নড়াইল প্রতিনিধি : নড়াইলের দিঘলিয়া এলাকায় মহানবী (সা.)-কে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার ৫ জনের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গত সোমবার বিকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লোহাগড়া থানার এসআই মিজানুর রহমান আসামিদের সাতদিন করে রিমান্ড আবেদন করলে লোহাগড়া আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোরশেদুল আলম শুনানি শেষে তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেফতার আসামিরা হলো— মৃধা, সাঈদ শেখ, কবির গাজী, রেজাউল শেখ ও মামুন মৃধা ওরফে মাসুম।
লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আবু হেনা মিলন বলেন, এ ঘটনায় রবিবার রাতে ২৫০ জনকে আসামি করে লোহাগড়া থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। এরপর বিভিন্ন এলাকা থেকে ওই ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই নড়াইলের দিঘলিয়া এলাকার কলেজছাত্র আকাশ সাহার ফেসবুকে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি ওইদিন জুম্মার নামাজের পর বিভিন্ন পেশার মানুষের নজরে আসে। এরপর বিক্ষুদ্ধ লোকজন আকাশ সাহার গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে তাদের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করেন। ওইদিন বিকাল থেকে উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। বিক্ষুদ্ধ লোকজন একইদিন রাত ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে সাহাপাড়ার ৩টি বাড়িঘর ভাংচুর করেন। এর মধ্যে একটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে দুই রুম বিশিষ্ট টিনের শেড ঘরের মধ্যে থাকা আসবাবপত্র ও মালামাল পুড়ে যায়। এছাড়া সাহাপাড়ার ২টি মন্দির ও আখড়াবাড়ি মন্দিরে হামলা চালায় তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে।
নড়াইলে হামলার প্রতিবাদে জাবিতে মানববন্ধন : নড়াইলের লোহাগড়ার সাহাপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনের সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। হামলার নিন্দা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন শিক্ষকরা। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক যুগল কৃষ্ণ দাস বলেন, “আমরা সবার আগে বাঙালি, তারপর আমাদের ধর্ম। কখনোই ধর্ম আমাদের বাঙালি পরিচয়ের আগে হতে পারে না। একের পর এক হামলা আর লুটপাটের পর দেখা যায় প্রশাসন প্রায় নিশ্চুপ থাকে। প্রশাসনের ভিতরেই সাম্প্রদায়িকতা ঘাপটি মেরে আছে। তাদেরকেও খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হোক।”
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এক ধর্মের মানুষ সে যদি নিজের ধর্ম মানে তাহলে সে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর আক্রমণ করতে পারেন না। আমরা কথায় কথায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে দাবি করি; আসলে কতটা নিরপেক্ষ তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। একের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েই যাচ্ছে। কারা হামলা করছে, এদের পিছনে আসলে ইন্ধন দিচ্ছে কারা তা তদন্ত করা হোক, তদন্ত করে তাদেরকে বের করে বিচার করা হোক এবং তাদের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করা হোক।”
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, গণিত বিভাগের অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ বলেন, “অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই লড়াই করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে আমরা কাজ করতে পারছি না। বাংলাদেশে বিশেষত ১৯৭৫-এর পর থেকে রাজনীতিতে একটা সাম্প্রদায়িক দল লালন-পালন হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা না দিতে পারা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জাজনক। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আমরা শিক্ষক সমাজ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম, আছি এবং থাকব।”
“ধর্মের নামে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে লালন-পালন করছে। হামলাকারীদের পিছনে কারা আছে এবং কারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি লুট করেছে তা তদন্ত করে বের করা হোক। সরকার যদি জঙ্গি দমন করতে পারে তাহলে এদেরকেও দমন করা সম্ভব।”
এ ছাড়া শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোতাহার হোসেনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সেলিম, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা আক্তার, একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহিবুর রৌফ। স্থানীয়রা জানান, এক ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে দিঘলিয়ায় শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সাহাপাড়ার আকাশ সাহার গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে তাদের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করে লোকজন। বিকালে উত্তেজনা আরও বাড়ে এবং সন্ধ্যায় ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে সাহাপাড়ার কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় মন্দিরে ঢিলও ছোঁড়া হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বাড়িঘর ও দোকান ভাঙচুর এবং দুটি মন্দিরে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলা ছাড়াও ১৫ জুলাই রাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে আরেকটি মামলা করা হয়। সেই মামলার বাদী লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সালাউদ্দিন কচি নামের এক ব্যক্তি। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দিঘলিয়ার সাহাপাড়ার আকাশ সাহাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
নড়াইলে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার ৫ জন রিমান্ডে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ