ‘এই যে ছেলেগুলো এরকম করলো, এটার কারণ কী? আপনার প্রতি যে ওরা সদয় হলো, আপনাকে কেন বাঁচালো? মানে এটা কি হতে পারে যে এরা আওয়ামী লীগেরই, তাৎক্ষণিকভাবে ওই সময় বিক্ষুব্ধ ছিল, এরকম হতে পারে?’ জবাবে কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের হলে তো আমি চিনতাম।’
জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মাঠে নামানোর ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়েও তাকে প্রশ্ন করা হয় সাক্ষাৎকারে। উত্তর দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন, ছাত্রলীগকে অভ্যুত্থান দমানোর কথা তিনি ‘কখনো বলেননি’। কাদেরের ভাষ্য, তার ওপর ‘সময় আরোপিত’ দায়িত্বই তিনি পালন করেছেন। ‘অন্য যে কেউ’ সেটাই করতো।
অমল সরকার জানতে চান, ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ কি বুঝতে পারেনি যে তাদের বিরুদ্ধে এরকম একটি জনমত তৈরি হয়েছে? জবাবে কাদের ছাত্রদের সেই আন্দোলনকে বর্ণনা করেন ‘একটা ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা, একটা বিস্ফোরণ’ হিসেবে। তার ভাষায়, এক দিনের পরিকল্পনায় এটা ঘটেনি। ‘সেটা ইন্টেলিজেন্সের একটা ব্যর্থতা তো ছিল, এটা ব্যর্থতা ছিল না এ কথা তো বলা যায় না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদের দায় নিচ্ছেন কি না, তা জানতে চেয়েছিল দ্য ওয়াল নিউজ। জবাব তিনি বলেন, ‘আমার নেত্রী যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে আমি কাজ করেছি। এখন জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে আমার ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। আই এম নট ইমিউন ফ্রম মিস্টেকস। মানুষের ভুল হবে। সে ভুল ত্রুটি আমারও থাকতে পারে।’
নির্বাচনে অনিয়ম, মানবাধিকার হরণ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি-ইত্যাদি নানা অভিযোগ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে। এত বড় ঘটনার পর আওয়ামী লীগ ভুল স্বীকার বা দুঃখ প্রকাশ করেনি। এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অমল সরকার। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশকে যা কিছু দিয়েছে, শেখ হাসিনা যা কিছু করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না’।
অমল সরকার তখন বলেন, ‘একটা বিষয় অনেকেই বলছেন এই যে আপনি দীর্ঘদিন নীরব ছিলেন। বলা হচ্ছে যে আপনার ভুল ত্রুটির কারণে আপনাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। মানে এটা কাইন্ড অফ পানিশমেন্ট আর কি।’
উত্তরে কাদের বলেন, ‘কিছু লোক আছে তারা এসব বলে শান্তি পায়। তাদের একটা সুখানুভূতি আছে। আমাকে তিন তিনবার সেক্রেটারি করলো। এটাও অনেকের পছন্দ হওয়ার তো কথা না। আমাদের মতো পার্টিতে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা ছিল। এখনো আছে। আমি যখন হয়েছি তখনও ছিল। কাজেই এটা অবাস্তব কোনো কিছু না।’
কাদের দাবি করেন, ভারতে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা নিজেই তাকে খুঁজেছেন। ‘উনি সবচেয়ে বেশি ওরিড ছিলেন আমার অসুস্থতার জন্য। তিনি ভেবেছেন এই অবস্থায় আমি দেশে ছিলাম। বলেন যে ‘তুমি টোটাল চেকআপ করো। এখন তোমার অন্য কিছু করতে হবে না। পারলে কিছু লেখো। ৭১ থেকে, এদেশ নিয়ে লেখো। সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ নিয়ে তোমার চোখে যা দেখেছ, এগুলো নিয়ে লেখালেখি করো, কখন কি করতে হবে আমি বলব’।
‘আমি উনার সঙ্গে কখনো দেখা করতে চেষ্টা করিনি। উনি যেখানে আছেন, হাই সিকিউরিটি জোনে। সেখানে আমি কেন যাবো? উনি যখন প্রয়োজন তখন আমাকে বলবেন।’
অমল সরকারের প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, তারা আবার দেশে ফিরবেন, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরবে, শেখ হাসিনা আবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন-এ বিষয়ে তিনি ‘শতভাগ আশাবাদী’।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ যে সেভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি, সেটা ওবায়দুল কাদেরকে মনে করিয়ে দেন অমল সরকার।
কাদের তখন বলেন, ‘ভারত আমাদের দুঃসময়ের বিশ্বস্ত বন্ধু, সংকটে আমরা বারবার ভারতের কাছে ছুটেছি। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই। আমরা কারো বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিচ্ছি না, কারো সমালোচনা করছি না। ‘এখন আমাদের দেশকে, যেখান থেকে আমরা বাংলাদেশে স্থানচ্যুত হয়েছি, যেখান থেকে আমরা দেশের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, সেই শিকড়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এই আমাদের চিন্তা।’
অমল সরকার তখন বলেন, ‘কিন্তু তার জন্য তো মানে দেশবাসীর কাছে ন্যূনতম নিজেদের ভুল স্বীকার করতে হবে…।’
জবাবে কাদের বলেন, ‘ভারতে বসে আমি এ ক্ষমা প্রার্থনা কেন করব। আমি দেশে গিয়ে আমার ভুলের জন্য… আমার ভুল ত্রুটি হলে সেটার জন্য আমাদের নেত্রী আছেন, তিনিই দেশবাসীকে বলবেন। এখান থেকে বলা কি ঠিক?’