প্রত্যাশা ডেস্ক : দীর্ঘ সাত দশক ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতভক্তদের সুরের মায়াজালে বেঁধে রেখে চিরবিদায় নিলেন কিংবদন্তি শিল্পী সুরসম্রাজ্ঞী ভারতরতœ লতা মঙ্গেশকর। ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেলেন পরলোকে। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কোকিলকণ্ঠী এই শিল্পী। গতকাল রোববার সকালে সেখানেই তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে পিটিআই। গত শতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করা লতা অল্প সময়েই হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য একটি নাম।
গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার বলেছিলেন, “মাইকেল অ্যাঞ্জেলো মানেই যেমন চিত্রকলা, শেক্সপিয়ার মানেই যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনই ভারতীয় সিনেমার গান মানেই লতা মঙ্গেশকর।”
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও তিনি গান করেছেন। অনেকের বিচারে ভারতের সর্বকালের সেরা সংগীত শিল্পীদের একজন তিনি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে পর গত ১১ জানুয়ারি ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরকে। করোনাভাইরাসমুক্ত হওয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার তাকে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়। গত শনিবার সন্ধ্যায় তাকে দেখতে হাসপাতালে যান বোন আশা ভোঁসলে। বলিউডের আরেও অনেকেই ছুটে যান এই মহাতারকার খোঁজ নিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই জানান শুভকামনা। কিন্তু সবাইকে শোকে ভাসিয়ে রোববার সকালে চিরবিদায় নিলেন এ শিল্পী। ভারতরতœ লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় : সুরসম্রাজ্ঞী ভারতরতœ লতা মঙ্গেশকরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষ সেখানেই এই কোকিলকণ্ঠীর দাহকাজ সম্পন্ন হয়। লতা মঙ্গেশকরের বড় ভাইয়ের ছেলে আদিত্য মঙ্গেশকর তার মুখাগ্নি করেন।
দীর্ঘ সাত দশক ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতানুরাগীদের সুরের মায়াজালে বেঁধে রাখা কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর রোববার চিরবিদায় নেন। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই শিল্পী। রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৯টার দিকে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। হাসপাতাল থেকে লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহ প্রথমে তার বাড়ি ‘প্রভুকুঞ্জে’ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে শেষ বিকালে শিবাজি পার্কের দিকে শবযাত্রা শুরু হয়।
লতা মঙ্গেশকরের বোন ভারতের সংগীত জগতের আরেক কিংবদন্তি আশা ভোশলে, উষা মঙ্গেশকরসহ মঙ্গেশকর পরিবারের সদস্যরা শিবাজি পার্কের পথে তার সঙ্গী হন।
প্রায় আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্থানীয় সময় পৌনে ৬টার দিকে ভারতের জাতীয় পতাকায় ঢাকা লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহ শিবাজি পার্কে পৌঁছায়। সেখানে দুপুর থেকেই হাজার হাজার ভক্ত তাদের প্রিয় লতাদি কে শেষবিদায় জানাতে অশ্রুসিক্ত নয়নে অপেক্ষায় ছিলেন। পার্কে বাজছিল লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া কালজয়ী সব গান।
লতা মঙ্গেশকরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক, বলিউডের তারকারা একে একে শিবাজি পার্কে যান। সর্বস্তরের জনগণের শেষশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহ এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় শিবাজি পার্কে রাখা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শিবাজি পার্কে গিয়ে লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ভারতরতœ লতার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে বিকালেই তিনি মুম্বাই উড়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে একে একে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে, এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার, গীতিকার জাভেদ আখতার, ড্রিম গার্ল হেমা মালিনী, ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান, অভিনেত্রী শ্রদ্ধা কাপুর ও বিদ্যা বালান, গায়িকা অনুরাধা পাড়োয়ালসহ আরো অনেকে প্রিয় লতাদি’র মৃতদেহের প্রতি শেষশ্রদ্ধা জানান। সবার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে ভারতের তিন বাহিনীর সদস্যরা লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানান এবং তার পরিবারের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। তার পরপরই হিন্দু রীতি মেনে দাহকাজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই সংগীত শিল্পীর সম্মানে ভারতের জাতীয় পতাকা দুই দিন অর্ধনমিত রাখা হবে। শোক প্রকাশ করে সোমবার অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। আগামী ১৫ দিন রাজ্যে বাজবে লতার গাওয়া গান। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও তিনি গান করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দিয়ে, তার সঙ্গে স্মৃতির কথা লিখে, কিংবা তার কাছে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা জানিয়ে শোক প্রকাশ করছেন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।
উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।
শোক বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সুরসম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো। লতা মঙ্গেশকর তার কর্মের মধ্য দিয়ে চিরদিন এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন বলেও শোক বার্তায় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রয়াত কোকিলকণ্ঠী এই শিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের শোক : উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গতকাল রোববার এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত লতা মঙ্গেশকরের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ফখরুলের শোক : উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রোববার এক শোক বার্তায় মির্জা ফখরুল লতা মঙ্গেশকরের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, উপমহাদেশের প্রতিভাবান ও খ্যাতনামা সংগীতশিল্পীদের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। তার সুরেলা কণ্ঠ কয়েক দশক ধরে সংগীতপ্রেমী মানুষদের বিমোহিত করেছে। এই কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী ছিলেন অনন্য অতুলনীয়। তিনি ছিলেন সংগীত জগতে একজন মহীরুহ। বহু হৃদয়কাড়া গানের এ শিল্পীর পৃথিবী থেকে প্রস্থান গভীর বেদনার। তার মৃত্যুতে ভারতসহ এই উপমহাদেশ হারালো অসাধারণ একজন গুণী শিল্পীকে, যার অভাব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। সংগীতশিল্পী হিসেবে লতা মঙ্গেশকরের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লতার জীবনের গল্প : লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর, ভারতের ইন্দোরে। আগে নাম ছিল হেমা। তবে মৃত বড় বোনের নাম লতিকা হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় লতা।
বাবা দীনানাথ মুঙ্গেশকর ছিলেন ধ্রপদ শিল্পী, মারাঠি থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। তার কাছেই লতার গান শেখার শুরু। কৈশোরেই বাবাকে হারালেও গান শেখা ছাড়েননি। সেসব দিনে ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে ক্লাসিকাল শিখতেন লতা। ১৯৪২ সালে ‘কিটি হাসাল’ নামে এক মারাঠি সিনেমায় তার প্লেব্যাক ক্যারিয়ার শুরু। তখন কেএল সায়গল, শামশাদ বেগম ও নুরজাহানদের যুগ। শুরুর দিকে লতা মঙ্গেশকরকে শুনতে হয়েছিল, তার কণ্ঠস্বর একটু বেশিই পাতলা।
তাকে প্রথম সুযোগ দেন মাস্টার গুলাম হায়দার। তার পরেই আসে ‘মহল’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। সেই সিনেমা ১৬ বছরের মধুবালা ও ২০ বছরের লতা, দুজনের জন্যই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। নায়িকা ও গায়িকার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ওই সিনেমার পর। সেই পথ ধরেই লতার কণ্ঠ হয়ে ওঠে বলিউডের ‘গোল্ডেন ভয়েস’।
১৯৪৯ সালে লতার কণ্ঠে ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’ উতলা করে তোলে শ্রোতাদের মন। ১৯৫৫ সালে ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ দুলিয়ে দেয় ভারতবর্ষ। ১৯৫৭ সালে ‘আজারে পরদেশী’ গানে তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান, হয়ে ওঠেন সংগীত পরিচালক আর চলচ্চিত্র প্রযোজকদের নয়নের মনি।
বাংলাদেশের একাধিক প্রজন্মের কাছেও লতার কণ্ঠ স্বপ্নের মত। বাংলা সিনেমাতেও প্রায় ২০০ গান রয়েছে লতার। তার কণ্ঠের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যা রে উড়ে যারে পাখি’, ‘বলছি তোমার কানে’, ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’ এর মত বহু গান এ দেশের মানুষ মনে রাখবে আরও বহু দিন।
প্রয়োজন অনুযায়ী গায়কী আর কণ্ঠ বদলে নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা ছিল লতার। একই সিনেমায় তিনি তিন নায়িকার গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।
প্রখাত সংগীত পরিচালক নওশাদ আলী বলেছিলেন “লতার মত সংগীত প্রতিভা আমি আর পাইনি। বিভিন্ন মাধ্যমেই এক একজন আসেন, যার মাথায় ঈশ্বর হাত রাখেন, লতা তেমনই একজন।”
তবে শুধু প্রতিভাই সব ছিল না, লতার ছিল জীবনই ছিল সাধনা আর সংগ্রাম। যতীন মিশ্রর ‘লতা সুর গাঁথা’তে লতা বলেছিলেন, “প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি। আর ভীষণ খিদে পেত। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকত, তবে নানান রকম খাবার পাওয়া যেত কি-না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে।
“এক কাপ চা আর দু চারটে বিস্কুট খেয়েই সারাদিন কেটে যেত। এমনও দিন গেছে যে দিনে শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত, যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।”
বলিউডে লতা মঙ্গেশকরকে নিজের ছোট বোনের মতো দেখতেন নায়ক দিলীপ কুমার। আবার লতাও দিলীপ কুমারকে সব থেকে কাছের মানুষ মনে করতেন ইন্ডাস্ট্রিতে।
লতাকে ভেবেই ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’য়ের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন রাজ কাপুর। চেয়েছিলেন, লতা সেখানে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করুন। কিন্তু লতা সায় দেননি। অনেক পরে জিনাত আমান সেই ভূমিকায় অভিনয় করেন।
২০০১ সালে লতা মঙ্গেশকর ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারতরতœ অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। আকাশছোঁয়া খ্যাতির পথে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পীকে ১৯৬৯ সালেই পদ্মভূষণে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। ১৯৯৯ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ এবং ২০০১ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরতœ দেওয়া হয় তাকে।
‘নাইটিংগেলের’ জন্য শোকগাথা : ভারতবাসীর কাছে তিনি ছিলেন গানের পাখি নাইটিংগেল, কেউবা বলতেন ‘স্বরা কোকিল’। কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ ভারতীয় সংগীত জগত।
মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সকালে মারা যান লতা মঙ্গেশকর। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ সেখানে ভর্তি ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই সংগীত শিল্পীর সম্মানে ভারতের জাতীয় পতাকা দুই দিন অর্ধনমিত রাখা হবে।
শোক প্রকাশ করে আজ সোমবার অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। আগামী ১৫ দিন রাজ্যে বাজবে লতার গাওয়া গান। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও তিনি গান করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দিয়ে, তার সঙ্গে স্মৃতির কথা লিখে, কিংবা তার কাছে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা জানিয়ে শোক প্রকাশ করছেন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিরা। শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা আনন্দবাজারকে বলেছেন, “লতা দিদির বাংলা গান আমার কণ্ঠস্থ, সেই শুনেই হেমন্তদা গাইতে ডেকেছিলেন।”
লতার সঙ্গে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ করেন হৈমন্তী, “লতা দিদির প্রথম মুখোমুখি হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। একবার উনি কলকাতায় এসেছেন অনুষ্ঠান করতে। গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছেন। সেই সময়ে সুপ্রকাশ গড়গড়ি ফোন করে জানালেন, লতাজি আমায় ডেকেছেন। উনি কিছু বাংলা গানের কথা ভুলে গিয়েছেন। আমার সব গান মুখস্থ থাকে জেনে সহযোগিতার জন্য ডেকেছেন। “সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। তখনই দেখেছিলাম, ওর একটি ব্রিফকেস ভর্তি গানের মোটা মোটা খাতা! সেখানে সব গান যতেœ লেখা। তার মধ্যে কয়েকটি বাংলা গান হারিয়ে ফেলেছেন। আমাকে বসিয়ে সে সব শুনে নতুন করে তুলে নিলেন খাতায়।”
টুইটারে লতার সঙ্গে নিজের একটি ছবি প্রকাশ করে সুরকার এ আর রহমান লিখেছেন, “ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং প্রার্থনা।”
পশ্চিমবাংলার আনন্দবাজার পত্রিকার কাছে শোক প্রকাশ করে গায়ক-সুরকার রূপঙ্কর বাগচী বলেছেন, “যেন সদ্য মাতৃহারা হলাম। যে কোনও সন্তান সদ্য মাকে হারালে যে ভাবে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে, আমার সেই অবস্থা। ভাষায় বোঝাতে পারছি না।”
শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘ছোট থেকে গুনগুন করতাম সলিল চৌধুরীর সুরে ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’ গানটি। হিন্দির পাশাপাশি তার বাংলা গানগুলোও আমার বড় প্রিয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রায়ই গেয়েছি, ‘কী লিখি তোমায়, প্রিয়তমা’।”
সংগীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র আনন্দবজারে লিখেছেন, “এই পৃথিবীর মায়া-স্মৃতি-প্রেম-প্রণয়, এই পৃথিবীর অভিমান-আদর-বিতৃষ্ণা-রাগ সব ফেলে চলে যাচ্ছেন আমাদের সম্রাজ্ঞী, না কি ভালবেসে আমরা তাকে বরণ করে নিচ্ছি মহাকালে। সুরের ভারতবর্ষ সঙ্গীতের ভারতবর্ষ সাধারণ ও অসাধারণ সমস্ত ভারতবর্ষ আজ নতমুখে দাঁড়িয়ে…।”
ভারতের জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পী অনুপম রায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “ওর সময়ে জন্মালে ওর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ জন্মে সেই সাধ পূরণ হল না। লতাজিকে তাই তার গানেই বিদায় জানানো ছাড়া উপায় নেই। অনেকটাই গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মতো।”
লোপামুদ্রা মিত্রের কাছে যেন জীবন্ত দেবীর বিসর্জন ঘটল। তিনি বলেছেন, “বরাবরের আফসোস, কোনো দিন সামনে থেকে কিশোর কুমারকে দেখতে পাইনি। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সেই আক্ষেপ যেন কিছুটা মিটিয়েছিল।”
ইমন চক্রবর্তী বলেছেন, “লতা মঙ্গেশকরের শরীরের বিনাশ হল। আত্মা পাড়ি দিল সুরলোকে। সুর সম্রাজ্ঞী বিদায় নিয়েছেন। বদলে রেখে গিয়েছেন তার অসংখ্য গান। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। আজ তাকে, তার গানকে, তার কাজকে নতুন ভাবে ফিরে দেখার দিন। তার অবদান উদযাপনের দিন।”
লতার সঙ্গে নিজের জীবনের নানা ঘটনা আনন্দবাজারে লিখেছেন ওস্তাদ রশিদ খান। শোক প্রকাশ করে এই শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী বলেছেন, “কালের নিয়মে লতাজি প্রয়াত হলেন ঠিকই। কিন্তু লতাজির মতো শিল্পীর তো প্রয়াণ হয় না। তিনি থেকে যাবেন তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।
“আমার তখন ২৭-২৮ বছর বয়স। ‘বৈষ্ণব জন তো’ ভজনটি রেকর্ড করা হবে। সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য। কে শেখাবেন গানটি? লতা মঙ্গেশকর। ফোনে সেই গানটি আমাকে তুলিয়ে দেন লতাদিদি। সেই স্মৃতি আমি কখনওই ভুলতে পারব না। ওর কাছে অন্তত একটা তো শিখেছি!”
এই প্রজন্মের জনপ্রিয় শিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন, “অসাড় বোধ করছি। বিধ্বস্ত। গতকাল সরস্বতী পূজা ছিল এবং আজ মা তার আশীর্বাদকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে পাখি,গাছ,বাতাসও আজ নীরব। লতা মঙ্গেশকরজি আপনার ঐশ্বরিক কণ্ঠ চিরকাল প্রতিধ্বনিত হবে। শান্তিতে বিশ্রাম করুন। ওম শান্তি।”
শিল্পী আদনান সামি লিখেছেন, সংগীত আজ এতিম হয়ে গেল। আমাদের ‘নাইটিঙ্গেল’ উড়ে গেছে। আমরা কণ্ঠহীন হয়ে পড়েছি। আমরা তার জীবদ্দশায় বেঁচে ছিলাম এবং সেই বাতাসে শ্বাস বাতাসে শ্বাস নেওয়ার বিশেষ অধিকার পেয়েছি, যাতে তিনি শ্বাস নিয়েছিলেন। সবকিছুর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ প্রিয় দিদি।”
জনপ্রিয় শিল্পী কুমার সানু আনন্দবাজারকে বলেছেন, “অনেক গান গেয়েছি লতাজির সঙ্গে। মানুষের মন জয় করতে পেরেছে সেই গানগুলি। আমার মতে, ওর মতো অভিজ্ঞতা গোটা বিশ্বে আর কারও নেই। ওর চলে যাওয়ায় শুধু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিরই ক্ষতি হল না, গোটা দুনিয়া এক কিংবদন্তি কণ্ঠস্বর হারাল।”
কে পাচ্ছেন লতার শত শত কোটি টাকা? জীবনে বহু মানুষ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। অনেকে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। তবে প্রেমকে নিজের জীবন থেকে দূরেই রেখেছিলেন কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। বিয়ে করেননি, হয়নি সেই অর্থে ঘর-সংসার। আর সেই কারণেই নেই লতার উত্তরসূরি।
অন্যদিকে, একেবারে আটপৌরে জীবনযাপন করতেন তিনি। অথচ ঈশ্বর তাকে কণ্ঠের সঙ্গে দিয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, লতার সম্পদের পরিমাণ ১৫ মিলিয়ন ডলার। যা ১১১ কোটি রুপির সমতুল্য। আর মাসে আয় করতেন প্রায় ৪০ লাখ টাকা। ছিল হোটেলসহ নানা ধরনের ব্যবসা। অন্য একটি সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, সব মিলিয়ে লতার সম্পদ ৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, সন্তানহীন এই তারকার সম্পদগুলো কে পাচ্ছেন? তবে আপাতত তার উত্তর এখনও মেলেনি। দ্রুতই হয়তো জানা যাবে তার উইলগুলো। বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই মুখ খুলবেন তার আইনজীবী।
পরপারে লতা মঙ্গেশকর
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ