প্রত্যাশা ডেস্ক: হাঁটু আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্টগুলোর একটি; যা আমাদের হাঁটা-চলা, বসা-দাঁড়ানো প্রতিটি কাজে সাহায্য করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এবং আমাদের কিছু ভুল অভ্যাসের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্টের কার্যকারিতা কমে যেতে থাকে। এ অবস্থাকেই সহজ ভাষায় হাঁটুক্ষয় বা অস্টিওআর্থারাইটিস বলা হয়। এটি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়; যা এক সময় আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে।
হাঁটু ক্ষয়ের কারণ: হাঁটুর জয়েন্টে দু’টি হাড়ের সংযোগস্থলে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি নামক একটি নরম ও মসৃণ আবরণ থাকে, যা গদির মতো কাজ করে। এটি হাড়ে হাড়ে ঘর্ষণ প্রতিরোধ করে। বয়স বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ওজন, পুরনো আঘাত, বংশগত কারণ বা জীবনযাত্রার ভুলের কারণে এই তরুণাস্থি ক্ষয় হ’তে শুরু করে। ফলে হাড়ে ঘর্ষণ লাগে, ব্যথা হয়, জয়েন্ট ফুলে যায় এবং নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সচেতন জীবনযাপনের মাধ্যমে এই নীরব ঘাতককে প্রতিরোধ করা এবং এর তীব্রতাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এর জন্য আমাদের জানতে হবে কী করণীয়, কী বর্জনীয় এবং আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
প্রতিরোধে করণীয়-
নিয়মিত ব্যায়াম : হাঁটু ভালো রাখতে ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটার মতো ব্যায়াম করুন। এটি হাঁটুর চারপাশের পেশীকে শক্তিশালী করে এবং জয়েন্টকে সচল রাখে। যেমন-
ক. লেগ রেজ: মাটিতে সোজা হয়ে শুয়ে দুই হাতের তালু মেঝের ওপর রাখুন। এবার বাঁ-পা ধীরে ধীরে উপরে তুলুন। মাটি থেকে অন্তত ৪৫ ডিগ্রি কোণে পা রাখতে চেষ্টা করতে হবে। এ অবস্থায় পাঁচ সেকেন্ড পা তুলে রাখুন এবং ধীরে ধীরে নামিয়ে নিন। এই একই পদ্ধতিতে ডান পা অনুশীলন করতে হবে। শুরুর দিকে দুই পায়ে চারবার করে এই লেগ রেজ ব্যায়াম করতে পারেন। এরপর দশবার পর্যন্ত বাড়াতে পারেন লেগ রেজের সেট।
খ. লায়িং হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ: এই ব্যায়াম অনুশীলনেও প্রথমে মেঝেতে সোজা হয়ে শুয়ে বাঁ-পা উপরে তুলুন। তবে প্রথম ব্যায়ামের মতো ৪৫ ডিগ্রি পজিশনে নয়। এক্ষেত্রে মাটির সঙ্গে পা ৯০ ডিগ্রি কোণে থাকবে। দুই হাত বাঁ-ঊরুর নিচে রেখে ভারসাম্য বজায় রাখুন। এবার বাঁ-হাঁটু আস্তে আস্তে বুকের কাছে আনার চেষ্টা করুন। ৩০ সেকেন্ড অনুশীলন করে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে।
গ. হাফ স্কোয়াট: এই ব্যায়াম অনুশীলন করতে আপনাকে মেঝেতে শুয়ে নয়; বরং মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে করতে হবে। প্রথমে হাত দু’টি সামনের দিকে তুলুন। এবার বসার চেষ্টা করুন। তবে পুরোপুরি নয়। অর্ধেক বসার ভঙ্গি পর্যন্ত রেখেই উঠে পড়ুন। এভাবে অন্তত দশবার অনুশীলন করতে পারেন।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: শরীরের অতিরিক্ত ওযন সরাসরি হাঁটুর ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরের ওযন ১ কেজি কমালে হাঁটুর উপর চাপ প্রায় ৪ কেজি পর্যন্ত কমে যায়। তাই সুষম খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওযন নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক।
সঠিক দেহভঙ্গি: বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটার সময় সঠিক দেহভঙ্গি বজায় রাখুন। ঝুঁকে হাঁটা বা দীর্ঘ সময় ভুল ভঙ্গিতে বসে থাকলে হাঁটুর উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে।
আরামদায়ক জুতো ব্যবহার: নরম ও আরামদায়ক সোলযুক্ত জুতো ব্যবহার করুন। মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উঁচু হিলের জুতো পরা থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ এটি হাঁটুর ওপর অস্বাভাবিক চাপ তৈরি করে।
হাড় ক্ষয়ের জন্য দায়ী কিছু খাবার: চিকিৎসকরা হাড়ের জন্য ক্ষতিকর কিছু খাবার চিহ্নিত করেছেন; যেগুলো হাড়কে ধীরে ধীরে দুর্বল করে তোলে। তা হলো-
চিনি: শরীরে ধীরগতির বিষের মতো কাজ করে চিনি। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এমন খাবারের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে চিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে এটি দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়; যা হাড়কেও দুর্বল করে তোলে।
লবণ: চিনির মতো লবণও আপনার শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাধা দেয়। লবণ শুধু উচ্চ রক্তচাপই নয়, হাড় ক্ষয় রোগেরও বড় কারণ। হাড়ের ওপর প্রভাব ফেলা ছাড়াও লবণ শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণও কমিয়ে দেয়। তাই বেশী লবণ খাওয়ার অভ্যাস বন্ধ করার জন্য রান্নাও কম লবণ দিয়ে করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
কফি: কফিতে থাকা ক্যাফেইনই হাড় ক্ষয়ের কারণ হতে পারে তা অনেকেই জানেন না। কম বয়সে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি এড়াতে চাইলে বেশি কফি খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
কোমল পানীয়: ছোট-বড় সবারই কোমল পানীয় প্রিয়। এতে রয়েছে ফসফরিক অ্যাসিড; যা প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহের ক্যালসিয়াম শরীর থেকে বের করে দেয়।
অতিরিক্ত মাংস খাওয়া: অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে হাড় ক্ষয় হতে পারে। কারণ মাংস হচ্ছে প্রাণিজ প্রোটিন। অতিরিক্ত প্রোটিন শরীরে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি করে।
হাড় ক্ষয় প্রতিরোধী কিছু খাবার হলো-
বাদাম: বাদাম মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কার্যকরী এবং ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দূর করতেও বেশ কার্যকর। এতে স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং ফাইবারসহ প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে।
কমলালেবু: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কমলালেবু শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দূর করতে পারে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্যালসিয়াম প্রদানেও সহায়ক।
ব্রকলি: ব্রকলি ফাইবারের বড় উৎস হওয়া ছাড়াও ক্যালসিয়ামে পরিপূর্ণ; যা হাড়ের স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পালং শাক: এটি আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে এটিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে।
চিয়া সিডস: এটি শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায় না, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইবারও সরবরাহ করে। তাই উল্লিখিত খাবারগুলি খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ হবে এবং হাড়ও শক্ত করবে ইনশাআল্লাহ।
আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ