আমীন আল রশীদ : গোলাম ফারুক অভি। এক সময়ের আলোচিত ও বিতর্কিত ছাত্রনেতা। দীর্ঘদিন ধরে ‘দেশান্তরী’। এবার খবরের শিরোনাম আলোচিত মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পেয়ে।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর ছাড়া পেয়ে যাওয়া; আগের সরকারের আমলে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের একের পর এক খালাস ও মুক্তির ধারাবাহিকতায় গোলাম ফারুক অভির ঘটনাটিও হয়তো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
অভি এই মামলার একমাত্র আসামি। তাই তার খালাসের মধ্য দিয়ে কিছু প্রশ্নের জন্ম হলো। যেমন, ২২ বছর আগের এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় হতে এতদিন লাগলো কেন বা রায়টি এই সময়েই কেন হলো? পুলিশ কী তদন্ত করলো? বলা হয়, বাংলাদেশে বড় বড় অপরাধী খালাস পেয়ে যায় বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না তার প্রধান কারণ দুটিÑ
১. পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত এবং ২. পর্যাপ্ত সাক্ষীর অভাব। তিন্নি হত্যায় কী ঘটেছেÑ পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত, সাক্ষীর অভাব নাকি অন্য কিছু?
অভি কে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় গোলাম ফারুক অভি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে একটি হত্যা মামলার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যাতেও তিনি অভিযুক্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গেস্ট রুম থেকে একটি কাটারাইফেল ও বিদেশি পিস্তলসহ অভিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯৩ সালের ২১ আগস্ট ওই মামলায় তার ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়। তিন বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালতে আপিল করে জামিন পান। পরবর্তীকালে ডা. মিলন হত্যাসহ দুটি হত্যা মামলায় তিনি খালাস পান।
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে ছাত্রদল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অভি একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তার সাথে তৎকালীন সরকারের গোপন যোগাযোগ রয়েছে, এই অভিযোগে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর তাকে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯৬ সালের ৯ মে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ১২ জুন অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসন থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৯৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিএনপির সাথে সংসদ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে গোলাম ফারুক অভিসহ দলের ১০ জন সংসদ সদস্য ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) গঠিত হলে গোলাম ফারুক অভি এই দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভি পরাজিত হন।
অভি এরপর নতুন করে আলোচনায় আসেন ২০০২ সালে মডেল ও অভিনয়শিল্পী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যার ঘটনায়। ওই বছরের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা নদীর ওপরে অবস্থিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু ১-এর নিচে তিন্নির মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে পুলিশ যে অভিযোগপত্র দেয় তাতে বলা হয়, অভির প্ররোচনায় মডেল তিন্নি তার স্বামীকে তালাক দেন। কিন্তু অভি এরপর তিন্নিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। তিন্নি এসব তথ্য মিডিয়ায় ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে অভি ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর রাতের যেকোনও সময় তিন্নিকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য গাড়িতে করে বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে ফেলে রেখে যান। মামলার পরে অভি কানাডায় চলে যান।
সাতজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদল হয়ে ৮ বছর পর ২০১০ সালে অভিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। ওই বছরের ১৪ জুলাই ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এই মামলায় অনুপস্থিত অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে অভির পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী মডেল তিন্নি আত্মহত্যা করেছেন- এই মর্মে মামলাটি খারিজ করার জন্য বিচারাধীন আদালতে আবেদন করেন।
হাইকোর্টের নির্দেশে ওই মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় পাঁচ বছর স্থগিত থাকার পরে ২০১৫ সালে মামলাটির বিচার কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট মামলাটি রায়ের জন্য ধার্য ছিল। রায়ের তারিখ ৩১ বার পরিবর্তন করার পর ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর আদালত পুনরায় সাক্ষ্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। ২০২২ সালে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ পুনরায় করে শুরু হয়। অবশেষে গত মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) মামলার রায়ে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত অভিকে খালাস দেন।
একমাত্র আসামি যখন খালাস পেয়ে যান তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তিন্নিকে কে খুন করলো বা তিন্নি আদৌ খুন হয়েছিলেন কি না? যদি খুন হয়ে থাকেন তাহলে পুলিশ তদন্ত করে কীভাবে একমাত্র আসামি হিসেবে অভির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিল? সাধারণত নিশ্চিত না হয়ে বা নিশ্চিত হওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ না থাকলে হত্যা মামলায় একজনকে আসামি করা হয় না। একাধিক লোককে আসামি করা হয়। অনেক সময় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে আরও অনেকে জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। এর মানে, একমাত্র আসামি হিসেবে হয় অভির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল নিশ্চিত হয়েই অথবা প্রকৃত ঘটনা ও অপরাধীদের আড়াল করার জন্য অভিকে একমাত্র আসামি করা হয়েছিল। তাই যদি হয় তাহলে প্রশ্ন করতে হবে তিন্নিকে কে খুন করলো, নাকি সেই সিনেমার মতো ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’; যে প্রশ্নটি উঠেছিল কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ক্ষেত্রেও।
নো ওয়ান কিলড তনু: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু খুন হয়েছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। ‘স্পর্শকাতর’ স্থানে খুন হয়েছেন বলে ওই ঘটনাটি নিয়েও খুব বেশি আলোচনা হয় না। সবাই মন খুলে প্রশ্ন করারও সাহস করেন না। ফলে এই কেসটিও ‘নো ওয়ান কিলড তনু’ হিসেবেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের জঙ্গল থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন তনুর বাবা কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। কিন্তু এই মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। হত্যার আট বছরেও জানা যায়নি অথবা জানা গেলেও প্রকাশ করা হয়নি চাঞ্চল্যকর ওই হত্যাকাণ্ডের কারণ কী ছিল এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত?
তনু হত্যা মামলায় আট বছরে পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। বছর চারেক আগে মামলার তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) স্থানান্তর করা হয়। তারাও এ মামলার কোনো কিনারা করতে পারেনি। কোনো আসামি শনাক্ত হয়নি। গত বছরের ২০ মার্চ প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হয়, পিবিআইয়ের সঙ্গে তনুর মা–বাবার যোগাযোগও নেই। মেয়ের হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষুব্ধ তনুর বাবা ও মামলার বাদী ইয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘পিবিআই তো দেখাই করে না। আট বছর হলো মামলা দিছি। পুরো দেশবাসী বিচারটা চায়।’
সাগর-রুনি সমাচার: ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। এরপর নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ পর্যন্ত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে ১১৪ বার সময় নিয়েছে র্যাব। পরবর্তী তারিখ আগামী ২৭ জানুয়ারি।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শিগগিরই সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত আলোর মুখ দেখবে। তিনি মামলার তদন্তভার র্যাব থেকে অন্য কোনো বাহিনীকে হস্তান্তরেও ইঙ্গিত দেন।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তের দায়িত্ব র্যাব থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিষয়টি নিয়ে শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ‘আশা করি এবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে এবং তদন্তের জন্য দেয়া এবারের ছয় মাস মানে ছয় মাস।’ এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৬ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট।
নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহার খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের ধরা হবে বলে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি হয় শুধু কথার কথা ছিল না, হয় রাষ্ট্রের এমন কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী এই হত্যার সঙ্গে জড়িত, বিগত সরকার যাদের ‘ঘাঁটাতে’ চায়নি।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদও গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া তার অভিভাষণে বলেন, ‘আমরা দেখেছি চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে শতাধিকবার সময় নেয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। তদন্ত কাজেই যদি একাধিক বছর সময় লেগে যায়, সে মামলার বিচারকাজ পরিচালনা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা সময়ের আবর্তে মামলার অনেক সাক্ষী ও সাক্ষ্য হারিয়ে যায়।’
ন্যায়বিচারের মানদণ্ড: বিচার কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এর কোনো মূল্য নেই। তাছাড়া বিচারকে দৃশ্যমান হতে হয়। মানুষকে জানাতে হয় বিচারটি সুসম্পন্ন হয়েছে যাতে অন্যদের মনে ভয় ঢোকে। মানুষ যদি আইনকে ভয় না করে, অপরাধ করলে একদিন না একদিন শাস্তি পেতেই হবে, এই বিশ্বাস ও বোধ যদি তার মনের ভেরে গেঁথে না যায়, তাহলে সুযোগ পেলেই সে অপরাধ করবে। তাছাড়া ন্যায়বিচার যে হয়েছে এটিও মানুষের মনে গেঁথে দিতে হয়।
মানুষ যদি মনে করে, এখানে বিচার হয়েছে ঠিকই তাহলে সেটি পক্ষপাতদুষ্ট বা কোনো কোনো অপরাধী বিশেষ কারণে লঘু দণ্ড পেয়েছে। আর মানুষ যদি মনে করে বিচারিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়েছে তাহলে সেই বিচারের শাস্তি যতই দৃষ্টান্তমূলক হোক না কেন, জনআস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
তাই বিচার হওয়াটা যেমন জরুরি, এর চেয়ে বেশি জরুরি সেখানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আরও জরুরি সেই বিচারকে সর্বজনগ্রাহ্য এবং দৃশ্যমান করা যাতে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্বের সংশয় তৈরি না হয়। বলা হয়, কোনো একটি ঘটনায় পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কিংবা অন্য কোনো চাপের কারণে অপরাধী পার পেয়ে গেলেও যাতে কোনো নিরপরাধী লোক শাস্তি না পায়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।
পরিশেষে, মডেল তিন্নি, কলেজছাত্রী তনু কিংবা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে কারা হত্যা করেছে; সেটি খুঁজে বের করে তাদের প্রচলিত আইনে বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র যদি এটি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে অন্তত এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো নিরপরাধ লোককে শাস্তি দেওয়া হয়নি।
লেখক: সাংবাদিক।