ঢাকা ০৩:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নির্ভেজালপন্থিদের অধিকার কারা নিশ্চিত করবে?

  • আপডেট সময় : ০৫:১৬:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৯ বার পড়া হয়েছে

মাহবুব হাসান জ্যোতি : বছর তিনেক আগের কথা। রাজনৈতিক বিভিন্ন সেমিনারে গুরুগম্ভীর আলোচনায় তখন আফসোস নিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠরা একটা বিষয়ে আলোকপাত করতেন; কেন শিক্ষিত তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে দিনে দিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে!

অনেক আলোচক এমনও বলতেন– এ জামানার তরুণরা নাকি রাজনীতিবিমুখ। অগ্রজ কিংবা রাজনৈতিক পট তৈরির কারিগররা বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত ছিলেন যে এটা অন্তত এ ধরনের বক্তব্য থেকে বোঝা যেত। আর জাতিকে শিক্ষিত রাজনীতিবিদ উপহার দেওয়ার অভিপ্রায়ে কম গবেষণাও হয়নি।

কেন তরুণ সমাজ রাজনীতিতে অনাগ্রহী, এর খুঁটিনাটি দিক নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জরিপ পর্যন্ত হয়েছিল নিকট অতীতে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর এবং পরবর্তী নানা ইস্যু ঘিরে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকায় রাজনৈতিক মোড়লদের সেই আফসোসখানি আর মগজে অবশিষ্ট আছে কিনা জানা নেই। হয়তো অনেকেই বিষ খেয়ে বিষ হজম করছেন এখন।

পূর্ববর্তী বছরগুলোয় দেশের মোড়ল যারা ছিলেন, উনারা বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরেই দেশের মোট জনসমষ্টির সংখ্যাটি উল্লেখ করে নানা অজুহাত উপস্থাপন করতেন। যখন যে উদ্যোগ নিতেন বা ইস্যু তৈরি হতো, তখন দেশের মোট জনসংখ্যার কথা উল্লেখ করে দম্ভকণ্ঠে জানাতেন, ‘দেশের দশ কোটি মানুষ এটি চায়।

’ অথবা বলতেন ‘দেশের বারো কোটি মানুষ এটা চেয়েছিল বলেই আমরা এটি করতে বাধ্য হচ্ছি।’ তারা তৎকালীন সমাজ বা রাষ্ট্র নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন! আর কোন ফাঁকে ‘বৈষম্যটা’ গেঁড়ে বসলো- যেন কেউই বুঝতেই পারলেন না! রাজনৈতিক নেতারা তো ‘পীর’র চেয়েও কোনো অংশে কম নন। কারণ নেতাদের মতাদর্শের বিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকেই যার যার নেতার কবরকে মাজার বলেন। ওনাদের এই দোসর বা মুরিদদের বিশ্বাসও এমন; আমজনতার উন্নয়নের জন্যই তাদের পীর বা মোড়ল বা নেতা জীবনটাকে উৎসর্গ করে গেছেন।

যার যার মোড়ল তার তার কাছে সর্বেসর্বা অথবা ফেরেশতা।
কেউই মোড়লদের শিকড় বা পূর্ব পুরুষদের সম্পদ নিয়ে গবেষণায় যেতে রাজি ছিলেন না। মিলিয়ে দেখেননি যুগ অন্তে মসনদের বলে তারা কেমন ধনে সম্পদে আর শক্তিতে বলীয়ান হয়েছিলেন। ভেজালযুক্ত রাজনৈতিক ঘটনার পরিক্রমায় পালা বদলে বিভিন্নকালে মোড়ল কাতারে আরও অনেকে যুক্ত হওয়া শুরু করলো।

যারা যুক্ত হতে থাকলেন তারা পূর্ববর্তীদের মুখোশও উন্মোচন করলেন। যারা উন্মোচনের এই ‘মহতি’ উদ্যোগে যুক্ত হন, আবার সেই পক্ষকেও কেউ না কেউ যুক্তিযুক্ত কারণ দাঁড় করিয়ে পেছন হতে ‘ল্যাং মারা’ শুরু করে। এভাবেই তো চলছে দেশ। সে হিসেবে রাজনীতি হলো একটি ভেজাল ময়দান। আবার সেখানে জটিল সমীকরণে সমঝোতা হতেও দেখেছি বিগত বছরগুলোতে। বয়স কিংবা জেনারেশন গ্যাপ সমঝোতার ক্ষেত্রে কোনো ফ্যাক্টর হয়নি।

আশ্চর্য লাগে যারা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে মোড়ল হচ্ছেন, তারা কেউ-ই লিপ্সা বা লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না। আবার কালের আবর্তে প্রতিষ্ঠিত কথিত কোনো রথী মহারথীও সম্পদ গড়ার আকাঙ্ক্ষা হতে বেরিয়ে এসে নজির স্থাপন করতে পারছেন না।

এমনকি বিগত দিনেও কেউ প্রমাণসমেত জাতিকে দেখাতে পারেননি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি বা তারা যে আখের গোছাননি। পক্ষ-বিপক্ষের উত্থানের আলোকে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি কিংবা ইতিহাস ঘাঁটলে এও বোঝা যায়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতেই এ দেশে যারা নেতা হয়েছেন, উনারা চমৎকার কথামালা খুঁজে খুঁজে বের করেছেন কেবল সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য।
আড়ালে নিজেরা কেবল নগদ গ্রহণ বা কামাইয়ে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্পদ গড়ার লোভের যে প্রতিযোগিতা বা পদ্ধতি এ তো বহু আগ হতেই শুরু হয়েছিল, সেখানে সবাই যে যার যুক্তি অখণ্ড রেখেই শামিল ছিলেন। সব কালেই পুরোনোদের কাছে তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কথাবার্তা ছিল অডিটরিয়াম কিংবা গোলটেবিল জমানোর মতো টপিকের কিঞ্চিৎ প্রয়াস মাত্র!
রাষ্ট্রের মামুলি নাগরিকদের প্রশ্ন বা ভাবনা নিয়ে মোড়লদের তেমন কিছু আসে যায় না। তারপরও জানতে ইচ্ছে করে, ‘সংঘবদ্ধ’ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে কেন কাউকে কিছু প্রদান করা হয় না?

কী সেলাই কারিগর, কী দোকানি, কিংবা রিকশা শ্রমিক অথবা চিকিৎসক, শিক্ষক কিংবা স্যুট-টাই পরা আমলÑ এখন এমন কোনো পর্যায় বা সেক্টর নাই- যেখানে ‘সংঘবদ্ধভাবে আদায়’ করে নেওয়ার প্রচলনটা নেই। আর চক্র, চক্রান্তের জালও কিছু না কিছু বিস্তৃত হয় এভাবেই। ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার, সমতা, সুশাসন এগুলো কেবলই যে ফাঁকা বুলি- তা তো অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। ফেরেশতার মতো মোড়ল যারা ছিলেন তারাও পরিকল্পিত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি।

আবার অনাগত ভেজাল পরিস্থিতিতে যারা ফেরেশতা সাজার চেষ্টা করবেন, তারা কেন ভাবনায় আনছেন না; এই যে আদায় করার ‘সংঘবদ্ধ পদ্ধতি’ এখন চালু হয়ে গেলো দেশে– প্রচলিত এই ‘পদ্ধতিতে’ সবাই কি শামিল হতে পারেন বা পারবেন? আবার সবাই কি সব পদ্ধতিতে সায় দেয়? রাষ্ট্রের মামুলি অনেক নাগরিকের কাছ থেকে জবাব পাওয়া যাবে ‘না’।
যারা ‘না’-এর দলে অর্থাৎ চুপচাপ বা রাজনৈতিক মারপ্যাচে যারা

‘নির্ভেজালপন্থি’, যারা আদায় করে নেওয়ার কায়দাকানুন জানে না কিংবা সেখানে যুক্ত হয় না, তারা কি শুধুই অবহেলিতই থাকবে? এসবের উত্তর বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন বা ক্ষমতাধরদের কাছাকাছি যিনি থাকেন, তারা কি খুঁজে দেখার তাগিদ অনুভব করবেন? নির্ভেজালদের যাপিত জীবন কি সহজ হবে না? একটা বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে আরেকটি বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে যাচ্ছে কিনা–সেদিকে কারো দৃষ্টি আছে কিনা- সন্দেহ হয়।

কারণ দেখা যাচ্ছে পূর্ববর্তী মোড়লেরা যাদের খুশি করার সব সময় ব্রতী ছিলেন, সেই তাদের মতোই একই তরিকায় বর্তমানে যারা দেশের হর্তাকর্তা হয়েছেন ওনারাও সবার আগে সরকারি চাকরির সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরই খুশি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন!
হয়তো ওনাদের কাজকর্মে সম্পৃক্ত বলেই এই প্রাধান্য দিচ্ছেন বা শক্তিসঞ্চার করার অভিলাষেই বিভিন্ন সেক্টরে যারা সংঘবদ্ধ হয়েছেন তাদের দাবি-দাওয়াও পূরণ করে চলেছেন।

রাজা ভেগে যায় কিন্তু তার তন্ত্র ঠিকই থেকে যায়। সে জন্যই কিনা জানি না, আমরা একজনের অধিকার কেড়ে নিয়ে আরেকজনের অধিকার দেওয়াটাই শিখছি বা শিখেছি।

আর যারা নেই কোনো সংঘবদ্ধে, তারা কেবল বঞ্চিতই থেকে যায়। সংগঠন, মিছিল-সমাবেশ, রাস্তা অবরোধ, পিকেটিং, পট তৈরির কারিগর– এসব ভেজাল প্রক্রিয়া যারা এড়িয়ে চলেন, তারা কি এই দেশের নাগরিক নন? চুপচাপ বা নির্ভেজালপন্থিরা কি দেশের কোনো অংশে কম মঙ্গল কামনা করেন? সংঘবদ্ধ হয়ে অথবা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্র সৃষ্টি না করতে পারলে কি এই দেশে কিছুই আদায় করা যাবে না?
আরও বিস্মিত ব্যাপার হলো সব কিছু বদলে ফেলার চেষ্টা চলছে ঠিকই, তবে সংলাপ এখনও পুরোনোটি আছে।

যে কোনো ইস্যুতে কথায় কথায় এখনও অনেকে বলেই ফেলেন; ‘আমরা যা করছি এটি ১৮ কোটি মানুষ চায়!’ খুব সহজে জনসমষ্টির এই যে সংখ্যাটা পূর্ববর্তী মোড়লদের মতোই আওয়াজে রাখা বা বেচে ফেলছেনÑ এও বড় আশ্চর্য! আর উদ্ভট যত প্রকট যুক্তি যার চিন্তায় যা আছে, তার ভিত্তিতেই নগদ গ্রহণে উঠেপড়ে লেগেছেনÑ এমন সংবাদও তো প্রকাশ হচ্ছে।
জীবনভর আমাদের শুনতেই হচ্ছে ক্ষমতার পালাবদলে একপক্ষ পুরো জাতির জন্য গোলা ভরে যান।

আর পরে যারা ক্ষমতায় আসেন তারা এসে জানান ফাঁকা গোলা, কিছুই নেই! সবই যে গালগল্প তাও তো অনেকে এখন বোঝেন। নির্ভেজাল যারা তারাও চিন্তায় নিচ্ছেন, রাজনীতির অন্তরালে কেমন ধরনের মধুর চাক আমাদের মতো ছোট্ট এই দেশের ফাঁকা গোলায় জানি রয়েছে!

এখানে শুধু সাহস করে হাত বাড়ালেই মৌমাছি বা ভিমরুলের আনাগোনা থেকেও মধু খাওয়া যায়।
এ দেশে মোড়ল বা কাপ্তান না হতে পারলে কেউ কাউকে পাত্তা দিতে চায় না। বাড়তি বা প্রচুর অর্থ কামাইয়ের পদ্ধতি না শেখা থাকলে কিংবা মোড়ল বা কাপ্তান না হতে পারলে ‘ব্যর্থ নাগরিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিজ পরিবারেও ঠিকমতো সমাদর পাওয়া যায় না।

বছরের পর বছর এভাবেই তো পার হয়। মানুষে মানুষে বিভেদ এভাবেই বেড়ে চলেছে। একগোষ্ঠী সবসময় সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করতে করতে তরুণ হতে বুড়ো হয়ে যায়। মূল্যস্ফীতি আর নানা ধরনের বৈষম্যের জাঁতাকলে না পড়লে ফুরফুরে জীবন তো হবেই। আনন্দের ঠেলায় কিছু মানুষের আয়েশি আলাপও উতরে আসে তখন।

রাষ্ট্র, সরকার সবই যদি থাকে নাগালে, তাহলে তো ‘এজেন্ডানির্ভর’ সভা-সেমিনারে কিছু বলার জন্যও দাওয়াত মেলে।

হয়তো এখন যারা সুবিধাভোগী অথবা মোড়ল কাতারে আছেন যারা, তারা একসময় অদূর ভবিষ্যতের কোনো সভা সেমিনারে গুরুগম্ভীর আলোচনা পর্বে অংশ নিয়ে বলবেন; ‘আমরা দিব্বি দেখতে পাচ্ছি তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে দিনে দিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে!

আমরা এর থেকে উত্তরণ খুঁজছি।’ ঠিক সেই সময়ই হয়তো আরেকটি জেনারেশন উদ্ভব হতে পারে। তখন পরিণতি বা দৃশ্যপট কেমন হবে- তা কিন্তু কল্পনা করতে পারছি না।

পরিণতি আরও অপমানজনকও হতে পারে। কারণ অতীতের পটপরিবর্তনের মুহূর্তগুলো স্মরণ রাখলেও কেউই ভয়ে রাখেন না!
যুগের পর যুগ থেকে চলা ভেজালযুক্ত বৈষম্যমূলক অর্থ ব্যবস্থা, সমাজ বা অনিরাপদ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নতুন পন্থায় কেউ এগিয়ে নেবার জন্য চায় কিনা সন্দেহ।

দেশ পরিচালনাকারীরা বঞ্চনার যে বীজ বপন বা চারা গাছ লাগিয়ে রাখেন, এটি বেমালুম অনিচ্ছাকৃত নয়, নেপথ্যে রয়েছে গুপ্ত অভিলাষ। কেউ স্বীকারও করেন না। হয়তো ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিমুখ হওয়া নিয়ে গবেষণা সেল গঠন করবেন সেই তারাই!

সামনে জরিপ কার্য চালাতেও উদ্বুদ্ধ হবে তাদের মদতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান।
এখনো সময় আছে কেবল নিজেদের পারিপার্শ্বিক মুখগুলো নিয়ে ব্যস্ত হলেই চলবে না, যারা কোনো ভেজালে নেইÑ তাদের জন্যও ফলপ্রসূ কিছু বাস্তবায়ন করুন। এই মানুষগুলোও দেশের ১৮ কোটিরই একটা অংশ।

জীবন-জীবিকার জন্য নির্ভেজাল মানুষেরাও কোনো না কোনো পেশায় সম্পৃক্ত। ক্ষমতাধররা নিজেদের নির্ভেজালপন্থিদের সামনে পর্তুগিজ কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক অথবা হাল আমলের চা বাগানের মালিক আর নির্ভেজালদের চা শ্রমিক হিসেবে ভাববেন না।

নির্ভেজালপন্থিদেরও টিকে থাকতে দরকার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অধিকার, তাদেরও প্রয়োজন কিছতা ইজ্জত-সম্মান। কারও গঞ্জনায় প্রকৃতিকে আর ভারী হতে দেবেন না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সধযনঁনলড়ঃর@ুধযড়ড়.পড়স

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নির্ভেজালপন্থিদের অধিকার কারা নিশ্চিত করবে?

আপডেট সময় : ০৫:১৬:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫

মাহবুব হাসান জ্যোতি : বছর তিনেক আগের কথা। রাজনৈতিক বিভিন্ন সেমিনারে গুরুগম্ভীর আলোচনায় তখন আফসোস নিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠরা একটা বিষয়ে আলোকপাত করতেন; কেন শিক্ষিত তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে দিনে দিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে!

অনেক আলোচক এমনও বলতেন– এ জামানার তরুণরা নাকি রাজনীতিবিমুখ। অগ্রজ কিংবা রাজনৈতিক পট তৈরির কারিগররা বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত ছিলেন যে এটা অন্তত এ ধরনের বক্তব্য থেকে বোঝা যেত। আর জাতিকে শিক্ষিত রাজনীতিবিদ উপহার দেওয়ার অভিপ্রায়ে কম গবেষণাও হয়নি।

কেন তরুণ সমাজ রাজনীতিতে অনাগ্রহী, এর খুঁটিনাটি দিক নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জরিপ পর্যন্ত হয়েছিল নিকট অতীতে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর এবং পরবর্তী নানা ইস্যু ঘিরে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকায় রাজনৈতিক মোড়লদের সেই আফসোসখানি আর মগজে অবশিষ্ট আছে কিনা জানা নেই। হয়তো অনেকেই বিষ খেয়ে বিষ হজম করছেন এখন।

পূর্ববর্তী বছরগুলোয় দেশের মোড়ল যারা ছিলেন, উনারা বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরেই দেশের মোট জনসমষ্টির সংখ্যাটি উল্লেখ করে নানা অজুহাত উপস্থাপন করতেন। যখন যে উদ্যোগ নিতেন বা ইস্যু তৈরি হতো, তখন দেশের মোট জনসংখ্যার কথা উল্লেখ করে দম্ভকণ্ঠে জানাতেন, ‘দেশের দশ কোটি মানুষ এটি চায়।

’ অথবা বলতেন ‘দেশের বারো কোটি মানুষ এটা চেয়েছিল বলেই আমরা এটি করতে বাধ্য হচ্ছি।’ তারা তৎকালীন সমাজ বা রাষ্ট্র নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন! আর কোন ফাঁকে ‘বৈষম্যটা’ গেঁড়ে বসলো- যেন কেউই বুঝতেই পারলেন না! রাজনৈতিক নেতারা তো ‘পীর’র চেয়েও কোনো অংশে কম নন। কারণ নেতাদের মতাদর্শের বিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকেই যার যার নেতার কবরকে মাজার বলেন। ওনাদের এই দোসর বা মুরিদদের বিশ্বাসও এমন; আমজনতার উন্নয়নের জন্যই তাদের পীর বা মোড়ল বা নেতা জীবনটাকে উৎসর্গ করে গেছেন।

যার যার মোড়ল তার তার কাছে সর্বেসর্বা অথবা ফেরেশতা।
কেউই মোড়লদের শিকড় বা পূর্ব পুরুষদের সম্পদ নিয়ে গবেষণায় যেতে রাজি ছিলেন না। মিলিয়ে দেখেননি যুগ অন্তে মসনদের বলে তারা কেমন ধনে সম্পদে আর শক্তিতে বলীয়ান হয়েছিলেন। ভেজালযুক্ত রাজনৈতিক ঘটনার পরিক্রমায় পালা বদলে বিভিন্নকালে মোড়ল কাতারে আরও অনেকে যুক্ত হওয়া শুরু করলো।

যারা যুক্ত হতে থাকলেন তারা পূর্ববর্তীদের মুখোশও উন্মোচন করলেন। যারা উন্মোচনের এই ‘মহতি’ উদ্যোগে যুক্ত হন, আবার সেই পক্ষকেও কেউ না কেউ যুক্তিযুক্ত কারণ দাঁড় করিয়ে পেছন হতে ‘ল্যাং মারা’ শুরু করে। এভাবেই তো চলছে দেশ। সে হিসেবে রাজনীতি হলো একটি ভেজাল ময়দান। আবার সেখানে জটিল সমীকরণে সমঝোতা হতেও দেখেছি বিগত বছরগুলোতে। বয়স কিংবা জেনারেশন গ্যাপ সমঝোতার ক্ষেত্রে কোনো ফ্যাক্টর হয়নি।

আশ্চর্য লাগে যারা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে মোড়ল হচ্ছেন, তারা কেউ-ই লিপ্সা বা লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না। আবার কালের আবর্তে প্রতিষ্ঠিত কথিত কোনো রথী মহারথীও সম্পদ গড়ার আকাঙ্ক্ষা হতে বেরিয়ে এসে নজির স্থাপন করতে পারছেন না।

এমনকি বিগত দিনেও কেউ প্রমাণসমেত জাতিকে দেখাতে পারেননি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি বা তারা যে আখের গোছাননি। পক্ষ-বিপক্ষের উত্থানের আলোকে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি কিংবা ইতিহাস ঘাঁটলে এও বোঝা যায়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতেই এ দেশে যারা নেতা হয়েছেন, উনারা চমৎকার কথামালা খুঁজে খুঁজে বের করেছেন কেবল সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য।
আড়ালে নিজেরা কেবল নগদ গ্রহণ বা কামাইয়ে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্পদ গড়ার লোভের যে প্রতিযোগিতা বা পদ্ধতি এ তো বহু আগ হতেই শুরু হয়েছিল, সেখানে সবাই যে যার যুক্তি অখণ্ড রেখেই শামিল ছিলেন। সব কালেই পুরোনোদের কাছে তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কথাবার্তা ছিল অডিটরিয়াম কিংবা গোলটেবিল জমানোর মতো টপিকের কিঞ্চিৎ প্রয়াস মাত্র!
রাষ্ট্রের মামুলি নাগরিকদের প্রশ্ন বা ভাবনা নিয়ে মোড়লদের তেমন কিছু আসে যায় না। তারপরও জানতে ইচ্ছে করে, ‘সংঘবদ্ধ’ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে কেন কাউকে কিছু প্রদান করা হয় না?

কী সেলাই কারিগর, কী দোকানি, কিংবা রিকশা শ্রমিক অথবা চিকিৎসক, শিক্ষক কিংবা স্যুট-টাই পরা আমলÑ এখন এমন কোনো পর্যায় বা সেক্টর নাই- যেখানে ‘সংঘবদ্ধভাবে আদায়’ করে নেওয়ার প্রচলনটা নেই। আর চক্র, চক্রান্তের জালও কিছু না কিছু বিস্তৃত হয় এভাবেই। ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার, সমতা, সুশাসন এগুলো কেবলই যে ফাঁকা বুলি- তা তো অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। ফেরেশতার মতো মোড়ল যারা ছিলেন তারাও পরিকল্পিত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি।

আবার অনাগত ভেজাল পরিস্থিতিতে যারা ফেরেশতা সাজার চেষ্টা করবেন, তারা কেন ভাবনায় আনছেন না; এই যে আদায় করার ‘সংঘবদ্ধ পদ্ধতি’ এখন চালু হয়ে গেলো দেশে– প্রচলিত এই ‘পদ্ধতিতে’ সবাই কি শামিল হতে পারেন বা পারবেন? আবার সবাই কি সব পদ্ধতিতে সায় দেয়? রাষ্ট্রের মামুলি অনেক নাগরিকের কাছ থেকে জবাব পাওয়া যাবে ‘না’।
যারা ‘না’-এর দলে অর্থাৎ চুপচাপ বা রাজনৈতিক মারপ্যাচে যারা

‘নির্ভেজালপন্থি’, যারা আদায় করে নেওয়ার কায়দাকানুন জানে না কিংবা সেখানে যুক্ত হয় না, তারা কি শুধুই অবহেলিতই থাকবে? এসবের উত্তর বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন বা ক্ষমতাধরদের কাছাকাছি যিনি থাকেন, তারা কি খুঁজে দেখার তাগিদ অনুভব করবেন? নির্ভেজালদের যাপিত জীবন কি সহজ হবে না? একটা বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে আরেকটি বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে যাচ্ছে কিনা–সেদিকে কারো দৃষ্টি আছে কিনা- সন্দেহ হয়।

কারণ দেখা যাচ্ছে পূর্ববর্তী মোড়লেরা যাদের খুশি করার সব সময় ব্রতী ছিলেন, সেই তাদের মতোই একই তরিকায় বর্তমানে যারা দেশের হর্তাকর্তা হয়েছেন ওনারাও সবার আগে সরকারি চাকরির সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরই খুশি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন!
হয়তো ওনাদের কাজকর্মে সম্পৃক্ত বলেই এই প্রাধান্য দিচ্ছেন বা শক্তিসঞ্চার করার অভিলাষেই বিভিন্ন সেক্টরে যারা সংঘবদ্ধ হয়েছেন তাদের দাবি-দাওয়াও পূরণ করে চলেছেন।

রাজা ভেগে যায় কিন্তু তার তন্ত্র ঠিকই থেকে যায়। সে জন্যই কিনা জানি না, আমরা একজনের অধিকার কেড়ে নিয়ে আরেকজনের অধিকার দেওয়াটাই শিখছি বা শিখেছি।

আর যারা নেই কোনো সংঘবদ্ধে, তারা কেবল বঞ্চিতই থেকে যায়। সংগঠন, মিছিল-সমাবেশ, রাস্তা অবরোধ, পিকেটিং, পট তৈরির কারিগর– এসব ভেজাল প্রক্রিয়া যারা এড়িয়ে চলেন, তারা কি এই দেশের নাগরিক নন? চুপচাপ বা নির্ভেজালপন্থিরা কি দেশের কোনো অংশে কম মঙ্গল কামনা করেন? সংঘবদ্ধ হয়ে অথবা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্র সৃষ্টি না করতে পারলে কি এই দেশে কিছুই আদায় করা যাবে না?
আরও বিস্মিত ব্যাপার হলো সব কিছু বদলে ফেলার চেষ্টা চলছে ঠিকই, তবে সংলাপ এখনও পুরোনোটি আছে।

যে কোনো ইস্যুতে কথায় কথায় এখনও অনেকে বলেই ফেলেন; ‘আমরা যা করছি এটি ১৮ কোটি মানুষ চায়!’ খুব সহজে জনসমষ্টির এই যে সংখ্যাটা পূর্ববর্তী মোড়লদের মতোই আওয়াজে রাখা বা বেচে ফেলছেনÑ এও বড় আশ্চর্য! আর উদ্ভট যত প্রকট যুক্তি যার চিন্তায় যা আছে, তার ভিত্তিতেই নগদ গ্রহণে উঠেপড়ে লেগেছেনÑ এমন সংবাদও তো প্রকাশ হচ্ছে।
জীবনভর আমাদের শুনতেই হচ্ছে ক্ষমতার পালাবদলে একপক্ষ পুরো জাতির জন্য গোলা ভরে যান।

আর পরে যারা ক্ষমতায় আসেন তারা এসে জানান ফাঁকা গোলা, কিছুই নেই! সবই যে গালগল্প তাও তো অনেকে এখন বোঝেন। নির্ভেজাল যারা তারাও চিন্তায় নিচ্ছেন, রাজনীতির অন্তরালে কেমন ধরনের মধুর চাক আমাদের মতো ছোট্ট এই দেশের ফাঁকা গোলায় জানি রয়েছে!

এখানে শুধু সাহস করে হাত বাড়ালেই মৌমাছি বা ভিমরুলের আনাগোনা থেকেও মধু খাওয়া যায়।
এ দেশে মোড়ল বা কাপ্তান না হতে পারলে কেউ কাউকে পাত্তা দিতে চায় না। বাড়তি বা প্রচুর অর্থ কামাইয়ের পদ্ধতি না শেখা থাকলে কিংবা মোড়ল বা কাপ্তান না হতে পারলে ‘ব্যর্থ নাগরিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিজ পরিবারেও ঠিকমতো সমাদর পাওয়া যায় না।

বছরের পর বছর এভাবেই তো পার হয়। মানুষে মানুষে বিভেদ এভাবেই বেড়ে চলেছে। একগোষ্ঠী সবসময় সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করতে করতে তরুণ হতে বুড়ো হয়ে যায়। মূল্যস্ফীতি আর নানা ধরনের বৈষম্যের জাঁতাকলে না পড়লে ফুরফুরে জীবন তো হবেই। আনন্দের ঠেলায় কিছু মানুষের আয়েশি আলাপও উতরে আসে তখন।

রাষ্ট্র, সরকার সবই যদি থাকে নাগালে, তাহলে তো ‘এজেন্ডানির্ভর’ সভা-সেমিনারে কিছু বলার জন্যও দাওয়াত মেলে।

হয়তো এখন যারা সুবিধাভোগী অথবা মোড়ল কাতারে আছেন যারা, তারা একসময় অদূর ভবিষ্যতের কোনো সভা সেমিনারে গুরুগম্ভীর আলোচনা পর্বে অংশ নিয়ে বলবেন; ‘আমরা দিব্বি দেখতে পাচ্ছি তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে দিনে দিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে!

আমরা এর থেকে উত্তরণ খুঁজছি।’ ঠিক সেই সময়ই হয়তো আরেকটি জেনারেশন উদ্ভব হতে পারে। তখন পরিণতি বা দৃশ্যপট কেমন হবে- তা কিন্তু কল্পনা করতে পারছি না।

পরিণতি আরও অপমানজনকও হতে পারে। কারণ অতীতের পটপরিবর্তনের মুহূর্তগুলো স্মরণ রাখলেও কেউই ভয়ে রাখেন না!
যুগের পর যুগ থেকে চলা ভেজালযুক্ত বৈষম্যমূলক অর্থ ব্যবস্থা, সমাজ বা অনিরাপদ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নতুন পন্থায় কেউ এগিয়ে নেবার জন্য চায় কিনা সন্দেহ।

দেশ পরিচালনাকারীরা বঞ্চনার যে বীজ বপন বা চারা গাছ লাগিয়ে রাখেন, এটি বেমালুম অনিচ্ছাকৃত নয়, নেপথ্যে রয়েছে গুপ্ত অভিলাষ। কেউ স্বীকারও করেন না। হয়তো ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিমুখ হওয়া নিয়ে গবেষণা সেল গঠন করবেন সেই তারাই!

সামনে জরিপ কার্য চালাতেও উদ্বুদ্ধ হবে তাদের মদতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান।
এখনো সময় আছে কেবল নিজেদের পারিপার্শ্বিক মুখগুলো নিয়ে ব্যস্ত হলেই চলবে না, যারা কোনো ভেজালে নেইÑ তাদের জন্যও ফলপ্রসূ কিছু বাস্তবায়ন করুন। এই মানুষগুলোও দেশের ১৮ কোটিরই একটা অংশ।

জীবন-জীবিকার জন্য নির্ভেজাল মানুষেরাও কোনো না কোনো পেশায় সম্পৃক্ত। ক্ষমতাধররা নিজেদের নির্ভেজালপন্থিদের সামনে পর্তুগিজ কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক অথবা হাল আমলের চা বাগানের মালিক আর নির্ভেজালদের চা শ্রমিক হিসেবে ভাববেন না।

নির্ভেজালপন্থিদেরও টিকে থাকতে দরকার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অধিকার, তাদেরও প্রয়োজন কিছতা ইজ্জত-সম্মান। কারও গঞ্জনায় প্রকৃতিকে আর ভারী হতে দেবেন না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সধযনঁনলড়ঃর@ুধযড়ড়.পড়স