প্রত্যাশা ডেস্ক: কাশ্মির ইস্যুতে আরেকবার বিশ্বজুড়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ, যেখানে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলা, পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা আর ‘দুর্বল’ যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ।
কিন্তু এসবের বাইরে প্রতিবেশী দেশগুলো কীভাবে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের চেহারাটা বদলে দিচ্ছে, সেই আলোচনা অনেকটা ‘উপেক্ষিতই’ থাকছে বলে মনে করছে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ- কেউই ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নিছক দর্শক নয়; প্রত্যেকেই কৌশলগত ‘অনুঘটক’।
ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতে এ অঞ্চলে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তাতে এসব প্রতিবেশী দেশ নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্বিবেচনা করতে পারে বলে মনে করছে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
দেশগুলোকে ‘সুইং স্টেটস’ হিসেবে অভিহিত করে আটলান্টিক কাউন্সিল বলছে, ভারত-পাকিস্তান বিরোধ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে এদের ওপর আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে একটি দ্বিপক্ষীয় ‘নাটকীয়তা’ হিসেবেই দেখা হয়েছে, যা মূলত দুই দেশের ঐতিহাসিক ক্ষোভ আর পারমাণবিক অস্ত্রের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ২০১৯ সালের বালাকোট অভিযানই হোক কিংবা এবারের সংঘাতই হোক- প্রতিটি ঘটনাই এ অঞ্চলের ছোট রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। এবার সেই ঝুঁকি আরো বেশি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এসব ‘সুইং স্টেটকে’ তাদের কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করতে হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানে বিরোধে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব তুলে ধরতে আটলান্টিক কাউন্সিল তাদের প্রতিবেদনে দেশ ধরে ধরে আলোচনা করেছে-
বাংলাদেশ: স্পষ্ট থেকে অনিশ্চয়তায়: বাংলাদেশ অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে। শেখ হাসিনার ভারতপন্থি সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা এখন পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ এবং ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলো এখন একটা ‘সন্দেহে’ একমত। সেটা হলো, নয়া দিল্লি বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। তাদের এ ‘সন্দেহে’ রসদ জুগিয়েছে ভারতে শেখ হাসিনার আশ্রয় এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়া।
আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম এরই মধ্যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতবিরোধী মনোভাব যত বাড়ছে, ঢাকা ততই দেশটির বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার চাপে পড়ছে। ভারত এরই মধ্যে সিলিগুড়ি করিডোরে (চিকেনস নেক নামে পরিচিত) নিরাপত্তা জোরদার করেছে। কারণ বাংলাদেশ এখন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবেও বাংলাদেশ রাজি হয়েছে, যেখানে রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি ভারতের জন্য বেশ উদ্বেগজনক। তারা এমন এক বাংলাদেশ দেখছে, যারা এখন চীনের মাধ্যমে অবকাঠামোতে বৈচিত্র্য আনা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপনের দিকে এগোচ্ছে। ঢাকা সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছে, ভারত অন্তত ২৬০ জনকে জোর করে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিয়েছে, যাদের মধ্যে অনিবন্ধিত অভিবাসী ও রোহিঙ্গা থাকার কথা বলা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ যদি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিজেদের মত করে সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজস্ব কৌশল অনুসরণ করে, দেশটি বঙ্গোপসাগরের শক্তির ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। ভৌগলিকভাবে মিয়ানমারের পাশে অবস্থান হওয়ায় এখানে মূলত বাংলাদেশের গুরুত্বটা বেশি।
জটিল সমীকরণ শ্রীলঙ্কা: শ্রীলঙ্কা এখনও অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আছে। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপও নিতে হচ্ছে দেশটিকে। সার্বিক পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে তাদের স্পষ্টভাবে অবস্থান নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকার কারণেও উত্তরের প্রতিবেশীর প্রতি আনুগত্য দেখানোটা তাদের জন্য ‘জরুরি’।
কিন্তু একই সময়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে চীন। হাম্বানটোটা বন্দর থেকে শুরু করে পোর্ট সিটি কলম্বো- সব স্থানেই আছে চীনের উপস্থিতি। ফলে ভারতের নীতিনির্ধারকরা আঞ্চলিক সংহতি প্রত্যাশা করলেও শ্রীলঙ্কার জন্য সেটা করা কঠিন। কারণ এতে তাদের কৌশলগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কাকে তার মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে। ভারতের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান নিলে দেশটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব পরিস্থিতি হিসাবনিকাশ করে শ্রীলঙ্কা চাইছে ভারত ও চীনের সঙ্গে তাদের ভারসাম্যপূর্ণ একটা সম্পর্ক থাকুক।
নেপাল: নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ সীমিত: নেপাল দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। দেশটি একদিকে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল মোটরযান চুক্তিতে আছে; অন্যদিকে আবার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে অবকাঠামো ও বাণিজ্যে বৈচিত্র্যও আনতে চাচ্ছে। তবে এ ধরনের সংকটকালে নিরপেক্ষ থাকাটা নেপালের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করে নেপাল একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যেখানে মাধেশি জনগোষ্ঠীর (যাদের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে) দাবিকে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তোলে নয়া দিল্লি। এ ঘটনার পর সীমান্তে কয়েক মাস ‘অঘোষিত’ অবরোধ আরোপ করে তারা। এর আগে ১৯৮৯ সালেও চীন থেকে অস্ত্র কেনার প্রতিবাদে নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ভারত। সবশেষ ২০১৯ সালে একটি নতুন রাজনৈতিক মানচিত্রে বিরোধপূর্ণ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে ভারত। এর জবাবে নেপালের সংসদও একটি সংশোধিত মানচিত্র প্রকাশ করে।
ভুটান: চিন্তায় বদল আসতেই পারে: ভুটান এখনও ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই পরিচিত। কারণ দুই দেশের ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৪৯ সালের মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের গোড়াপত্তন ঘটে। তবে ভারত তাদের পশ্চিম সীমান্তে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় উত্তর সীমান্তে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যেখানে চীনের আনাগোনা বাড়ছে। এক্ষত্রে ২০১৭ সালের ডোকলাম নিয়ে বিরোধের ঘটনা ছিল বেশ আলোচিত। ওই বছর ভারত ও চীনের সেনারা প্রায় ৭৩ দিন সেখানে মুখোমুখি অবস্থানে ছিলেন। সেখানে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সড়ক নির্মাণ নিয়ে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। সড়ক নির্মাণের এলাকাটি ভারত, চীন ও ভুটানের সীমানার কাছাকাছি। এর মধ্যে চীন ও ভুটান উভয়েই এলাকাটি নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। ভারতের ‘মাথা ব্যাথার’ কারণ হল, এলাকাটি তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মির সংকটের মত ঘটনা ভুটানের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনে না। তবে এগুলো থিম্পুকে তার কৌশলগত পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে; বিশেষ করে সেই সময়টায়, যখন ভারতের আঞ্চলিক মনোযোগ তাদের ওপর থেকে সরে যায়।
মালদ্বীপ: উসকে যেতে পারে ভারতবিরোধী মনোভাব: কাশ্মির সংকট মালদ্বীপে ইসলামপন্থি ও রক্ষণশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে আবারও ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দিতে পারে। কিন্তু এমন সময় কাশ্মির ইস্যু সামনে এল, নয়া দিল্লি যখন ভারত মহাসাগরে নিজেদের নৌসেনা উপস্থিতি জোরদার করতে চাইছে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ২০২৩ সালের নির্বাচনে জেতেন ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগানকে পুঁজি বানিয়ে। ওই সময় ভারতের সামরিক উপস্থিতিকে মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। পরে অবশ্য তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা মেরামতের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাশ্মির ইস্যুতে তার সেই চেষ্টা আবার থমকে যেতে পারে।