প্রত্যাশা ডেস্ক: বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার বিচার শেষ হলেও একই দিনে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় মোহাম্মাদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহতের মামলার বিচার এখনো আটকে আছে আসামির নাম নিয়ে তথ্যবিভ্রাটের কারণে।
ঢাকার ত্রয়োদশ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “এক আসামির নামের বিষয়ে বিভ্রাট রয়েছে। এজন্য জেল সুপারকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে না, মামলা এগোচ্ছে না।”
স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে।
সেদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া ওই কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় ৪০ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজন সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
নিহতরা হলেন– রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ইনডেমনিটি আইনের ফলে এ ঘটনা নিয়েও মামলা করতে পারেননি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। ওই সময়ই ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন শেরশাহ সুরী রোডের টিনশেড বস্তির ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী, যিনি কামানের গোলায় আহত হয়েছিলেন।
২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।
তবে এতদিনেও মামলার বিচার শেষ হয়নি। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন ছিল।
২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি সিআইডির তৎকালীন এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ১৮ তম সাক্ষী হিসেবে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। এরপর আর কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি।
এরই মাঝে ২০২১ সালের ২ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একটি আবেদন করা হয়। এ মামলার পলাতক আসামিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোন কোন আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন চাওয়ার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এবং মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। কোন কোন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে এবং আসামিদের কেউ মারা গেছে কি না, তা জানাতে বলা হয় সেখানে।
ওই বছর ৩০ নভেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু প্রতিবেদনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে মেজর মো.বজলুল হুদার নামের ক্ষেত্রে কিছুট বিভ্রাট দেখা দেয়।
এরপর তার বিষয়টি স্পষ্ট করে আলাদা প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তবে এবিষয়ে আর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। ফলে মামলার বিচারও থমকে আছে।
এরই মাঝে মামলাটি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ঢাকার ত্রয়োদশ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কুদরত-এ-এলাহীর আদালতে পাঠানো হয়। দুই বছর ধরে এ আদালতে মামলার বিচারে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সর্বশেষ গত ১৫ জুন এ মামলায় আসামির নামের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ছিল। কিন্তু জেল সুপার প্রতিবেদন জমা দেয়নি। আগামি ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমার পরবর্তী তারিখ রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “জেল সুপারকে ইনফর্ম করব, যেন প্রতিবেদনটা দ্রুত দেন। মামলার বিচারটা যেন শেষ হয়।”
এদিকে মামলার বাদী মোহাম্মাদ আলী ২০২১ সালে মারা যান। তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাহনাজ আক্তার মেরিনা বলেন, তার স্বামীর ইচ্ছা ছিল বিচার দেখে যাবেন। কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন।
“একটা ঘটনা তো ঘটছে, ১৩ জন মারা গেছে। আমরা চাই, এটার বিচার হোক।”
স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে আর্থিক সংকটের মধ্যে বাবার বাড়িতে আছেন শাহনাজ আক্তার মেরিনা। তিনি বলেন, “আমাদের দেখার কেউ নাই। দরিদ্র বাবার সংসারে বোঝা হয়ে গেছি।”
এ মামলার ১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ।
ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদেরও ফাঁসি কার্যকর হয়।
এখনো পলাতক রয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।
এসি/