মো. বোরহানুল আশেকীন : আপনি কাঁচাবাজারে গিয়েছেন বাজার করতে। আলু, বেগুন, পটল, মরিচসহ অন্যান্য কাঁচাবাজার কিনলেন, দোকানদার সেগুলো দিলো বেশ কয়েকটি পলিথিন ব্যাগে। এরপর গেলেন মাছ বা মাংসের দোকানে। সেখান থেকে মাছ বা মাংস কেনার পর, সেগুলো দেওয়া হচ্ছে পলিথিন ব্যাগে। এরপর আপনি গেলেন মুদি দোকানে। সেখান থেকেও পণ্য কেনার পর তা দেওয়া হচ্ছে পিলথিন ব্যাগে। এভাবে আপনি বেশ কয়েকটি পলিথিন ব্যাগ বাসায় নিয়ে এলেন। এ রকম হয়তো আপনি বাজার করছেন মাসে কয়েকবার।
ভাবুন তো কতগুলো পলিথিন ব্যাগ আপনি বাসায় নিয়ে আসছেন? আর পলিথিন ব্যাগগুলো ব্যবহারের পর চলে যাচ্ছে ডাস্টবিন বা ময়লার ভাগাড়ে। সেখান থেকে পলিথিন ব্যাগ চলে যাচ্ছে সুয়ারেজ লাইনে, নদী, খাল-বিল থেকে সাগরে। অথচ আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখেছি বাবা বাজারে যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে বাজারের ব্যাগ চাইতো। সেই ব্যাগ বাসাতেই তৈরি করা হতো। মা পুরাতন কাপড় দিয়ে সেই ব্যাগগুলো তৈরি করতেন। বাবা সেই ব্যাগে বাজার করে আনার পর মা ব্যাগটি ধুয়ে দিতেন, যাতে পরবর্তীকালে সেটি আবারও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখন এই চিত্র আর দেখা যায় না। কারণ আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। আর এটি পরিবর্তন করেছে পলিথিন ব্যাগ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা এসডোর গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের একটি পরিবার গড়ে প্রতিদিন ৫টি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছেন। এছাড়া ২.৫ কোটি একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ব্যাগ ঢাকা শহরে ফেলে দেওয়া হয় ব্যবহারের পর। এসডোর ২০১৯ সালের গবেষণা বলছে, দেশে বছরে সাতাশি হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। যা পরিবেশ দূষণকে ত্বরান্বিত করছে।
১৯৯৫ সালে প্রণয়ণ করা হয় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন। পরে ২০০২ সালে এই আইনে বেশ কয়েকটি ধারায় সংশোধন আনা হয়। যেখানে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির ওপর বাধা-নিষেধ দেওয়া হয়। আইনে উল্লেখ করা হয়, সরকার, মহা-পরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনোভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যে কোনো প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ বা পলিইথাইলন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্যকোনো সামগ্রী বা অন্য যে কোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাহা হইলে, সরকারি গেজেটের প্রজ্ঞাপন দ্বারা, সমগ্র দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করিবার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওইসব কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করিতে পারিবে এবং উক্ত নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাধ্য থাকিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত নির্দেশ নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না, যথাÑ ক. উক্ত প্রজ্ঞাপনে বর্ণিত সামগ্রী রফতানি করা হইলে বা রফতানির কাজে ব্যবহৃত হইলে। খ. কোনো নির্দিষ্ট পলিথিন ব্যাগের ক্ষেত্রে উক্ত নির্দেশ প্রযোজ্য হইবে না মর্মে উক্ত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হইলে। আর এই আইন ভঙ্গ করলে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এছাড়া অনধিন ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
২০০২ সালে বাংলাদেশই বিশ্বের মধ্যে প্রথম ছিল, যে দেশ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার ও উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আইন প্রয়োগে শিথিলতার কারণে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ও উৎপাদন হয় লাগামছাড়া। ফলে দেশের বিভিন্ন নদীতে জমে কয়েকস্তরের পলিথিন ব্যাগ। প্লাস্টিক কণা পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে। তবে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি আবারও যাতে কঠোরভাবে প্রয়োগ হয় সেজন্য উদ্যোগ নিয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে নিষিদ্ধ হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ আর পহেলা নভেম্বর থেকে বন্ধ হচ্ছে কাঁচাবাজারে। ওইদিন থেকেই চলবে উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান।
সরকারের এই উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পলিথিন ব্যাগের বিকল্প কী হবে? বলা হচ্ছে পাটের, কাপড়ের বা কাগজের ব্যাগ হবে বিকল্প। কিন্তু এই বিকল্পগুলো কী জনসাধরণের হাতের নাগালে পাওয়া যাবে? বিকল্পগুলো কী সহজলভ্য হবে? এছাড়া দোকানে গেলে সহজেই দোকানদার পলিথিন ব্যাগ ধরিয়ে দেয়, সেই মানসিকতার পরিবর্তন কী পরিবর্তন হবে?
হয়তো আইন দিয়ে কিছু সময়ের জন্য উৎপাদন বা ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব হবে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের জন্য আনতে হবে মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন। এই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে কাজে লাগানো যেতে পারে তরুণ প্রজন্মকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের। সময় বলে দেবে সরকারের এই মহৎ উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে আশাহত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। আমরা যদি নিজেদের অবস্থান থেকে এই বিষয়ে সচেতন হই, বাপ-দাদাদের আমলের মতো মানসিকতা তৈরি করে তবে, অবশ্যই বাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী