ঢাকা ০৮:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরচুলা তৈরির কারখানা গড়ে তুলে জীবনযুদ্ধে জয়ী লাইজু

  • আপডেট সময় : ০৫:০৮:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪
  • ১৭ বার পড়া হয়েছে

জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক সংগ্রামী উদ্যোক্তা লাইজু খাতুন। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনার সময় পারিবারিক চাপে বিয়ে হয়। অদম্য ইচ্ছাই সংসারের পাশাপাশি চলে পড়াশোনা। মাস্টার্স পাস করে সাউথইস্ট ব্যাংকে চাকরি শুরু করলেও দেড় বছরের সন্তানকে বাড়িতে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। স্বামীর পরামর্শে ভর্তি হয় পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ কোর্সে। ঢাকায় মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে এলাকায় এসে ১৬ নারীকে দেন প্রশিক্ষণ। এরপর গড়ে তোলেন পরচুলা তৈরির কারখানা। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৭৫ নারী কাজ করছেন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার বালাটারী গ্রামের সিনহা বিনতে সামিউল হেয়ার ক্যাপ নিটিং লিমিটেডের নারী উদ্যোক্তা মোছা. লাইজু খাতুন। উপজেলা শহর থেকে এক কিমি দূরে বালাটারী গ্রামে তার পরচুলা তৈরির কারখানা। তিনি জানান, অনার্স প্রথম বর্ষে থাকতে একই উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের সামিউলের সঙ্গে বিয়ে হয়। ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। অনার্স পরীক্ষা শেষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির দরখাস্ত করতে শুরু করি। কিন্তু কোথাও তেমন সাড়া না পেয়ে হতাশ হই। তবে হাল ছাড়েনি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ৪১তম বিসিএসে অংশ নিতে ঢাকায় যাই। সে সময় ঢাকায় পরচুলা তৈরির ওপর একটি প্রশিক্ষণ সম্পর্কে স্বামী সামিউল হক আমাকে জানায়। আমি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই ভর্তি হয়ে যাই প্রশিক্ষণ কোর্সে। মাত্র ১৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসি বাড়িতে। আসার সময় ঢাকা থেকে পরচুলা তৈরির জন্য কাঁচামালও নিয়ে আসি। এরপর বাড়ির মধ্যে তিন লাখ মূলধন আর ১৬ নারীকে নিজে পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু করি পরচুলা তৈরির কাজ।
লাইজু খাতুন বলেন, ‘প্রথম দিকে এলাকার মানুষ কোনো সহায়তা করতে চাইত না। এলাকার নারী ও স্কুলের মেয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে খ-কালীন কাজ করাতাম। নারীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করা দেখে এলাকাবাসী উপহাস করত। মেয়েরা কাজ করে ফেরার সময় ইফটিজিংয়ের শিকার হতো। গ্রামবাসী বলত শ্রমিকদের বেতন দেবে না, কাজ করিয়ে নিয়ে পালাবে। এমন কথা শুনে অনেক কর্মী কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি বাইরের লোকের কথায় কান দেইনি। বাবার জমি বন্ধক রেখে এবং স্বামীর বেতনের টাকা দিয়ে শ্রমিকের প্রথম বেতন পরিশোধ করি। কারখানার প্রথম উৎপন্ন পণ্য ঢাকার বায়ারদের কাছে পাঠালাম। তারাও দেড় লাখ টাকা মেরে দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমি ও আমার স্বামী অথৈ জলে পড়ে গেলাম। সে সময় আমার স্বামী আমাকে আরও কিছু টাকা কারখানায় বিনিয়োগের জন্য দেন। আমি নতুন করে শুরু করলাম। কারখানা আরও বড় করলাম। এতে করে লোকজনের মনে বিশ্বাস চলে আসে। এখন আমার কারখানায় ৭৫ জন নারী কাজ করেন। আমি এখন এই ৭৫টি পরিবারের অভিভাবক হয়ে গেছি। একটি পরচুলা ক্যাপ তৈরি করতে আকারভেদে এক দিন থেকে দুই দিন সময় লাগে। আমার কারখানায় নারী ও ছাত্রীদের প্রডাকশনে বেতন হয়, তাই অনেকেই খ-কালীন কাজ করে। বর্তমানে একেকজন কর্মী মাসে সাত হাজার থেকে নয় হাজার টাকা আয় করে।
স্বামী সামিউল হক ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরচুলা মার্কেটিং ও কাঁচামাল আমদানিতে সহায়তা করে। স্বামী সামিউল হক জানায়, ‘আমার স্ত্রী লাইজু একজন সাহসী নারী। তিনি উচ্চ শিক্ষত হয়েও চাকরি না করে নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য কারখানা দিয়েছে। উদ্যোক্তা হতে গেলে ঝুঁকি থাকে। সে সকল প্রতিবন্ধকতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছে। তার স্বপ্ন এলাকার নারীদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা।
ফুলবাড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী খ-কালীন শ্রমিক মুক্তা খাতুন জানায়, আমার বয়স যখন আড়াই বছর তখন বাবা-মা কাজের সন্ধানে গোপনে ভারতে যান দাদির কাছে রেখে। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি তখনই আমাকে বিয়ে দিতে চায় পরিবারের লোকজন। কিন্তু আমি পড়ালেখা করতে চাইলে আমাকে খরচ দেয় না। বাধ্য হয়ে কারখানায় কাজ শুরু করি। সপ্তাহে দুই দিন কাজ করি। এখান থেকে যা টাকা পাই সেটা দিয়ে আমি আমার পড়াশোনার খরচ চালাই, অতিরিক্ত টাকা দাদির সংসারে দেই। চন্দ্রখানা গ্রামের নারী শ্রমিক নাসিমা খাতুন (২৬)।
ভূমিহীন কৃষক স্বামী অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। দুই ছেলেমেয়ে। অভাবের সংসার। প্রতিবেশীর মাধ্যমে হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানায় কাজ নেয়। নাসিমা খাতুনের সঙ্গে তার মেয়েও পড়ালেখার পাশাপাশি এই কারখানায় কাজ করে। তারা মাসে প্রায় ১৪ হাজার টাকা আয় করে। বর্তমানে ৪ শতক জায়গায় আধাপাকা টিনশেড ঘর তুলেছে। জমি বন্ধক নিয়ে চাষাাবাদ করছে স্বামী।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. সোহেলী পারভীন বলেন, ‘আমি লাইজু খাতুনের কারখানার কথা শুনেছি। সেখানে এলাকার অনেক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। একজন মেয়ে পড়ালেখা শেষ করে সরকারি চাকরি খোঁজে কিংবা গৃহিণী হয়। সেখানে লাইজু খাতুন উদ্যোক্তা হয়েছে। এটি এ অঞ্চলের অনেক মেয়েকে উদ্যোক্তা হতে সাহস জোগাবে।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

পরচুলা তৈরির কারখানা গড়ে তুলে জীবনযুদ্ধে জয়ী লাইজু

আপডেট সময় : ০৫:০৮:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক সংগ্রামী উদ্যোক্তা লাইজু খাতুন। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনার সময় পারিবারিক চাপে বিয়ে হয়। অদম্য ইচ্ছাই সংসারের পাশাপাশি চলে পড়াশোনা। মাস্টার্স পাস করে সাউথইস্ট ব্যাংকে চাকরি শুরু করলেও দেড় বছরের সন্তানকে বাড়িতে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। স্বামীর পরামর্শে ভর্তি হয় পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ কোর্সে। ঢাকায় মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে এলাকায় এসে ১৬ নারীকে দেন প্রশিক্ষণ। এরপর গড়ে তোলেন পরচুলা তৈরির কারখানা। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৭৫ নারী কাজ করছেন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার বালাটারী গ্রামের সিনহা বিনতে সামিউল হেয়ার ক্যাপ নিটিং লিমিটেডের নারী উদ্যোক্তা মোছা. লাইজু খাতুন। উপজেলা শহর থেকে এক কিমি দূরে বালাটারী গ্রামে তার পরচুলা তৈরির কারখানা। তিনি জানান, অনার্স প্রথম বর্ষে থাকতে একই উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের সামিউলের সঙ্গে বিয়ে হয়। ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। অনার্স পরীক্ষা শেষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির দরখাস্ত করতে শুরু করি। কিন্তু কোথাও তেমন সাড়া না পেয়ে হতাশ হই। তবে হাল ছাড়েনি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ৪১তম বিসিএসে অংশ নিতে ঢাকায় যাই। সে সময় ঢাকায় পরচুলা তৈরির ওপর একটি প্রশিক্ষণ সম্পর্কে স্বামী সামিউল হক আমাকে জানায়। আমি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই ভর্তি হয়ে যাই প্রশিক্ষণ কোর্সে। মাত্র ১৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসি বাড়িতে। আসার সময় ঢাকা থেকে পরচুলা তৈরির জন্য কাঁচামালও নিয়ে আসি। এরপর বাড়ির মধ্যে তিন লাখ মূলধন আর ১৬ নারীকে নিজে পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু করি পরচুলা তৈরির কাজ।
লাইজু খাতুন বলেন, ‘প্রথম দিকে এলাকার মানুষ কোনো সহায়তা করতে চাইত না। এলাকার নারী ও স্কুলের মেয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে খ-কালীন কাজ করাতাম। নারীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করা দেখে এলাকাবাসী উপহাস করত। মেয়েরা কাজ করে ফেরার সময় ইফটিজিংয়ের শিকার হতো। গ্রামবাসী বলত শ্রমিকদের বেতন দেবে না, কাজ করিয়ে নিয়ে পালাবে। এমন কথা শুনে অনেক কর্মী কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি বাইরের লোকের কথায় কান দেইনি। বাবার জমি বন্ধক রেখে এবং স্বামীর বেতনের টাকা দিয়ে শ্রমিকের প্রথম বেতন পরিশোধ করি। কারখানার প্রথম উৎপন্ন পণ্য ঢাকার বায়ারদের কাছে পাঠালাম। তারাও দেড় লাখ টাকা মেরে দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমি ও আমার স্বামী অথৈ জলে পড়ে গেলাম। সে সময় আমার স্বামী আমাকে আরও কিছু টাকা কারখানায় বিনিয়োগের জন্য দেন। আমি নতুন করে শুরু করলাম। কারখানা আরও বড় করলাম। এতে করে লোকজনের মনে বিশ্বাস চলে আসে। এখন আমার কারখানায় ৭৫ জন নারী কাজ করেন। আমি এখন এই ৭৫টি পরিবারের অভিভাবক হয়ে গেছি। একটি পরচুলা ক্যাপ তৈরি করতে আকারভেদে এক দিন থেকে দুই দিন সময় লাগে। আমার কারখানায় নারী ও ছাত্রীদের প্রডাকশনে বেতন হয়, তাই অনেকেই খ-কালীন কাজ করে। বর্তমানে একেকজন কর্মী মাসে সাত হাজার থেকে নয় হাজার টাকা আয় করে।
স্বামী সামিউল হক ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরচুলা মার্কেটিং ও কাঁচামাল আমদানিতে সহায়তা করে। স্বামী সামিউল হক জানায়, ‘আমার স্ত্রী লাইজু একজন সাহসী নারী। তিনি উচ্চ শিক্ষত হয়েও চাকরি না করে নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য কারখানা দিয়েছে। উদ্যোক্তা হতে গেলে ঝুঁকি থাকে। সে সকল প্রতিবন্ধকতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছে। তার স্বপ্ন এলাকার নারীদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা।
ফুলবাড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী খ-কালীন শ্রমিক মুক্তা খাতুন জানায়, আমার বয়স যখন আড়াই বছর তখন বাবা-মা কাজের সন্ধানে গোপনে ভারতে যান দাদির কাছে রেখে। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি তখনই আমাকে বিয়ে দিতে চায় পরিবারের লোকজন। কিন্তু আমি পড়ালেখা করতে চাইলে আমাকে খরচ দেয় না। বাধ্য হয়ে কারখানায় কাজ শুরু করি। সপ্তাহে দুই দিন কাজ করি। এখান থেকে যা টাকা পাই সেটা দিয়ে আমি আমার পড়াশোনার খরচ চালাই, অতিরিক্ত টাকা দাদির সংসারে দেই। চন্দ্রখানা গ্রামের নারী শ্রমিক নাসিমা খাতুন (২৬)।
ভূমিহীন কৃষক স্বামী অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। দুই ছেলেমেয়ে। অভাবের সংসার। প্রতিবেশীর মাধ্যমে হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানায় কাজ নেয়। নাসিমা খাতুনের সঙ্গে তার মেয়েও পড়ালেখার পাশাপাশি এই কারখানায় কাজ করে। তারা মাসে প্রায় ১৪ হাজার টাকা আয় করে। বর্তমানে ৪ শতক জায়গায় আধাপাকা টিনশেড ঘর তুলেছে। জমি বন্ধক নিয়ে চাষাাবাদ করছে স্বামী।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. সোহেলী পারভীন বলেন, ‘আমি লাইজু খাতুনের কারখানার কথা শুনেছি। সেখানে এলাকার অনেক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। একজন মেয়ে পড়ালেখা শেষ করে সরকারি চাকরি খোঁজে কিংবা গৃহিণী হয়। সেখানে লাইজু খাতুন উদ্যোক্তা হয়েছে। এটি এ অঞ্চলের অনেক মেয়েকে উদ্যোক্তা হতে সাহস জোগাবে।