আবদুল্লাহিল বাকি
বর্তমানে দ্বন্দ্ব-মুখর পরিবেশে প্রকট হয়ে উঠেছে নৈতিকতা ও আত্মিক মূল্যবোধের সংকট। সমাজ যখন কেবল পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও বাহ্যিক সাফল্যে মনোনিবেশ করে, তখন ব্যক্তি ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। তার নৈতিক চেতনায় এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়।
সত্যের প্রতি উদাসীনতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় শৈথিল্য, অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অহংবোধ—এই বিষয়গুলো ব্যক্তিকে তার মানবিক সারাৎসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই বিচ্ছিন্নতাই বর্তমানে নৈতিক সংকটের মূল উৎস। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ নিহিত আছে আত্ম-জিজ্ঞাসা, আত্ম-বিশ্লেষণ এবং আত্ম-সংশোধনের মধ্যে। যুগ যুগ ধরে আধ্যাত্মিক সাধকরা এই আত্মশুদ্ধির পথ বাতলে দিয়েছেন।
আধ্যাত্মিক সাধক বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) মানুষের নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়নের জন্য এমনই কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছেন। দশটি গুণের কথা বলেছেন তিনি; যা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ আত্মার অসুখ থেকে মুক্ত হয়ে এক পরিশুদ্ধ ও উন্নত সত্তায় উন্নীত হতে পারে।
দশটি গুণের কথা বলেছেন তিনি; যা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ আত্মার অসুখ থেকে মুক্ত হয়ে এক পরিশুদ্ধ ও উন্নত সত্তায় উন্নীত হতে পারে। তাঁর এই নির্দেশনা আজকের প্রেক্ষাপটে আত্ম-উপলব্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
আল-গুনিয়াতু লি-তালিবি তারীকিল হাক (সত্যপথের সাধকদের পাথেয়) গ্রন্থে তিনি বলেন, যারা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে ব্রতী, আত্ম-সমালোচনায় অভ্যস্ত এবং দৃঢ়-সংকল্প, তাদের জন্য দশটি পরীক্ষিত গুণ রয়েছে। এই গুণাবলি নিষ্ঠার সাথে অর্জন করতে পারলে, মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তারা আধ্যাত্মিক জগতের সর্বোচ্চ সোপানে আরোহণ করতে সক্ষম হয়।
১. আল্লাহর নামে শপথ করা থেকে বিরত থাকা: সত্য বা মিথ্যা, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়—কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর নামে শপথ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। যে ব্যক্তি তার জিহ্বাকে এই অভ্যাস থেকে মুক্ত করতে পারে, আল্লাহ তার অন্তর্দৃষ্টির জন্য নিজ নূর বা জ্যোতি থেকে একটি বিশেষ দ্বার উন্মোচন করেন। এর সুফল সে তার আত্মায় অনুভব করে, তার সংকল্পে দৃঢ়তা আসে, মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ তাকে সম্মানের চোখে দেখে।
২. মিথ্যা সর্বতোভাবে পরিহার করা: কৌতুক বা স্বেচ্ছায়—সর্বাবস্থায় মিথ্যা বলা পরিহার করতে হবে। যে ব্যক্তি এই গুণটি দৃঢ়ভাবে নিজের মধ্যে স্থাপন করতে পারে, আল্লাহ তার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দেন এবং তার জ্ঞানকে নির্মল করেন। এক পর্যায়ে মিথ্যা তার কাছে এতটাই ঘৃণ্য হয়ে ওঠে যে, অন্যের মুখে শুনলেও তার অন্তরে তার প্রতি ভর্ৎসনা জন্মায়।
৩. প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান হওয়া: অপারগতা বা স্পষ্ট কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে কাউকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ব্যাপারেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ মিথ্যারই নামান্তর। যে এই গুণ অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য ঔদার্য ও লজ্জাশীলতার দ্বার উন্মোচিত করেন এবং সত্যবাদীদের মাঝে তাকে ভালোবাসা দান করেন।
৪. কোনো সৃষ্টিকে অভিশাপ বা কষ্ট না দেওয়া: সৃষ্টি-জগতের কোনো কিছুকে অভিশাপ দেওয়া কিংবা ক্ষুদ্রতম অণুজীবকেও কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এটি পুণ্যবান ও সত্যনিষ্ঠদের চরিত্র। এর পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ দুনিয়ায় তাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন, পরকালে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং সৃষ্টি-জগতের অন্তরে তার জন্য কোমলতা ও দয়া সৃষ্টি করে দেন।
৫. অত্যাচারীর প্রতিও বিদ্বেষমুক্ত থাকা: কেউ জুলুম করলেও তার জন্য অভিশাপ প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। কথা বা কাজের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার মানসিকতা বর্জন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই কষ্ট সহ্য করলে তিনি ব্যক্তিকে দুনিয়া ও আখেরাতে অতি উচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং সকল সৃষ্টির হৃদয়ে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন।
৬. অন্যকে কাফির বা মুনাফিক হিসেবে অভিযুক্ত না করা: ‘আহলে কিবলা’ বা মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে শিরক, কুফর বা নেফাকের মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না। এই সংযম ব্যক্তিকে আল্লাহর রহমতের নিকটবর্তী করে এবং এটিই সুন্নাহর পরিপূর্ণ রূপ। এ ধরনের মানসিকতা আল্লাহর ক্রোধ থেকে মানুষকে দূরে রাখে এবং সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহমর্মিতার বোধ জাগ্রত করে।
৭. পাপের চিন্তা ও দৃষ্টি থেকে পবিত্র থাকা: প্রকাশ্যে ও গোপনে—যেকোনো পাপকর্মের দিকে তাকানো এবং সেই বিষয়ে মনে মনে চিন্তা করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সকল প্রকার পাপাচার থেকে কঠোরভাবে সংযত রাখতে হবে। পৃথিবীতে যেসব কাজের পুরস্কার দ্রুত মেলে, এটি তার মধ্যে অন্যতম; যা মানুষের অন্তর ও দেহকে পরিশুদ্ধ করে।
৮. সৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল হওয়া থেকে বিরত থাকা: নিজের ছোট-বড় কোনো প্রয়োজনের ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত; বরং নিজের প্রয়োজন ও স্বনির্ভরতার মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এটিই ইবাদতকারীর প্রকৃত সম্মান ও মুত্তাকীদের মর্যাদা। এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার নৈতিক শক্তি লাভ করে এবং আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস ও তাওয়াককুল (নির্ভরতা) বৃদ্ধি পায়।
৯. মানুষের সম্পদ বা সাফল্যের প্রতি নির্মোহ ও নির্লোভ থাকা: অন্য মানুষের হাতে যা আছে, তার প্রতি লোভ বা আকাক্সক্ষা পোষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। এটিই সর্বোচ্চ সম্মান, নিষ্কলুষ ঐশ্বর্য ও প্রকৃত স্বাধীনতা। এই গুণ আল্লাহর প্রতি নির্ভেজাল আস্থা ও নির্ভরশীলতা তৈরি করে; যা যুহুদ বা দুনিয়া-বিমুখতার অন্যতম ভিত্তি এবং এর মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি সত্যিকারের আল্লাহ-ভীরুতা অর্জন করতে পারে।
১০. বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা: বিনয় ইবাদতকারীর মর্যাদা উন্নত করে এবং তাকে আল্লাহ ও সৃষ্টির কাছে সম্মানিত করে। এটি সকল সৎকর্মের মূল। প্রকৃত বিনয় হল—যখনই কোনো মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তাকে নিজের চেয়ে কোনো না কোনো বিবেচনায় উত্তম মনে করা।
কনিষ্ঠ কাউকে দেখলে ভাববে, ‘সে আল্লাহর অবাধ্যতার সুযোগ পায়নি। কিন্তু আমি পেয়েছি। তাই সে আমার চেয়ে উত্তম।’
বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকে দেখলে ভাববে, ‘তিনি আমার বহু আগে থেকে আল্লাহর ইবাদত করেছেন।’
জ্ঞানী ব্যক্তিকে দেখলে ভাববে, ‘তিনি এমন জ্ঞান লাভ করেছেন, যা আমি করতে পারিনি।’
অজ্ঞ ব্যক্তিকে দেখলে বলবে, ‘সে না জেনে পাপ করেছে আর আমি জেনে-বুঝে পাপ করেছি। কার পরিসমাপ্তি কীভাবে হবে, তা তো আমি জানি না!’
অমুসলিমকে দেখলে বলবে, ‘হতে পারে, আল্লাহ তাকে হেদায়েত দান করবেন এবং তার শেষটা আমার চেয়ে উত্তম হবে।’
ওই গুণ ব্যক্তিকে অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতা থেকে রক্ষা করে এবং তার অন্তর ও জিহ্বাকে অন্যের সমালোচনা করা থেকে বিরত রাখে। বিনয় ছাড়া কোনো আমল বা ইবাদত পূর্ণতা লাভ করে না (আবদুল কাদির জিলানী, আল-গুনিয়াতু লি-তালিবি তারীকিল হাক, ২/৩১৪-৩১৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন)।
তাঁর ওই নির্দেশিকা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, বাইরের পৃথিবীর অস্থিরতা ও সংকট মূলত মানুষের ভেতরের শূন্যতা এবং নৈতিক বিচ্যুতিরই প্রতিফলন। হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) বর্ণিত ওই দশটি গুণ কেবল আধ্যাত্মিক সাধনার বিষয় নয়, বরং আধুনিক পৃথিবীর জটিল বাস্তবতায় ব্যক্তি ও সমাজকে পথ দেখানোর নৈতিক দর্শন। এর মূল শক্তি নিহিত রয়েছে এর সর্বজনীন আবেদনে। সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, বিনয়, পরনির্ভরশীলতা ত্যাগ কিংবা অন্যের প্রতি সহমর্মিতা- এই গুণগুলো কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, বরং এগুলো উন্নত মানবিক চরিত্রের মৌলিক ভিত্তি।
তাঁর ওই নির্দেশিকা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, বাইরের পৃথিবীর অস্থিরতা ও সংকট মূলত মানুষের ভেতরের শূন্যতা ও নৈতিক বিচ্যুতিরই প্রতিফলন। তাই এর সমাধান বাইরে থেকে আসবে না; এর উৎস ব্যক্তির আত্ম-সংশোধনের দীর্ঘ ও নিষ্ঠাপূর্ণ যাত্রার মধ্যেই নিহিত।
ওই দশটি নীতি সেই যাত্রার ব্যবহারিক ধাপ, যা একজন ব্যক্তিকে শুধু তার স্রষ্টার নিকটবর্তী করে না, বরং তাকে একজন নির্ভরযোগ্য, সহানুভূতিশীল এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে।
লেখক: আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

























