ঢাকা ০৫:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পরীমনির আগে কি জানতাম না রিমান্ডে কী হয়

  • আপডেট সময় : ১০:২৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • ২৪ বার পড়া হয়েছে

রুমিন ফারহানা : বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত মানুষ সম্ভবত পরীমনি। সংসদ থেকে রাজপথ, গণমাধ্যম থেকে ফেসবুক, রাজনীতি থেকে সামাজিক আড্ডা—সব জায়গায় তাঁর নাম। তাঁর সাহসের প্রশংসা যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁকে নিয়ে ট্রল। ঘটনা যা-ই ঘটুক, গত ৪ আগস্ট থেকে ২৬ দিন কারাগারে ছিলেন পরীমনি। এই ২৬ দিনে তিন দফায় সাত দিন রিমান্ডে নেওয়া হয় তাঁকে।

আমাদের রাজনৈতিক ও বিচারিক সংস্কৃতিতে রিমান্ড নতুন কোনো বিষয় নয়। রিমান্ডে কী হয়, কেন রিমান্ড দেওয়া হয়, স্বীকারোক্তি সাধারণত কীভাবে আদায় করা হয়, এটা সাধারণ মানুষও কমবেশি জানেন। সেখানে আমাদের মতো আইন পেশায় যাঁরা যুক্ত (বার ও বেঞ্চ), তাঁদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। তাই পরীমনির ক্ষেত্রে যখন দফায় দফায় উপর্যুপরি রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনা ঘটেছে, তখন যৌক্তিকভাবেই উচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের ওপরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই ক্ষুব্ধতার জেরেই হাইকোর্ট নি¤œ আদালতের বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা পর্যন্ত চেয়েছেন। এটা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে উচ্চ আদালত বলেন, ‘সুষ্ঠু ও স্বাধীন তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু নথিতে দেখা যায়, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডের আবেদন করেন। কিসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করে গত ১০ ও ১৯ আগস্ট আদেশ দিয়েছিলেন? দুই দফা রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে এত সন্তুষ্ট হলেন, যা আমাদের বিচারিক ঐকমত্যকে বিদ্ধ করেছে।’

শুধু পরীমনিই নন, যে কাউকে রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের পক্ষের আইনজীবী প্রাপ্ত নতুন তথ্যের ভিত্তিতে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনের যে যুক্তি আদালতে দেন, সেটা নিশ্চয়ই সব সময় মিথ্যাও নয়। আদালত যদি মনে করেন রিমান্ডে মামলার তদন্তের স্বার্থে কেবল জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়, তাহলে শুধু তিনবার কেন, দশবার রিমান্ডে নিলেই-বা সমস্যা কোথায়? অন্যদিকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফার রিমান্ড যদি সমস্যা হয়, তাহলে প্রথম দফার রিমান্ডও সমস্যা নয় কেন?

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় এখনো যেহেতু রিমান্ডের অপশন আছে, তাই হাইকোর্ট সেই রিমান্ডের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ কাচের ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং বিবাদীপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিতের মতো শর্ত দিয়েছেন কয়েক বছর আগেই। এর মানে হচ্ছে উচ্চ আদালতও জানেন এবং বিশ্বাস করেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ কাউকে হেফাজতে নেওয়ার মানে হচ্ছে তাঁকে নানা রকম ভয়ংকর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা। আইনজীবী হিসেবে তো বটেই, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও আমি জানি, আমার দল বিএনপির বহু নেতা-কর্মী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কীভাবে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরীমনির ক্ষেত্রেও আদালতে তাঁর আইনজীবী মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন।
সার্বিক বিচারে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য রিমান্ডের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটি বন্ধ হওয়া উচিত এখনই। কারণ হিসেবে পরীমনিকে বারবার রিমান্ড দেওয়া নিয়ে রায়ে উচ্চ আদালত যা বলেছেন, সে কথাই উল্লেখ করতে চাই, ‘পুলিশ বিভাগকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে মানবজীবন অত্যন্ত মূল্যবান।’
বেশ কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশে হেফাজতে নির্যাতন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ বছরের জুনে বাংলাদেশে হেফাজতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে হেফাজতে বন্দীদের ওপর লোহার রড, বেল্ট ও লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানো, যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া থেকে শুরু করে পায়ে গুলির মতো ভয়াবহ সব নির্যাতনের তথ্য আছে। এসব বর্বর শারীরিক নির্যাতন দূরে থাক, আমাদের হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু (নিবারণ) আইনে (২০১৩) মানসিক নির্যাতনকেও নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই আইনে নির্যাতনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘নির্যাতন’ অর্থ হলো কষ্ট হয়, এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

এই যদি হয় বাংলাদেশের করা আইনে নির্যাতনের সংজ্ঞা, তাহলে এই দেশে কি একটি রিমান্ডও হয়, যা সম্পূর্ণ নির্যাতনমুক্ত? আর বিষয়টি কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানে না? যদি তারা জেনে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে, সে যে-ই হোক, একবারও রিমান্ড মঞ্জুর হয় কীভাবে? ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছেন, সেটি এই দেশে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে পালন না করার পরও ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে কারও বিরুদ্ধে? পরীমনিকে নিয়ে দেওয়া রায়ে উচ্চ আদালত সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের উল্লেখ করেছেন, যাতে বলা আছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ সংবিধান যে প্রতিদিন দেশের থানাগুলোয় লঙ্ঘিত হয়েছে, হচ্ছে তা কি দায়িত্বশীলদের অগোচরে ছিল? যুগের পর যুগ বিনা বাধায় ঘটে চলা রিমান্ডের নির্যাতন কি পরীমনির ঘটনাতেই উন্মোচিত হলো?
হেফাজতে নিয়ে কাউকে নির্যাতন করার পরিস্থিতি কোনো সমাজে কার্যকর থাকলে তা বর্বর এক সমাজ তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। মানুষকে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের এই ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যকে আটক মানুষের পরিজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করার পথ তৈরি করে দেয়। এ ছাড়া নির্যাতনের মাধ্যমে পাওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়ে দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় সুবিচার নিশ্চিত করতে না পারার অন্যতম কারণ। রিমান্ডে আদায় করা স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন আদালতে প্রতিদিনের বিষয়। অনেক সময়ই আদালত রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন না, সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি মনে করলে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়ে থাকেন। নতুন তথ্যপ্রাপ্তি সাপেক্ষে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে তাঁকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও কেন জেলগেটে করা যাবে না?

নিশ্চিতভাবেই পরীমনি অবিচারের শিকার হয়েছেন, তবু তাঁকে ‘সৌভাগ্যবান’ বলে মনে করছি বাংলাদেশের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, তিনি রিমান্ডে মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও উল্লিখিত ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হননি। কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষ রিমান্ডের নামে মানসিক নির্যাতনের সঙ্গে নারকীয় শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন। এসব নির্যাতনে মৃত্যু ঘটে বহু মানুষের, বিকলাঙ্গ হন অনেকে, আর নির্যাতনকালের অবর্ণনীয় কষ্ট তো আছেই। কাজল, মুশতাক বা কিশোরের অবস্থা কি দেখিনি আমরা?
সার্বিক বিচারে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য রিমান্ডের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটি বন্ধ হওয়া উচিত এখনই। কারণ হিসেবে পরীমনিকে বারবার রিমান্ড দেওয়া নিয়ে রায়ে উচ্চ আদালত যা বলেছেন, সে কথাই উল্লেখ করতে চাই, ‘পুলিশ বিভাগকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে মানবজীবন অত্যন্ত মূল্যবান।’
লেখক : বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

পরীমনির আগে কি জানতাম না রিমান্ডে কী হয়

আপডেট সময় : ১০:২৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

রুমিন ফারহানা : বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত মানুষ সম্ভবত পরীমনি। সংসদ থেকে রাজপথ, গণমাধ্যম থেকে ফেসবুক, রাজনীতি থেকে সামাজিক আড্ডা—সব জায়গায় তাঁর নাম। তাঁর সাহসের প্রশংসা যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁকে নিয়ে ট্রল। ঘটনা যা-ই ঘটুক, গত ৪ আগস্ট থেকে ২৬ দিন কারাগারে ছিলেন পরীমনি। এই ২৬ দিনে তিন দফায় সাত দিন রিমান্ডে নেওয়া হয় তাঁকে।

আমাদের রাজনৈতিক ও বিচারিক সংস্কৃতিতে রিমান্ড নতুন কোনো বিষয় নয়। রিমান্ডে কী হয়, কেন রিমান্ড দেওয়া হয়, স্বীকারোক্তি সাধারণত কীভাবে আদায় করা হয়, এটা সাধারণ মানুষও কমবেশি জানেন। সেখানে আমাদের মতো আইন পেশায় যাঁরা যুক্ত (বার ও বেঞ্চ), তাঁদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। তাই পরীমনির ক্ষেত্রে যখন দফায় দফায় উপর্যুপরি রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনা ঘটেছে, তখন যৌক্তিকভাবেই উচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের ওপরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই ক্ষুব্ধতার জেরেই হাইকোর্ট নি¤œ আদালতের বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা পর্যন্ত চেয়েছেন। এটা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে উচ্চ আদালত বলেন, ‘সুষ্ঠু ও স্বাধীন তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু নথিতে দেখা যায়, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডের আবেদন করেন। কিসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করে গত ১০ ও ১৯ আগস্ট আদেশ দিয়েছিলেন? দুই দফা রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে এত সন্তুষ্ট হলেন, যা আমাদের বিচারিক ঐকমত্যকে বিদ্ধ করেছে।’

শুধু পরীমনিই নন, যে কাউকে রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের পক্ষের আইনজীবী প্রাপ্ত নতুন তথ্যের ভিত্তিতে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনের যে যুক্তি আদালতে দেন, সেটা নিশ্চয়ই সব সময় মিথ্যাও নয়। আদালত যদি মনে করেন রিমান্ডে মামলার তদন্তের স্বার্থে কেবল জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়, তাহলে শুধু তিনবার কেন, দশবার রিমান্ডে নিলেই-বা সমস্যা কোথায়? অন্যদিকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফার রিমান্ড যদি সমস্যা হয়, তাহলে প্রথম দফার রিমান্ডও সমস্যা নয় কেন?

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় এখনো যেহেতু রিমান্ডের অপশন আছে, তাই হাইকোর্ট সেই রিমান্ডের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ কাচের ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং বিবাদীপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিতের মতো শর্ত দিয়েছেন কয়েক বছর আগেই। এর মানে হচ্ছে উচ্চ আদালতও জানেন এবং বিশ্বাস করেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ কাউকে হেফাজতে নেওয়ার মানে হচ্ছে তাঁকে নানা রকম ভয়ংকর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা। আইনজীবী হিসেবে তো বটেই, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও আমি জানি, আমার দল বিএনপির বহু নেতা-কর্মী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কীভাবে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরীমনির ক্ষেত্রেও আদালতে তাঁর আইনজীবী মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন।
সার্বিক বিচারে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য রিমান্ডের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটি বন্ধ হওয়া উচিত এখনই। কারণ হিসেবে পরীমনিকে বারবার রিমান্ড দেওয়া নিয়ে রায়ে উচ্চ আদালত যা বলেছেন, সে কথাই উল্লেখ করতে চাই, ‘পুলিশ বিভাগকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে মানবজীবন অত্যন্ত মূল্যবান।’
বেশ কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশে হেফাজতে নির্যাতন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ বছরের জুনে বাংলাদেশে হেফাজতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে হেফাজতে বন্দীদের ওপর লোহার রড, বেল্ট ও লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানো, যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া থেকে শুরু করে পায়ে গুলির মতো ভয়াবহ সব নির্যাতনের তথ্য আছে। এসব বর্বর শারীরিক নির্যাতন দূরে থাক, আমাদের হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু (নিবারণ) আইনে (২০১৩) মানসিক নির্যাতনকেও নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই আইনে নির্যাতনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘নির্যাতন’ অর্থ হলো কষ্ট হয়, এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

এই যদি হয় বাংলাদেশের করা আইনে নির্যাতনের সংজ্ঞা, তাহলে এই দেশে কি একটি রিমান্ডও হয়, যা সম্পূর্ণ নির্যাতনমুক্ত? আর বিষয়টি কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানে না? যদি তারা জেনে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে, সে যে-ই হোক, একবারও রিমান্ড মঞ্জুর হয় কীভাবে? ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছেন, সেটি এই দেশে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে পালন না করার পরও ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে কারও বিরুদ্ধে? পরীমনিকে নিয়ে দেওয়া রায়ে উচ্চ আদালত সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের উল্লেখ করেছেন, যাতে বলা আছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ সংবিধান যে প্রতিদিন দেশের থানাগুলোয় লঙ্ঘিত হয়েছে, হচ্ছে তা কি দায়িত্বশীলদের অগোচরে ছিল? যুগের পর যুগ বিনা বাধায় ঘটে চলা রিমান্ডের নির্যাতন কি পরীমনির ঘটনাতেই উন্মোচিত হলো?
হেফাজতে নিয়ে কাউকে নির্যাতন করার পরিস্থিতি কোনো সমাজে কার্যকর থাকলে তা বর্বর এক সমাজ তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। মানুষকে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের এই ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যকে আটক মানুষের পরিজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করার পথ তৈরি করে দেয়। এ ছাড়া নির্যাতনের মাধ্যমে পাওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়ে দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় সুবিচার নিশ্চিত করতে না পারার অন্যতম কারণ। রিমান্ডে আদায় করা স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন আদালতে প্রতিদিনের বিষয়। অনেক সময়ই আদালত রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন না, সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি মনে করলে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়ে থাকেন। নতুন তথ্যপ্রাপ্তি সাপেক্ষে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে তাঁকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও কেন জেলগেটে করা যাবে না?

নিশ্চিতভাবেই পরীমনি অবিচারের শিকার হয়েছেন, তবু তাঁকে ‘সৌভাগ্যবান’ বলে মনে করছি বাংলাদেশের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, তিনি রিমান্ডে মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও উল্লিখিত ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হননি। কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষ রিমান্ডের নামে মানসিক নির্যাতনের সঙ্গে নারকীয় শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন। এসব নির্যাতনে মৃত্যু ঘটে বহু মানুষের, বিকলাঙ্গ হন অনেকে, আর নির্যাতনকালের অবর্ণনীয় কষ্ট তো আছেই। কাজল, মুশতাক বা কিশোরের অবস্থা কি দেখিনি আমরা?
সার্বিক বিচারে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য রিমান্ডের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটি বন্ধ হওয়া উচিত এখনই। কারণ হিসেবে পরীমনিকে বারবার রিমান্ড দেওয়া নিয়ে রায়ে উচ্চ আদালত যা বলেছেন, সে কথাই উল্লেখ করতে চাই, ‘পুলিশ বিভাগকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে মানবজীবন অত্যন্ত মূল্যবান।’
লেখক : বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী