মো. সোহান হোসেন : পর্যটন বা ট্যুরিজম বলতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষের ভ্রমণকে বোঝায়, যা সাধারণত বিনোদন, অবকাশ যাপন, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা অর্জন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও) অনুযায়ী ‘পর্যটন’ বলতে বোঝায় এমন সব কর্মকাণ্ড, যেখানে কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক পরিবেশের বাইরে ভ্রমণ করেন এবং সেখানে একটানা এক বছরের কম সময় অবস্থান করেন।
এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য হতে পারে অবকাশ, ব্যবসা বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য। তবে এটি সেসব ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য নয়, যারা সেই স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস বা আয়ের জন্য কাজ করতে যান। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন গড়ে উঠেছে হাজার হাজার পর্যটনকেন্দ্র। এসব পর্যটনকেন্দ্র থেকে উপার্জিত হচ্ছে লক্ষ থেকে কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নয়নশীল ও সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে পর্যটন খাত; যেখানে দেশের অর্থনীতিতে অবদান প্রায় ৩-৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে কক্সবাজার, সুন্দরবন, সেন্টমার্টিন, রাঙামাটি, সিলেটের চা-বাগানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্থান রয়েছে, যা পর্যটন খাতের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং আগামী সময়েও করবে বলে আমরা আশাবাদী। বর্তমানে বিভিন্ন উৎসের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩০০ থেকে ৩৫০টি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে; যা সরকারিভাবে স্বীকৃত ও জনপ্রিয়। যেখান থেকে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।
আমরা যদি একনজরে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর কথা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, ফ্রান্স বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটকপ্রিয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। তাদের অর্থনীতির প্রায় ৯ থেকে ১০ শতাংশ আসে পর্যটনশিল্প থেকে। আবার স্পেনের জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ আসে ট্যুরিজম থেকে। এটি ইউরোপের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। একইভাবে ইতালির অর্থনীতির প্রায় ১৩ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। আবার থাইল্যান্ডের অর্থনীতির প্রায় ২০ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশ ট্যুরিজম থেকে আসে। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় পর্যটনকেন্দ্র।
এদিকে মালদ্বীপের মোট অর্থনীতির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। এটি পর্যটনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল দেশ। পৃথিবীর বিখ্যাত দেশগুলো পর্যটনকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে শুধু সঠিক পরিকল্পনা ও পর্যটন খাতের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত মোট ১৫০টির অধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে ৩০টির অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যটনবিষয়ক চার বছরের অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। প্রতিবছর সেখান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাস করে দেশের বিভিন্ন চাকরিক্ষেত্রে চাকরির জন্য বারবার আবেদন করেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছেন না। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত আলোচনা করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশে পর্যটনবিষয়ক অনেক চাকরির ক্ষেত্র রয়েছে। কিন্তু সেখানে সবাই চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের জন্য শিক্ষার্থীরা অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করছেন, তাদের আলাদা করে মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই কেন? তারা যে মোট পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে পর্যটন বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করলেন, এটা কোথায় কাজে লাগাবেন? আর যদি তাদের পর্যটনবিষয়ক চাকরি না হয়, তাহলে এই পাঁচ বছর জ্ঞান আহরণের কী প্রয়োজন ছিল?
আমরা জানি, বাংলাদেশের সরকারি চাকরির মধ্যে সবচেয়ে ভালো চাকরি ধরা হয় বিসিএস ক্যাডারকে। এখানে সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়ে মেধার মাধ্যমে চাকরি অর্জন করে নিতে পারেন। কিন্তু আমরা যদি একটু লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব, এই বিসিএস ক্যাডার পদে পর্যটনবিষয়ক নানা পদ রয়েছে। কিন্তু যারা পর্যটনের বিষয়ে অভিজ্ঞ নন, তারাও বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সেই পদে চাকরি করছেন। আমরা যদি একটু লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার, বিসিএস বাণিজ্য ক্যাডার ও বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে পর্যটনবিষয়ক পদে সবাই বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমেই চাকরি অর্জন করছেন। বাংলাদেশের জেলা প্রশাসক ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যটনবিষয়ক একটি করে পদ থাকে। সেখানেও বিসিএস এর মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পর্যটনকেন্দ্রিক সব চাকরিতে সবাই আবেদন করতে পারেন। তাহলে পর্যটনে পাঁচ থেকে ছয় বছর লেখাপড়ার আসলে মূল্যায়ন কোথায়?
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ আর এই উন্নয়নের ধারা টিকিয়ে রাখতে হলে চাই পর্যটন খাতে সঠিক ব্যবস্থাপনা। এই সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন সঠিক মানুষ বা কর্মী। একজন পর্যটনবিষয়ক শিক্ষার্থীর পাঁচ থেকে ছয় বছরে পর্যটন বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, ওই একই পরিমাণ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে অতিরিক্ত তিন বছর লাগবে। তাহলে চাকরিতে অবস্থান করে তারা কি আট বছর ধরে পর্যটন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন? যদি একজন পর্যটন বিষয়ের শিক্ষার্থী চাকরিটা পান, তাহলে এ সমস্যা হতো না।
আমরা যদি বাংলাদেশের অন্যান্য চাকরির খাতগুলো আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, যারা মেডিকেল থেকে পড়াশোনা করেন, তারাই কেবল চিকিৎসক হতে পারেন। যারা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেন, তারা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেন। আবার যারা বাংলা, ইংরেজি, ইসলাম শিক্ষা, ইসলামি ইতিহাস, অর্থনীতি থেকে পড়াশোনা করেন, তারা ওই বিষয়ের শিক্ষক হতে পারেন। কিন্তু পর্যটনের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য কেন?
পর্যটনে নেই কলেজ পর্যায়ে কোনো শিক্ষক নিবন্ধন, নেই শিক্ষা ক্যাডারের মতো একটি ভালো ক্যাডারে পর্যটনবিষয়ক শিক্ষার্থীদের কোনো জায়গা। তাহলে পর্যটনের শিক্ষার্থীদের জায়গা রইল কোথায়? তাই এখন সময়ের দাবি, পর্যটনের যেসব কাজে পর্যটন বিষয়ক নিয়োগ প্রয়োজন, সেগুলোয় পর্যটনবিষয়ক শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া। তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে। এমনও হতে পারে যে, বাংলাদেশ একদিন পর্যটননির্ভর দেশ হবে। আর এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও সঠিক জনবল। তাই বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বিসিএস অনুমোদিত প্রশাসনের কাছে এখন সময়ের দাবি, পর্যটন খাতের সব চাকরিতে পর্যটনের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া। তাহলে পর্যটনে যে পরিমাণ বাজেট ঘোষণা করা হয়, তা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া