ঢাকা ১১:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

ন্যায়বিচারে বাধা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপপ্রয়োগ

  • আপডেট সময় : ০৬:৩২:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
  • ৬৫ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু ডেস্ক: আমাদের সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীরা আজও পিছিয়ে রয়েছে বা পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে তাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ নারী উন্নয়ন ছাড়া সমাজের কোনো উন্নয়নের কথা কল্পনাও করা যায় না।
উন্নয়নের মূল স্রোতে নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের উন্নয়ন একটা ফাঁপা চিন্তা; যা কখনো সম্ভব নয়।
অধিকার রক্ষা করা না গেলে নারী একদিকে যেমন অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে; অন্যদিকে তেমনি হীনতায়, বাধাগ্রস্ত হবে তার স্বাভাবিক বিকাশ।
উন্নত রাষ্ট্রগুলো নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশও নারী অধিকার স্বীকৃতির মাধ্যমে নারী উন্নয়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংবিধানেও নারী অধিকারের কথা বলা আছে (অনুচ্ছেদ ২৮ ও ২৯)।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য দেশে একাধিক আইন আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন (দমন) আইন ২০০০, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ ইত্যাদি।
আইনগুলোর ভেতরে নারী ও শিশু নির্যাতন (দমন) আইন ২০০০ এ নারী ও শিশু সম্পর্কিত অপরাধগুলোকে চিহ্নিত করে তা প্রতিকারের বিধি-বিধান প্রণীত আছে; যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু নারী ও শিশু অধিকারের এ বিধানগুলো নিয়ে অন্যকে ঘায়েল করার মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে নারী অধিকার তো প্রতিষ্ঠিত হয়ই না, বরং আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নারীকে বঞ্চিত করা হয় ন্যায়বিচার থেকে।
ঘটনা-১: সুমাইয়া (প্রকৃত নাম নয়) বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি মেয়ে। মেধাবী। লাইব্রেরী কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা আর পড়াশোনাই তার একমাত্র কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়াই তার লক্ষ্য। ভালো পড়াশোনা করা ফলে পরীক্ষায় সে বরাবরই প্রথম হয়ে আসছে। হঠাৎ একদিন তার শিক্ষক তাকে বাসায় ডাকল। ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষক তাকে বেশ সাহস, উৎসাহ দিলেন। ঐ শিক্ষকের প্রতি তার এক ধরনের দূর্বলতা তৈরি হল এবং তার প্রতি সম্মানের জায়গাটা গেটু গেয়ে আসন গাড়ল তার মনে। কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার ডাক পড়ল। বাসায় হাজির হওয়ার পর কুশল বিনিময় করল। অতঃপর শিক্ষক ঐ ছাত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের করে। এ ঘটনা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুললো। কাছের বন্ধুদের কাছে বিষয়টি বলার পর তাদের পরামর্শে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মনঃস্থির করল।
আইনজীবীর পরামর্শে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০০ এর ৯ ধারা মোতাবেক মামলা রুজু করল। ধারা ৯ এর ব্যাখ্যাতে বলা আছে, “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতিত [ষোলো বছরের] অধিক বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া… যৌন সঙ্গম করে, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।’ এর শাস্তি হলো মৃত্যদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকার উপরে অর্থদণ্ড (ধারা ৯(৩)। আসামিপক্ষ প্রমাণ করতে সমর্থ হয় যে ছাত্রীর এতে সম্মতি ছিল। ফলে আসামিখালাস পায়।
ঘটনা-২: আসিফ (ছদ্মনাম) নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটি ছেলে। পিতৃহীন আসিফ মায়ের একক প্রচেষ্ঠায় স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডি পেরিয়ে বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন বিয়ে করে তার সাথে পড়ুয়া রিমিকে (ছদ্মনাম)।
বিয়ের পর কয়েক মাস বেশ ভালই কাটল। বছর খানেকের মাথায় তাদের বোঝাপড়ায় ঘাটতি দেখা দিল। আর কোনভাবেই তাদের বনিবনা হচ্ছে না। তারা দু’জনই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিল।
হঠাৎ একদিন আসিফের বাসায় পুলিশ এসে হাজির। তার বিরুদ্ধে রিমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩ এর ১১ ধারা মোতাবেক থানায় মামলা রুজু করে। বলে রাখা ভালো উক্ত আইনটির সকল অপরাধ অজামিনযোগ্য। যার শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ইত্যাদি (ধারা ১১খ)।
প্রায়ই ছ’মাস জেলে থাকার পর তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু ততদিনে তার চাকরিটি চলে যায়। ফলে অযথা আর্থিক,সামাজিক টানাপোড়নের ভেতরে পড়ে। কিন্তু এ আইনের ১৭ ধারার মিথ্যা মামলা কিংবা অভিযোগ দায়েরের জন্য শাস্তির বিধান আছে। যার কার্যকারিতা শুরু হয় ভূক্তভোগীর লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে।
এ রকম অনেক ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। আইন যেখানে প্রতিকার হিসেবে কাজ করার কথা। কখনো কখনো তা কাউকে ঘায়েল করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহ্রত হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যদিও নারী ও শিশুর অধিকারকে অধিকতর গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করা হয়। তারপরও এ আইনের অপপ্রয়োগের দরুন নারী ও শিশু তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। কোনো কোনো সময় দেখা যায় পুরুষকে নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। ফলে বিচারকরা শতকরা ৯৫ ভাগ আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। তাই আইনটিকে আরো যগোপযুগী করার প্রয়োজন রয়েছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যাতে অন্য কারো অধিকার বিঘ্নিত না হয় সে দিকেও দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন কমাতে নিম্নলিখিত ধারার কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজনÑ
= আইনের ১৭ ধারা মোতাবেক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া আরম্ভ করলে মিথ্যা মামলা অনেকাংশে কমে যাবে। ভূক্তভোগীর আবেদন ব্যতিত যা ১৭(২) ধারা মোতাবেক লিখিত হওয়া বাঞ্ছনীয় তা উঠিয়ে দিয়ে বিচারক রায়ে মিথ্যা মামলাকারীকে চিহ্ণিত করে তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা গেলে মিথ্যা মামলা নিঃসন্দেহে কমে যাবে।
= পুলিশি তদন্তের জন্য প্রযোজ্য ১৮ ধারাকে আরো পরিবর্তন করে পুলিশকে আরো আইনি বাধ্যবাধকতায় নিয়ে আসা। তদন্তে অবহেলাকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে বিধি অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
= ধারা ২০(৬) তে বর্ণিত ৯(ধর্ষণ) ধারায় আনীত অভিযোগ রুদ্ধকার কক্ষে অনুষ্ঠানসহ পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করা যায় কিনা, সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। অন্তত তাতে করে প্রকৃত ধর্ষণের শিকার নারীরা আইনের আশ্রয় নিতে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে। সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার যে ভয় থাকে তা অনেকটা হ্রাস পাবে। নারীরা অযথা হয়রানি থেকে রেহাই পাবে।
= মিথ্যা মামলায় সহায়তা করার জন্য আইনজীবিকে জব্বাদিহির আওতায় নিয়ে এসে সাবধান করে দেওয়া।
মোদ্দা কথা, আইনের কাজ সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা আনয়ন ও নিশ্চিত করা, বিঘ্নিত করা নয়। তাই আইনি পরিকাঠামোর ভেতরে থেকেও যাতে কারো অধিকার লংঘিত না হয় সেটিও বিবেচ্য বিষয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০০ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। আইন প্রয়োগের শিথিলতা যেমন পুরো আইনটিকে অকার্যকর করে রাখে, তেমনি প্রয়োজনীয় সংশোধনীর অভাবেও তা প্রণয়নের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে দিতে পারে।

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ন্যায়বিচারে বাধা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপপ্রয়োগ

আপডেট সময় : ০৬:৩২:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

নারী ও শিশু ডেস্ক: আমাদের সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীরা আজও পিছিয়ে রয়েছে বা পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে তাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ নারী উন্নয়ন ছাড়া সমাজের কোনো উন্নয়নের কথা কল্পনাও করা যায় না।
উন্নয়নের মূল স্রোতে নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের উন্নয়ন একটা ফাঁপা চিন্তা; যা কখনো সম্ভব নয়।
অধিকার রক্ষা করা না গেলে নারী একদিকে যেমন অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে; অন্যদিকে তেমনি হীনতায়, বাধাগ্রস্ত হবে তার স্বাভাবিক বিকাশ।
উন্নত রাষ্ট্রগুলো নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশও নারী অধিকার স্বীকৃতির মাধ্যমে নারী উন্নয়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংবিধানেও নারী অধিকারের কথা বলা আছে (অনুচ্ছেদ ২৮ ও ২৯)।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য দেশে একাধিক আইন আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন (দমন) আইন ২০০০, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ ইত্যাদি।
আইনগুলোর ভেতরে নারী ও শিশু নির্যাতন (দমন) আইন ২০০০ এ নারী ও শিশু সম্পর্কিত অপরাধগুলোকে চিহ্নিত করে তা প্রতিকারের বিধি-বিধান প্রণীত আছে; যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু নারী ও শিশু অধিকারের এ বিধানগুলো নিয়ে অন্যকে ঘায়েল করার মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে নারী অধিকার তো প্রতিষ্ঠিত হয়ই না, বরং আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নারীকে বঞ্চিত করা হয় ন্যায়বিচার থেকে।
ঘটনা-১: সুমাইয়া (প্রকৃত নাম নয়) বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি মেয়ে। মেধাবী। লাইব্রেরী কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা আর পড়াশোনাই তার একমাত্র কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়াই তার লক্ষ্য। ভালো পড়াশোনা করা ফলে পরীক্ষায় সে বরাবরই প্রথম হয়ে আসছে। হঠাৎ একদিন তার শিক্ষক তাকে বাসায় ডাকল। ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষক তাকে বেশ সাহস, উৎসাহ দিলেন। ঐ শিক্ষকের প্রতি তার এক ধরনের দূর্বলতা তৈরি হল এবং তার প্রতি সম্মানের জায়গাটা গেটু গেয়ে আসন গাড়ল তার মনে। কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার ডাক পড়ল। বাসায় হাজির হওয়ার পর কুশল বিনিময় করল। অতঃপর শিক্ষক ঐ ছাত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের করে। এ ঘটনা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুললো। কাছের বন্ধুদের কাছে বিষয়টি বলার পর তাদের পরামর্শে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মনঃস্থির করল।
আইনজীবীর পরামর্শে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০০ এর ৯ ধারা মোতাবেক মামলা রুজু করল। ধারা ৯ এর ব্যাখ্যাতে বলা আছে, “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতিত [ষোলো বছরের] অধিক বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া… যৌন সঙ্গম করে, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।’ এর শাস্তি হলো মৃত্যদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকার উপরে অর্থদণ্ড (ধারা ৯(৩)। আসামিপক্ষ প্রমাণ করতে সমর্থ হয় যে ছাত্রীর এতে সম্মতি ছিল। ফলে আসামিখালাস পায়।
ঘটনা-২: আসিফ (ছদ্মনাম) নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটি ছেলে। পিতৃহীন আসিফ মায়ের একক প্রচেষ্ঠায় স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডি পেরিয়ে বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন বিয়ে করে তার সাথে পড়ুয়া রিমিকে (ছদ্মনাম)।
বিয়ের পর কয়েক মাস বেশ ভালই কাটল। বছর খানেকের মাথায় তাদের বোঝাপড়ায় ঘাটতি দেখা দিল। আর কোনভাবেই তাদের বনিবনা হচ্ছে না। তারা দু’জনই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিল।
হঠাৎ একদিন আসিফের বাসায় পুলিশ এসে হাজির। তার বিরুদ্ধে রিমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩ এর ১১ ধারা মোতাবেক থানায় মামলা রুজু করে। বলে রাখা ভালো উক্ত আইনটির সকল অপরাধ অজামিনযোগ্য। যার শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ইত্যাদি (ধারা ১১খ)।
প্রায়ই ছ’মাস জেলে থাকার পর তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু ততদিনে তার চাকরিটি চলে যায়। ফলে অযথা আর্থিক,সামাজিক টানাপোড়নের ভেতরে পড়ে। কিন্তু এ আইনের ১৭ ধারার মিথ্যা মামলা কিংবা অভিযোগ দায়েরের জন্য শাস্তির বিধান আছে। যার কার্যকারিতা শুরু হয় ভূক্তভোগীর লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে।
এ রকম অনেক ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। আইন যেখানে প্রতিকার হিসেবে কাজ করার কথা। কখনো কখনো তা কাউকে ঘায়েল করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহ্রত হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যদিও নারী ও শিশুর অধিকারকে অধিকতর গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করা হয়। তারপরও এ আইনের অপপ্রয়োগের দরুন নারী ও শিশু তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। কোনো কোনো সময় দেখা যায় পুরুষকে নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। ফলে বিচারকরা শতকরা ৯৫ ভাগ আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। তাই আইনটিকে আরো যগোপযুগী করার প্রয়োজন রয়েছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যাতে অন্য কারো অধিকার বিঘ্নিত না হয় সে দিকেও দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন কমাতে নিম্নলিখিত ধারার কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজনÑ
= আইনের ১৭ ধারা মোতাবেক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া আরম্ভ করলে মিথ্যা মামলা অনেকাংশে কমে যাবে। ভূক্তভোগীর আবেদন ব্যতিত যা ১৭(২) ধারা মোতাবেক লিখিত হওয়া বাঞ্ছনীয় তা উঠিয়ে দিয়ে বিচারক রায়ে মিথ্যা মামলাকারীকে চিহ্ণিত করে তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা গেলে মিথ্যা মামলা নিঃসন্দেহে কমে যাবে।
= পুলিশি তদন্তের জন্য প্রযোজ্য ১৮ ধারাকে আরো পরিবর্তন করে পুলিশকে আরো আইনি বাধ্যবাধকতায় নিয়ে আসা। তদন্তে অবহেলাকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে বিধি অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
= ধারা ২০(৬) তে বর্ণিত ৯(ধর্ষণ) ধারায় আনীত অভিযোগ রুদ্ধকার কক্ষে অনুষ্ঠানসহ পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করা যায় কিনা, সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। অন্তত তাতে করে প্রকৃত ধর্ষণের শিকার নারীরা আইনের আশ্রয় নিতে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে। সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার যে ভয় থাকে তা অনেকটা হ্রাস পাবে। নারীরা অযথা হয়রানি থেকে রেহাই পাবে।
= মিথ্যা মামলায় সহায়তা করার জন্য আইনজীবিকে জব্বাদিহির আওতায় নিয়ে এসে সাবধান করে দেওয়া।
মোদ্দা কথা, আইনের কাজ সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা আনয়ন ও নিশ্চিত করা, বিঘ্নিত করা নয়। তাই আইনি পরিকাঠামোর ভেতরে থেকেও যাতে কারো অধিকার লংঘিত না হয় সেটিও বিবেচ্য বিষয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০০ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। আইন প্রয়োগের শিথিলতা যেমন পুরো আইনটিকে অকার্যকর করে রাখে, তেমনি প্রয়োজনীয় সংশোধনীর অভাবেও তা প্রণয়নের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে দিতে পারে।