আনিস আলমগীর : মাদক মামলায় জামিন পেয়ে ২৭ দিন জেলখাটার পর ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ সকালে কাশিমপুর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনি। মুক্তি পাওয়ার পর মিডিয়ায় তার যে ছবি এসেছে তাতে তিনটি বিষয় চোখে পড়ার মতো ছিল। সাদা টিশার্ট এবং মাথায় সাদা পাগড়ির মতো করে জড়ানো কাপড়। ছাদ খোলা গাড়িতে ছড়ে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ানো, যেই স্টাইল সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা জেল থেকে বেরুনোর সময় করে বা বিশ্বজয় করা কোনো তারকা সংবর্ধনার জবাবে করেন।
তৃতীয় যে বিষয়টি, সেটিই আলোচিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। পরীমনি তার হাতে মেহেদীর রঙে ইংরেজিতে লিখেছেন- ডোন্ট লাভ মি বিচ। এটি একটি ডিজে গানের প্রথম লাইন। ‘ণড়ঁ ফড়হ’ঃ ষড়াব সব নরঃপয’ দিয়ে শুরু করা ওই গানের পরের লাইন ‘ও ষড়াব রঃ যিবহ ুড়ঁ ষরব ঃড় সব’। গানের এই দুই লাইন পর্যন্ত পত্রিকায় লেখা যায়। কিন্তু এর পরের লাইনগুলো জনসম্মুখে উচ্চারণ উপযোগী নয়, তাই লেখতে পারছি না।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম আমাদের কথিত প্রগতিবাদী, নারীবাদী, ‘পুতুপুতু’ বিপ্লবীরা পরীর মেহেদীর বাক্যে তার বিপ্লবী চরিত্র খুঁজে পেয়েছেন। সাহস দেখে ফেলেছেন পরীর এই কাজে। ‘সাব্বাস পরীমনি তুমি দেখিয়ে দিলে’- পরীর উদ্দেশ্যে তাদের কমেন্টস। শুধু তাই নয়, পরীর মধ্যে তারা শ্রেণি সংগ্রাম, নারী জাগরণ, নারীমুক্তি, বিপ্লব-সংগ্রাম সব খুঁজে পেয়েছেন। পরীমনি এখানে কী বিপ্লব করলেন, গত এক মাস জেলে থাকা অবস্থায় পরী নতুন কী দেখিয়েছেন- আমি তার কিছু বুঝিনি।
জামিন পাওয়া কি বিপ্লব! জামিন পরীমনির অধিকার। তিনি সে অধিকার আদায়ে লড়েছেন।
বনানীর বাসা থেকে ৪ আগস্ট পরীমনিকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। তার বাসা থেকে ‘মদ, আইস ও এলএসডির মতো মাদকদ্রব্য’ উদ্ধার করার কথা জানিয়ে পরদিন মাদক আইনে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় তিন দফা রিমান্ড নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। গত ২২ অগাস্ট মহানগর দায়রা জজ আদালতে পরীমনির পক্ষে জামিন আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালত জামিন শুনানির জন্য ২১ দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখ নির্ধারণ করেন। পরীমনির পক্ষের আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে গিয়ে সেই আদেশ বাতিল এবং জামিনের শুনানি এগিয়ে আনতে বাধ্য করেন নি¤œ আদালতকে।
এর মধ্যে একজন চিত্রনায়িকাকে তিন দফা রিমান্ডে এবং জামিন না দেয়ায় সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ঢাকায় তার মুক্তি চেয়ে মানববন্ধনও হয়েছে। পরীমনির মুক্তি দাবী করে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন দেশের খ্যাতনামা কবি, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মীরাও।
আমি এটিকেই লড়াই সংগ্রাম বলতে চাই। এটি গণমানুষের লড়াই। এটাকে শ্রদ্ধা এবং সমর্থন জানাই। এখানে পরীর অবদান নেই। পরী এ ধরনের লড়াইতে কখনো সামিল হয়নি। মাদক মামলায় জামিন পেয়ে পরীমনির ডাট দেখানোর কিছু নেই। জামিন মানে রেহাই নয়। এখানে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ানো বেঠিক নয় তবে বিজয় উল্লাসের কিছু নেই। তার জামিন রিনিউ হতে পারে বা যে কোনো সময় বাতিলও হতে পারে। মাদক মামলায় তার বিপক্ষে রায় গেলে সাজা অবধারিত।
এর আগে জুন মাসে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগ করে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলেন পরীমনি। তিনি প্রথমে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে তাকে ঢাকা বোট ক্লাবে ‘ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার’ অভিযোগ তুলে বেশ সাড়া ফেলেন। সংবাদ সম্মেলন করে কান্না, ফেসবুক পোস্টে বিচার চেয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্য কামনা করেন। এ ঘটনার জের ধরে মামলা হয় এবং ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদকে আটক করা হয়, যিনি বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন। সেই ঘটনাও শেষ হয়নি।
মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের মেয়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি রুপালি পর্দায় পরীমনি হয়ে কি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন, নারী সমাজের জন্য নতুন অনুকরণীয় কি দৃষ্টান্ত রেখেছেন? আমাদের নারীবাদীরা নারীর কল্যাণে দিনের পর দিন বিভিন্ন ইস্যুতে সংগ্রাম করে আসছেন। নারীরা জাতীয় জীবনে অবদান রাখছেন। পরী এমন কি অবদান রেখেছেন আমার জানা নেই যার জন্য তাকে নারী জাগরণ, নারীমুক্তির লড়াইয়ের একজন ভাববো? সিনেমায় নাম লিখিয়ে সুগার ড্যাডির বাহুবন্দী হয়ে বিলাসি জীবনযাপন মধ্যে নারীমুক্তির কিছু নেই।
পরী কখনও নারীবাদ বা নারীবাদী আন্দোলনের কাছাকাছিও ছিলেন না। তিনি একই অ্যালকোহল-অপব্যবহারকারী গোষ্ঠীর অংশ ছিলেন যারা অন্যান্য নারীদেরও নির্যাতন করে এবং অর্থের বিনিময়ে ভোগ করে। উচ্চদরের সেক্সওয়ার্কারদের যারা সোসাইটি গার্লস নামকরণ করেছে। পরীর কোনো সংগ্রাম নেই বরং উপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙার জন্য ‘হানি ট্র্যাপ’ ব্যাবহার করেছেন তিনি। প্রেমের ফাঁদ পেতে প্রথমে ঘনিষ্ঠতা। তারপর সুযোগ মতো ব্ল্যাকমেল। এরকমই হানি ট্র্যাপের তিনি শিকার বা শিকারি মাত্র।
অবৈধ কাজ বিদ্রোহ নয় বরং এটি অপরাধ। অ্যালকোহলের অপব্যবহার, ক্লাবগুলিতে অন্য মানুষের সম্পত্তির ধ্বংস, শক্তিশালী ব্যক্তিদের উপপতœী হওয়া, এমনকি পুলিশ কম্পাউন্ডে সাকলায়েন নামের এক পুলিশ কর্তার সঙ্গে ডেটিং করা- এগুলো নারীবাদ নয়। বিপ্লব নয়। বিদ্রোহ নয়। সংগ্রাম নয়। এগুলো জাস্ট বেআইনি এবং অসামাজিক কাজ।
দেখলাম সরকার বিরোধী লোকরাও পরীর মধ্যে বিপ্লবের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। সরকারের নিপীড়নে পরী ভেঙে পড়েনি- মতামত দিচ্ছেন। সরকার নিপীড়ন করলে কারাগারে মৃত্যু হয়, রিমান্ড শেষে আদালতে তুললেও কাপড়ে মল-মুত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। কারগার থেকে মেহিদী লাগিয়ে, সানগ্লাস পরে বের হয় না।
পরীমনি কি সরকারের বিরুদ্ধে কখনো কোনো শব্দ উচ্চারণ করেছে? যারা পরীমনির সঙ্গী বলে মিডিয়ার খবর হচ্ছেন, তারা কি কেউ সরকারের বিরুদ্ধ পক্ষ? তারা আর পরীমনিতো সমগোত্রীয়। পরীমনিতো হুমকি দিয়েছে- একা ডুববে না সঙ্গে নিয়ে মরবে। সঙ্গের লোকেরা কারা? পরীর সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব কোথায়, দূরত্ব সৃষ্টি হলো কেন? তাদের কোন স্বার্থের গোলোযোগে পরীকে জেলে যেতে হল- আপনি সেটাই খুঁজেন। তা না করে এরমধ্যে বিপ্লব, নারী জাগরণ যারা খুঁজছেন হয় তারা আমাদের নারীদের শ্বাশত সংগ্রামকে অস্বীকার করছেন কিংবা নারীবাদ বলতে তসলিমা নাসরিনের মতো নিজের ইচ্ছায় পুরুষের জন্য কাপড় খোলার স্বাধীনতাকে বুঝেন।
পরীমনির যাপিত জীবন নারীবাদের পক্ষে না বরং নারীবাদের কলংক। পরী যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে ভাবছেন সেখানে তারা দু’পক্ষই উইন-উইন অবস্থানে আছে। এখানে নারীমুক্তির কিছু নেই। সবই পুরুষতন্ত্রের প্রদর্শনী।
আপনি শুধু একটাই দাবী করতে পারেন, একজন সাবালিকা হিসেবে পরী তার ব্যক্তিজীবনে কী করবে তাতে রাষ্ট্রের, পুলিশের, মিডিয়ার মাথা কম ঘামানোই উচিত। কিন্তু কেউ যদি সামাজিক ক্লাবে গিয়ে অসামাজিক কর্মকা- করে, অন্যের শান্তি হরণ করে, সমাজে অনাচারকে প্রমোট করে, চোখের জল ফেলার অভিনয়ের মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসন, মিডিয়া এবং জনতাকে বিভ্রান্ত করে- সেটা তার ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে পড়ে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ধহরংধষধসমরৎ@মসধরষ.পড়স
পরীমনি: নারীমুক্তির নামে পুরুষতন্ত্রের প্রদর্শনী
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ