ঢাকা ১০:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

নির্যাতনের কথা কাউকে বলেন না ৬৪ শতাংশ নারী

  • আপডেট সময় : ০৪:৪০:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু ডেস্ক: দেশে সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ, এ ধরনের সহিংসতা স্বাভাবিক মনে করার প্রবণতায় মূলত নারীর এ নীরবতা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশের সমন্বয়ে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪-এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এ জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়।

বাড়ছে সহিংসতা: জরিপ বলছে, প্রযুক্তির সহায়তায় নারী নির্যাতন বাড়ছে। নানা ডিভাইসের মাধ্যমে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত ছবি বা অযাচিত অন্তরঙ্গ মেসেজের মাধ্যমে বাড়ছে নারী নির্যাতন। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে। দরিদ্রতাসহ নানা কারণে সব সময় শহরের চেয়ে নারী নির্যাতনের হার বেশি থাকে গ্রামে। কিন্তু সেই চিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। আর্থিকভাবে সচ্ছলতা এলেও কমেনি নারী নির্যাতন।

বিবিএস ও ইউএনএফপিএর তথ্য অনুযায়ী নারী আয় করলেও সেই টাকায় কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের। গ্রামের সঙ্গে এক ধরনের পাল্লা দিয়ে শহরেও বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতনের হার। দেশে জাতীয়ভাবে জীবনে একবার হলেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দেশের ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। এই হার শহরে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও গ্রামে ৭৬ শতাংশ। ফিজিক্যাল, সেক্সুয়াল, ইমোশনাল, কন্ট্রোলিং বিহ্যাভিয়ার, ইকনোমিক ভায়োলেন্স মিলিয়ে দেশে ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বাংলাদেশের সমন্বয়ে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪ এর মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখারুল করিম। জরিপটি তৈরিতে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ২৭ হাজার ৪৭৬ নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সময়কাল ছিল ২১ দিন।

গ্রাম ও শহরে নারী নির্যাতনের হার সমানতালে থাকা প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক ইফতেখারুল করিম বলেন, ‘শহরায়নের ফলে গ্রাম ও শহরে নারী নির্যাতনের হার সমান। নারী নির্যাতনের ধরনও পাল্টেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নারী নির্যাতন বাড়ছে। নানা ডিভাইসের মাধ্যমে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত ছবি বা অযাচিত অন্তরঙ্গ মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে বাড়ছে নারী নির্যাতন। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে।’ আর্থিকভাবে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক সচ্ছল স্বামী নারীর প্রয়োজন অনুসারে হাত খরচ দেন না। স্ত্রী চাইলো পাঁচ হাজার, দেওয়া হলো এক হাজার। এছাড়া নারী আয় করলেও টাকা খরচের দায়িত্ব থাকে স্বামীর হাতে। ফলে আর্থিকভাবে নারীরা এক ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।’

ইফতেখারুল করিম বলেন, অনেক সচ্ছল স্বামী নারীর প্রয়োজন অনুসারে হাত খরচ দেন না। স্ত্রী চাইলো পাঁচ হাজার, দেওয়া হলো এক হাজার। এছাড়া নারী আয় করলেও টাকা খরচের দায়িত্ব থাকে স্বামীর হাতে। ফলে আর্থিকভাবে নারীরা এক ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী কিন্তু নীরব থাকেন। সমাজের ভয়ে, পরিবারের কথা চিন্তা করে বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে তারা কথা বলেন না।’

বরিশালে যৌন নির্যানের হার বেশি: জরিপে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি, ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বরিশালের পরেই যৌন নির্যাতন বেশি হয় চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া খুলনায় ২৯ দশমিক ৯, ঢাকায় ২৭ দশমিক ৮, রাজশাহীতে ২৭ দশমিক ২, ময়মনসিংহে ২৩ শতাংশ, রংপুরে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও সিলেটে যৌন নির্যাতনের হার ২৮ দশমিক ২ শতাংশ।
শহর ও গ্রামে পার্থক্য তেমন নেই: শহর ও গ্রামে যৌন নির্যাতনের হারে খুব বেশি পার্থক্য নেই। শহরে যৌন নির্যাতনের হার ৩১ দশমিক ১ এবং গ্রামে ২৮ শতাংশ। গত ১২ মাসেও যৌন নির্যাতন বেশি হয়েছে বরিশালে। এসময় জাতীয় পর্যায়ে দেশে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। সেখানে বরিশালে এর হার ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরেই চট্টগ্রামে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া ঢাকায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, খুলনায় ৯ দশমিক ১ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, রংপুরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিলেটে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১২ মাসে গ্রামে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং শহরে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

নারীরা মুখ বুজে সহ্য করেন নির্যাতন: জরিপ বলছে, মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন ৬৪ শতাংশ নারী। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা বলেন, ‘এটা নানা কারণে হতে পারে। পার্টনার ভায়োলেন্সে নির্যাতনের বিষয়ে না বলার জন্য সামাজিক বাস্তবতা আছে। স্বামী সংঘটিত নির্যাতন অনেক সময় নারী চেপে রাখে সামাজিক বাস্তবতার কারণে। বাংলাদেশে সিঙ্গেল নারী হিসেবে টিকে থাকা কিন্তু খুবই চ্যালেঞ্জিং। ফলে সংসার, সন্তান লালন-পালন করা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নারী অনেকাংশে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। সমাজে ডিভোর্সড নারীকে ভালো চোখে দেখা হয় না।’ আর্থিকভাবে ও ডিভাইসে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিভাইসের অ্যাকসেস সমাজে অনেক দিন হলো। নারীর হাতে মোবাইল ডিভাইস থাকলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে পুরুষের হাতে। নারী কীভাবে ব্যবহার করবে তা পুরুষ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটালি পুরুষ সব কিছু কন্ট্রোল করছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারী নানা ধরনের অনলাইন ব্যবসা করেন। ফলে পণ্যের প্রমোশনে নারী লাইভে আসেন। আপনারা এসব কমেন্ট পড়লে দেখবেন অনেক নারী সাইবার অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছেন।
ড. উম্মে বুশরা বলেন, বাংলাদেশে সিঙ্গেল নারী হিসেবে টিকে থাকা খুবই চ্যালেঞ্জিং। ফলে সংসার, সন্তান লালন-পালন করা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নারী অনেকাংশে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। সমাজে ডিভোর্সড নারীকে ভালো চোখে দেখা হয় না।’ নারীর প্রতি আর্থিকবৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারী যখন আয় করেন তখন খরচের সিদ্ধান্ত নেন পুরুষ সদস্যরা। এটা অনেক দিন ধরে হচ্ছে। নারীর আয় স্বামী নিয়ে নেয়। না দিলে স্বামী অনেক সময় মারধর করে। তবে পুরুষের মাসে আয় কত তা জানার জন্য স্ত্রী সাহসও করেন না। স্ত্রী ভাত-কাপড় পাচ্ছেন এটাই তাদের কাছে অনেক কিছু।’
নির্যাতনের শীর্ষে স্বামী: বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হন; যা একজন নারীর জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী অন্তত একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন; যেখানে গত ১২ মাসে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪১ শতাংশ নারী।
জরিপটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সহিংসতার ঝুঁকির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তারতম্য। যেমন- দুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারী এবং বিগত ১২ মাসের মধ্যে অদুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারীদের তুলনায় জীবনসঙ্গী বা স্বামীর দ্বারা বেশি মাত্রায় সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন।
জরিপে উঠে এসেছে- যদিও স্বামী বা জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে সহিংসতার বিস্তৃতি এখনো ৭০ শতাংশে অর্থাৎ উচ্চমাত্রায় রয়েছে, তবুও গত ১২ মাসে এ হার ৪১ শতাংশ; যেখানে ২০১৫ সালের হার ছিল ৭৩ শতাংশ এবং তখন ১২ মাসের হার ছিল ৫৫ শতাংশ। জরিপটিতে নন-পার্টনার সহিংসতার চেয়ে জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতা বিস্তারের মাত্রা বেশি হিসেবে উঠে এসেছে।
নন-সঙ্গীর মাধ্যমে নির্যাতন বেশি ঢাকায়: সঙ্গী নন (নন-পার্টনার) এমন ব্যক্তির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। শহরে এই হার ১৭ দশমিক ৩; যা গ্রামে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ শহরের নারী নন-পার্টনারের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ঢাকায় এই নির্যাতনের হার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রাম। সেখানে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ নারী নন-পার্টনারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন।
জরিপে বলা হয়, ‘নন-পার্টনার’ শব্দটি এমন যে কোনো ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা হয়; যাকে সেই দেশ বা প্রেক্ষাপটে ‘সঙ্গী’ বলতে যেভাবে বোঝায়, সে অনুযায়ী ‘সঙ্গী’ বলে মনে করা হয় না। তাই নন-পার্টনার বলতে মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পরিচিত ও অপরিচিতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নন-পার্টনারের মাধ্যমে নির্যাতনের হার কম রাজশাহী বিভাগে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া বরিশালে ১৫ দশমিক ৮, খুলনায় ১৫ দশমিক ৭, ময়মনসিংহে ১৫ দশমিক ৯, রংপুরে ১৪ দশমিক ৮ ও সিলেটে এর হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
নারী নির্যাতন কমাতে সবার আগে মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। নারী নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত সমন্বিত হওয়ার দরকার বলে মত দিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, ‘সবার আগে আমাদের মাইন্ডসেট করতে হবে। তবেই কমবে নারী নির্যাতন। নারী নির্যাতন রোধে আমার মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সমন্বিত রিপোর্ট নেই। এগুলো সমন্বিত হওয়া দরকার। আমি কেবিনেটেও এটা নিয়ে কথা বলেছি। নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারি না। পুলিশ এক রকম দিচ্ছে, হেলথ এক রকম দিচ্ছে। তাহলে আমরা কী করবো?’ সময়ের পরিক্রমায় নারী নির্যাতন কমে যাওয়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা মেয়েরাই চাই স্বামী সবকিছু কন্ট্রোল করুক। মা-বাবাও ছেলেদের ওপর নির্ভর করেন। আগে আমার মাইন্ডসেট আপ করতে হবে। নিউ জেনারেশনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্কুল কারিকুলামে এটা নিয়ে কিছু থাকা দরকার। আশা করি, সময়ের পরিক্রমায় আমরাও একদিন পরিবর্তিত হবো। একদিন এমন সমাজ পাবো যখন নারী নির্যাতন আর থাকবে না।’

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নির্যাতনের কথা কাউকে বলেন না ৬৪ শতাংশ নারী

আপডেট সময় : ০৪:৪০:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

নারী ও শিশু ডেস্ক: দেশে সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ, এ ধরনের সহিংসতা স্বাভাবিক মনে করার প্রবণতায় মূলত নারীর এ নীরবতা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশের সমন্বয়ে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪-এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এ জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়।

বাড়ছে সহিংসতা: জরিপ বলছে, প্রযুক্তির সহায়তায় নারী নির্যাতন বাড়ছে। নানা ডিভাইসের মাধ্যমে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত ছবি বা অযাচিত অন্তরঙ্গ মেসেজের মাধ্যমে বাড়ছে নারী নির্যাতন। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে। দরিদ্রতাসহ নানা কারণে সব সময় শহরের চেয়ে নারী নির্যাতনের হার বেশি থাকে গ্রামে। কিন্তু সেই চিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। আর্থিকভাবে সচ্ছলতা এলেও কমেনি নারী নির্যাতন।

বিবিএস ও ইউএনএফপিএর তথ্য অনুযায়ী নারী আয় করলেও সেই টাকায় কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের। গ্রামের সঙ্গে এক ধরনের পাল্লা দিয়ে শহরেও বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতনের হার। দেশে জাতীয়ভাবে জীবনে একবার হলেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দেশের ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। এই হার শহরে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও গ্রামে ৭৬ শতাংশ। ফিজিক্যাল, সেক্সুয়াল, ইমোশনাল, কন্ট্রোলিং বিহ্যাভিয়ার, ইকনোমিক ভায়োলেন্স মিলিয়ে দেশে ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বাংলাদেশের সমন্বয়ে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪ এর মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখারুল করিম। জরিপটি তৈরিতে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ২৭ হাজার ৪৭৬ নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সময়কাল ছিল ২১ দিন।

গ্রাম ও শহরে নারী নির্যাতনের হার সমানতালে থাকা প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক ইফতেখারুল করিম বলেন, ‘শহরায়নের ফলে গ্রাম ও শহরে নারী নির্যাতনের হার সমান। নারী নির্যাতনের ধরনও পাল্টেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নারী নির্যাতন বাড়ছে। নানা ডিভাইসের মাধ্যমে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত ছবি বা অযাচিত অন্তরঙ্গ মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে বাড়ছে নারী নির্যাতন। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে।’ আর্থিকভাবে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক সচ্ছল স্বামী নারীর প্রয়োজন অনুসারে হাত খরচ দেন না। স্ত্রী চাইলো পাঁচ হাজার, দেওয়া হলো এক হাজার। এছাড়া নারী আয় করলেও টাকা খরচের দায়িত্ব থাকে স্বামীর হাতে। ফলে আর্থিকভাবে নারীরা এক ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।’

ইফতেখারুল করিম বলেন, অনেক সচ্ছল স্বামী নারীর প্রয়োজন অনুসারে হাত খরচ দেন না। স্ত্রী চাইলো পাঁচ হাজার, দেওয়া হলো এক হাজার। এছাড়া নারী আয় করলেও টাকা খরচের দায়িত্ব থাকে স্বামীর হাতে। ফলে আর্থিকভাবে নারীরা এক ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী কিন্তু নীরব থাকেন। সমাজের ভয়ে, পরিবারের কথা চিন্তা করে বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে তারা কথা বলেন না।’

বরিশালে যৌন নির্যানের হার বেশি: জরিপে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি, ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বরিশালের পরেই যৌন নির্যাতন বেশি হয় চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া খুলনায় ২৯ দশমিক ৯, ঢাকায় ২৭ দশমিক ৮, রাজশাহীতে ২৭ দশমিক ২, ময়মনসিংহে ২৩ শতাংশ, রংপুরে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও সিলেটে যৌন নির্যাতনের হার ২৮ দশমিক ২ শতাংশ।
শহর ও গ্রামে পার্থক্য তেমন নেই: শহর ও গ্রামে যৌন নির্যাতনের হারে খুব বেশি পার্থক্য নেই। শহরে যৌন নির্যাতনের হার ৩১ দশমিক ১ এবং গ্রামে ২৮ শতাংশ। গত ১২ মাসেও যৌন নির্যাতন বেশি হয়েছে বরিশালে। এসময় জাতীয় পর্যায়ে দেশে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। সেখানে বরিশালে এর হার ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরেই চট্টগ্রামে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া ঢাকায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, খুলনায় ৯ দশমিক ১ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, রংপুরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিলেটে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১২ মাসে গ্রামে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং শহরে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

নারীরা মুখ বুজে সহ্য করেন নির্যাতন: জরিপ বলছে, মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন ৬৪ শতাংশ নারী। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা বলেন, ‘এটা নানা কারণে হতে পারে। পার্টনার ভায়োলেন্সে নির্যাতনের বিষয়ে না বলার জন্য সামাজিক বাস্তবতা আছে। স্বামী সংঘটিত নির্যাতন অনেক সময় নারী চেপে রাখে সামাজিক বাস্তবতার কারণে। বাংলাদেশে সিঙ্গেল নারী হিসেবে টিকে থাকা কিন্তু খুবই চ্যালেঞ্জিং। ফলে সংসার, সন্তান লালন-পালন করা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নারী অনেকাংশে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। সমাজে ডিভোর্সড নারীকে ভালো চোখে দেখা হয় না।’ আর্থিকভাবে ও ডিভাইসে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিভাইসের অ্যাকসেস সমাজে অনেক দিন হলো। নারীর হাতে মোবাইল ডিভাইস থাকলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে পুরুষের হাতে। নারী কীভাবে ব্যবহার করবে তা পুরুষ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটালি পুরুষ সব কিছু কন্ট্রোল করছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারী নানা ধরনের অনলাইন ব্যবসা করেন। ফলে পণ্যের প্রমোশনে নারী লাইভে আসেন। আপনারা এসব কমেন্ট পড়লে দেখবেন অনেক নারী সাইবার অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছেন।
ড. উম্মে বুশরা বলেন, বাংলাদেশে সিঙ্গেল নারী হিসেবে টিকে থাকা খুবই চ্যালেঞ্জিং। ফলে সংসার, সন্তান লালন-পালন করা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নারী অনেকাংশে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। সমাজে ডিভোর্সড নারীকে ভালো চোখে দেখা হয় না।’ নারীর প্রতি আর্থিকবৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারী যখন আয় করেন তখন খরচের সিদ্ধান্ত নেন পুরুষ সদস্যরা। এটা অনেক দিন ধরে হচ্ছে। নারীর আয় স্বামী নিয়ে নেয়। না দিলে স্বামী অনেক সময় মারধর করে। তবে পুরুষের মাসে আয় কত তা জানার জন্য স্ত্রী সাহসও করেন না। স্ত্রী ভাত-কাপড় পাচ্ছেন এটাই তাদের কাছে অনেক কিছু।’
নির্যাতনের শীর্ষে স্বামী: বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হন; যা একজন নারীর জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী অন্তত একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন; যেখানে গত ১২ মাসে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪১ শতাংশ নারী।
জরিপটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সহিংসতার ঝুঁকির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তারতম্য। যেমন- দুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারী এবং বিগত ১২ মাসের মধ্যে অদুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারীদের তুলনায় জীবনসঙ্গী বা স্বামীর দ্বারা বেশি মাত্রায় সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন।
জরিপে উঠে এসেছে- যদিও স্বামী বা জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে সহিংসতার বিস্তৃতি এখনো ৭০ শতাংশে অর্থাৎ উচ্চমাত্রায় রয়েছে, তবুও গত ১২ মাসে এ হার ৪১ শতাংশ; যেখানে ২০১৫ সালের হার ছিল ৭৩ শতাংশ এবং তখন ১২ মাসের হার ছিল ৫৫ শতাংশ। জরিপটিতে নন-পার্টনার সহিংসতার চেয়ে জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতা বিস্তারের মাত্রা বেশি হিসেবে উঠে এসেছে।
নন-সঙ্গীর মাধ্যমে নির্যাতন বেশি ঢাকায়: সঙ্গী নন (নন-পার্টনার) এমন ব্যক্তির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। শহরে এই হার ১৭ দশমিক ৩; যা গ্রামে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ শহরের নারী নন-পার্টনারের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ঢাকায় এই নির্যাতনের হার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রাম। সেখানে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ নারী নন-পার্টনারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন।
জরিপে বলা হয়, ‘নন-পার্টনার’ শব্দটি এমন যে কোনো ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা হয়; যাকে সেই দেশ বা প্রেক্ষাপটে ‘সঙ্গী’ বলতে যেভাবে বোঝায়, সে অনুযায়ী ‘সঙ্গী’ বলে মনে করা হয় না। তাই নন-পার্টনার বলতে মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পরিচিত ও অপরিচিতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নন-পার্টনারের মাধ্যমে নির্যাতনের হার কম রাজশাহী বিভাগে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া বরিশালে ১৫ দশমিক ৮, খুলনায় ১৫ দশমিক ৭, ময়মনসিংহে ১৫ দশমিক ৯, রংপুরে ১৪ দশমিক ৮ ও সিলেটে এর হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
নারী নির্যাতন কমাতে সবার আগে মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। নারী নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত সমন্বিত হওয়ার দরকার বলে মত দিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, ‘সবার আগে আমাদের মাইন্ডসেট করতে হবে। তবেই কমবে নারী নির্যাতন। নারী নির্যাতন রোধে আমার মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সমন্বিত রিপোর্ট নেই। এগুলো সমন্বিত হওয়া দরকার। আমি কেবিনেটেও এটা নিয়ে কথা বলেছি। নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারি না। পুলিশ এক রকম দিচ্ছে, হেলথ এক রকম দিচ্ছে। তাহলে আমরা কী করবো?’ সময়ের পরিক্রমায় নারী নির্যাতন কমে যাওয়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা মেয়েরাই চাই স্বামী সবকিছু কন্ট্রোল করুক। মা-বাবাও ছেলেদের ওপর নির্ভর করেন। আগে আমার মাইন্ডসেট আপ করতে হবে। নিউ জেনারেশনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্কুল কারিকুলামে এটা নিয়ে কিছু থাকা দরকার। আশা করি, সময়ের পরিক্রমায় আমরাও একদিন পরিবর্তিত হবো। একদিন এমন সমাজ পাবো যখন নারী নির্যাতন আর থাকবে না।’