সুরেশ কুমার দাশ : পর পর বেশ কয়েকবার ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’র পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগার বিষয়টাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। বিশাল আর্থিক খরচে নির্মিত হওয়ার জন্য নয়, কিংবা অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আনবে সেই হিসাবের কথায়ও নয়, এ সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের বহু দিনের আকাঙ্ক্ষার সেতু। এ সেতুর জন্য তারা যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের যে বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে সেজন্যই পদ্মা সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর এমন সব ঘটনা এটি নির্মাণের আগে ঘটেছে যাতে গোটা দেশের মানুষের আবেগের সাথে, মর্যাদার সাথে এ সেতুর ভালোমন্দ যুক্ত হয়ে গেছে। যে কারণে এটা ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ হিসেবে দেশবাসীর কাছে পরিচিত হয়েছে। একই সাথে পদ্মা সেতুর কারণে বিশ্ব ব্যাংক এদেশের মানুষের গায়ে দুর্নামের চাদর জড়াতে চেয়েছিল, সেটিও বার বার উঁকি দেয় মনে। প্রতিষ্ঠানটি এমন আজগুবি মিথ্যাচার করেছিল পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে যা পরে তাদেরকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, অদম্য সাহসের সাথে এটির নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। এত বড় একটা নির্মিত সেতু যদি কোনও ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে গোটা জাতির স্বপ্নভঙ্গ হবে, আশাহত হবে। যা সরকারের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মতো। তাই ষড়যন্ত্র করে সেতুটির ক্ষতি করার আগেই সেতুর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় জোরদার করা দরকার। যাতে কোনও গোষ্ঠি নাশকতা করে ‘ভুল’ বা ‘অসর্তকতা’র অজুহাত হিসেবে চালিয়ে দিতে না পারে। সেতু তৈরির সময়ও অন্যান্য পরিকল্পনার সাথে এগুলো যুক্ত রাখার দরকার ছিল। অনেকে বলতে পারেন, অসতর্কতা বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেতুর পিলারে এসব ফেরি বা অন্য কোনো ভারী জলযানের ধাক্কা স্বাভাবিক।
কিন্তু যদি চারদিনের মধ্যে সেতুর পিলারে দুই বার ধাক্কা লাগলে- এ রকম অসর্তকতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। কতগুলো ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা সেতুর আছে? বলা হচ্ছে- ছোট ফেরির ধাক্কা লেগেছে, তাহলে বড় ফেরির ধাক্কা লাগাটা আরও বেশি স্বাভাবিক। যেখানে ছোট ফেরি চলাচলে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে বড় বড় ফেরিগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? আর বর্ষা মওসুমের কথাও বলা হচ্ছে। এত বছর ধরে সেতু তৈরি হচ্ছে, বর্ষা মওসুমও ছিল, ফেরির ধাক্কা তো আর লাগেনি! এবার মাস খানেকের মধ্যে চার বার লাগল কেন? প্রথমটায় পারেনি বলে দ্বিতীয়টা, তারপর তৃতীয়টা এবং চতুর্থ ধাক্কা? চতুর্থ আঘাতটি ছোট ফেরি করেছে, যাতে বড় ফেরির ধাক্কাগুলো ‘ষড়যন্ত্র’ নয় বলে পাশ কাটানো যায়?
চারবারের কোনওবারই কিন্তু ধাক্কা আস্তে লাগেনি। ফেরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিলারে ধাক্কার ক্ষত দেখা গেছে। ঢালাই ভেঙ্গে রড বেরিয়ে এসেছে। প্রথম ধাক্কা লাগে ২০ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারে। রো রো ফেরি শাহ মখদুম পিলারে ধাক্কা দেয়। পরে ফেরির তলা ছিদ্র হয়ে যায়। এরপর ২৩ জুলাই রো রো ফেরি শাহজালাল ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয়। এরপর গত ৯ অগাস্ট সন্ধ্যায় রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সজোরে ধাক্কা দেয় ১০ নম্বর পিলারে। সব শেষ ঘটনা কাকলী ফেরির। এটি পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয় ১৩ অগাস্ট।
আর বাস্তবতা হচ্ছে-পিলারের সাথে ফেরির ধাক্কা লাগার বিষয়টা আমরা নতুন শুনছি। দেশে আরও নদীতে জলযান, ফেরি চলাচল বা পারাপার আছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে ধাক্কা না লাগলে, শুধু পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা কেন বার বার লাগছে?
আর শুধু ফেরি কেন ছোট বড় মালবাহী কত জলযান আছে সেগুলো কোন কোনটা তো ফেরির চেয়ে কম শক্তিশালী নয়, সেক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য সেতুগুলো রক্ষা হচ্ছে কিভাবে? সেগুলো রক্ষা পেলে পদ্মা সেতু কেন সেতুর পিলার এড়িয়ে চলাচল করতে পারছে না? ফেরি বা বড় বড় জলযান চলার ক্ষেত্রে সব নদীতে যদি এটাই নিয়ম হয় তাহলে এখানে অন্যথা হচ্ছে কেন?
এখানে কোনও ‘বিশ্ব বাটপার’ জড়িত আছে কিনা দেখা অত্যন্ত জরুরী। এটা অসতর্কতার কারণে হলেও চুপ থাকার মানে হয় না। চুপেচাপে কার কী গতিবিধি, মতলব- খবর নিতে হবে। এর আগে যারা নানাভাবে এ সেতুটি তৈরি করায় বাধার সৃষ্টি করেছে যারা, পরপর দুর্ঘটনাগুলো তাদেরই যোগসাজস নয়তো?
শুরু থেকে অর্থায়ন করে আসার অভিনয় করলেও পদ্মাসেতু নির্মাণে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয়দীপ্ত নেতৃত্বে আজ তা নির্মাণ হয়েছে। এতে অনেকেরই চোখ টাটাচ্ছে। কাজেই দেশি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে হাল্কাভাবে দেখা যাচ্ছে না।
সরকারের দুই মন্ত্রী এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। একই সাথে বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও জানান। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় বলেছেন, এসব উদ্দেশ্যমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। হ্যাঁ খতিয়ে দেখা হবে ঠিক আছে। কিন্তু আর যাতে না ঘটে সেজন্য কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে ফেরিসহ জলযান চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ হাসান চৌধুরী ইতোমধ্যে বলেছেন, নির্দেশনা পালনে কিছু উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতুতে আঘাত লাগলে সেই আঘাত হৃদয়ে লাগে। সত্যিই এ আঘাত সারাদেশের মানুষের হৃদয়ে লাগে। তেমনি বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের ভয়াবহ স্মৃতিও ফিরে আসে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।





















