নিজস্ব প্রতিবেদক: গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিপেটা করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা এবং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও জনগণের অধিকার আদায়ের পক্ষে সাহসী ভূমিকা রাখা রাজনীতিবিদ নুরুল হকের ওপর নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা জানায়।
শনিবার (৩০ আগস্ট) অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে এই নিন্দা জানিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং বিকেলে গণমাধ্যমকে নিন্দা জানানোর বিষয়টি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, এই ধরনের সহিংসতা ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ঐতিহাসিক সংগ্রামে জাতিকে একত্র করা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্পিরিটের ওপরেও আঘাত বলে মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়, সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে তদন্তসম্পন্ন করা হবে। প্রভাব বা পদমর্যাদা যা-ই হোক না কেন, জড়িত কোনো ব্যক্তি জবাবদিহি থেকে রেহাই পাবে না। স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার সঙ্গে এর বিচার সম্পন্ন করা হবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নুরুল হক এবং তাঁর দলের অন্যান্য আহত সদস্যদের চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষায়িত মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তাঁদের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রয়োজনে তাঁদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে পাঠানো হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নুরুল হক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন, বিভিন্ন মত ও কণ্ঠকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। চব্বিশের জুলাইয়ে গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং হেফাজতে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল। নুরুল হকের ভূমিকা একটি স্বাধীন, সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য আমাদের জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় আহ্বান জানায়।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের ইচ্ছা জয়ী হবে, কোনো অশুভ শক্তিকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে দেওয়া হবে না।
জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। জাপার কার্যালয়ের সামনে দিয়ে গণ অধিকার পরিষদের একটি মিছিল যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
গণ অধিকার পরিষদ বলেছে, গতকাল সন্ধ্যায় মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় জাপার নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা চালান। তবে জাপা বলেছে, মিছিল নিয়ে এসে জাপার নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা।
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, জাপার হামলার প্রতিবাদে রাত সাড়ে ৯টার দিকে গণ অধিকার পরিষদের কার্যালয়ের সামনে সভাপতি নুরুল হক, তিনিসহ নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের ওপর হামলা চালান। এ সময় সভাপতি নুরুল হক, তিনিসহ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। নুরুল হক গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁকেসহ ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গত শুক্রবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্য আহত হন বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে: গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, কালকে যে ঘটনা ঘটলো- আপনারা জানেন, গণঅধিকার পরিষদের প্রেসিডেন্ট নুরুল হক নুরের ওপরে ন্যাক্কারজনক একটা হামলা হয়। উনি অসুস্থ। উনার চিকিৎসা হচ্ছে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের গণঅধিকার পরিষদের ছাত্র পরিষদের নেতা নাজমুল হাসানের উপরও হামলা হয়েছে, উনিও ক্রিটিক্যালি ইনজুরড হন এবং রাশেদ খান ইনজুরড হয়েছেন। তারা বলছেন তাদের ৫০ জনের মত ইনজুরড হয়েছেন। এই ঘটনার উপরে একটি জুডিসিয়াল তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একজন হাই কোর্টের জাস্টিসের নেতৃত্বে তদন্ত হবে। এটার টার্মস অব রেফারেন্স এবং এটার আরো কোন মেম্বার থাকবে কি না জানিয়ে দেওয়া হবে।
শনিবার (৩০ আগস্ট) বিকালে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান প্রেস সচিব। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শনিবার যমুনায় অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় জানিয়ে শফিকুল বলেন, বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
এদিন প্রধান উপদেষ্টা ফোন করে নুরের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আহত নুরুল হক নুরকে ফোন করেছিলেন। প্রথমে তার স্ত্রী ফোন রিসিভ করেন। প্রধান উপদেষ্টা নুর এবং তার সহকর্মীদের প্রতি সমবেদনা জানান, যারা এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। তিনি সবাইকে সর্বোত্তম চিকিৎসা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। নুরের জন্য ইতোমধ্যে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য আহতদেরও যেন দেশের সর্বোত্তম চিকিৎসা দেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নুরকে আরো জানিয়েছেন যে, এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। যদি প্রয়োজন হয়- তবে যেকোনো আহত ব্যক্তির উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হবে।
শুক্রবার রাতে কাকরাইলে নুরসহ তার দলের নেতাকর্মীরা যৌথবাহিনীর লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন। নুরসহ গণঅধিকার পরিষদের পাঁচজন বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গণ অধিকার পরিষদের দাবি, তাদের মিছিলের পেছন থেকে হামলা করেছে জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির পাল্টা অভিযোগ, তাদের প্রধান কার্যালয়ে হামলা হয়েছে ওই মিছিল থেকে। নুরের ওপর হামলার ঘটনায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ফেসবুকে পোস্টে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এতে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, এটা সরকারের দুর্বলতা নয়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন। তিনি নুরের সঙ্গে বছরের পর বছর রাস্তায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিন্দা জানাতেই পারেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সেই সময় নুরুল হক নুরও তার সহযোদ্ধা ছিলেন। শিক্ষার্থীদের যেকোনো আন্দোলনে আসিফ নজরুল সবসময় উপস্থিত ছিলেন। এ কারণেই ঘটনা শুনে তিনি নুরের চিকিৎসার খোঁজ নিতে ঢাকা মেডিকেলে গেছেন।
হামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত- গণ অধিকার পরিষদের এমন দাবির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রেস সচিব বলেন, তদন্ত কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। সাদা পোশাকের হামলাকারীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তদন্তাধীন। তবে আমি যা জানি, তিনি একজন পুলিশ কনস্টেবল এবং ডিউটিতে ছিলেন। বিস্তারিত জানতে পারবেন ডিএমপি থেকে।
এক সাংবাদিক বলেন, আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাচ্যুত সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কথা বলেছিল। এবারও প্রকাশ্য ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা না নিয়ে একইভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করছে সরকার। আদৌ কি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে? জবাবে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, তখনকার ঘটনা ছিল এক ধরনের নাটক। কিন্তু এখন আমাদের প্রতিটি কাজেই আন্তরিকতা রয়েছে। আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি কি না, সে বিষয়ে আপনারা প্রতিবেদন করতে পারেন।
কাকরাইলের ঘটনায় জাতীয় পার্টির কোনো ভূমিকা ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেস সচিব বলেন, তদন্ত কমিটি বিষয়টি যাচাই করবে। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, সে বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না? জবাবে শফিকুল বলেন, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, আজকের মিটিংয়ে নির্বাচনের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। জানানো হয়েছে যে, নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই-রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সানা/আপ্র/৩০/০৮/২০২৫