ঢাকা ১০:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

নিরাপত্তা খাতের উন্নয়নে যা করা যেতে পারে

  • আপডেট সময় : ০৪:২০:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ৭৮ বার পড়া হয়েছে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন : স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন একটি পরিপক্ব ও পরিণত জাতি রাষ্ট্র। রাজনৈতিক মডেল হিসেবে ১৬৪৮ সালের পিস অফ ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির আলোকে ওয়েস্টফেলিয়া তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি জাতিরাষ্ট্র মূলত দুটি নীতির ওপরে ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। প্রথমটি হলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব (ঝঃধঃব ঝড়াবৎবরমহঃু) নীতি, যা একটি রাষ্ট্রের নিজ ভূখণ্ডকে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার অধিকার দেয়। দ্বিতীয়টি হলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব (ঘধঃরড়হধষ ঝড়াবৎবরমহঃু) নীতি, যা একটি জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার অধিকার দেয়। আদর্শিক ও নৈতিকতার দিক থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব নীতির মূল ভিত্তি হলো জনগণের শাসন, যে ব্যবস্থায় নিজস্ব জনগণের ইচ্ছা ও সার্বিক কল্যাণের প্রতিফলন ঘটে।
জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বা ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের মতোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের। এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করবো যে, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার উপাদানগুলো কী, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার বর্তমান প্রেক্ষাপটগুলো কী এবং আমাদের জন্য জরুরি বিবেচ্য বিষয়গুলো কী হতে পারে। সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় এই আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক বলেই আমি মনে করি।
জাতীয় নিরাপত্তার সহজ সংজ্ঞা হলো, জাতি ও রাষ্ট্রের সব ধরনের স্বাধীনতা, ভূখণ্ড ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব, জাতির নিজস্ব ইচ্ছা ও মূল্যবোধ রক্ষাসহ সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে মূলত ভূখণ্ডের সীমানার (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ওহঃবমৎরঃু) নিরাপত্তা; রাজনৈতিক স্বাধীনতার (চড়ষরঃরপধষ ওহফবঢ়বহফবহপব) নিরাপত্তা; জাতির স্বাধীন ইচ্ছা ও মূল্যবোধের নিরাপত্তা; অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা; অর্থনৈতিক নিরাপত্তা; কূটনৈতিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা; সংস্কৃতি, পরিবেশ, জ্বালানি এবং পানি সম্পদ নিরাপত্তা সন্নিহিত।
জাতীয় প্রতিরক্ষা (ঘধঃরড়হধষ উবভবহংব) ব্যবস্থা ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব (ঝড়াবৎবরমহঃু) ও সীমানা নিরাপত্তা (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ওহঃবমৎরঃু) রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকলেও, জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দৃঢ়তার ওপর রাজনৈতিক স্বাধীনতার নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, কূটনৈতিক স্বাধীনতাসহ অন্য সব নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করে। তবে অন্য সব জাতীয় নিরাপত্তার উপাদানগুলো রক্ষার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার উপর বর্তায়। তবে প্রত্যেকটি একে অপরের পরিপূরক এবং একটার সাথে অন্যটি সংশ্লিষ্ট।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব (ঝঃধঃব ঝড়াবৎবরমহঃু) নীতির প্রশ্নে প্রথমেই আসে ভূখণ্ডের সীমানার (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ওহঃবমৎরঃু) নিরাপত্তা রক্ষা। বিষয়টি জাতীয় প্রতিরক্ষার (ঘধঃরড়হধষ উবভবহংব) অংশ হলেও অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর বিষয় হলেও এর সাথে কূটনীতি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, এনার্জি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইত্যাদি সরাসরি সম্পৃক্ত। তেমনি জাতীয় নিরাপত্তার অন্যান্য উপাদানগুলোর নিরাপত্তা যেমন অর্থনৈতিক; তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ; পরিবেশ, পানি সম্পদ ইত্যাদির নিরাপত্তা জাতীয় প্রতিরক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। যেমনটি ১৭৭৬ সালে অফধস ঝসরঃয – ঞযব ঋধঃযবৎ ড়ভ ঊপড়হড়সরপং – তার জগৎবিখ্যাত ঞযব ডবধষঃয ড়ভ ঘধঃরড়হং গ্রন্থে লিখেছিলেন যে শুধু সম্পদ অর্জন করলেই হবে না, এর যথাযথ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আজকে কতটুকু সুসংহত তা কারওই অজানা থাকার কথা নয়। সবস্তরে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মহামারি ও সরকারি ছত্রছায়ায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ব্যাপকতায় দেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংস প্রায়, কোটি কোটি টাকা পাচার, মেগা প্রজেক্ট এর নামে দেশের স্বার্থ বিরোধী অসম চুক্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত করা হয়েছে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। যে কোনো সময় বহিঃনিরাপত্তাকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে চলমান ছিলই। এ রমধ্যে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবোত্তর সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অসংগঠিত অবস্থা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা; পতিত সরকারের মরণ কামড়ের প্রচেষ্টায় তাদের প্রভু রাষ্ট্রের উসকানিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো রকম সময় না দিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থির করে রাখা; আনসার আন্দোলন, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণের প্রহসন, দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যা, পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক আন্দোলন ও ভাঙচুরের প্রচেষ্টা, পার্বত্য জেলাগুলোয় উপজাতিদের মধ্যে উসকানির মাধ্যমে চরম অস্থিরতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা ইত্যাদির মতো একসাথে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর কখনো হয়নি। দুই মাসের জন্য সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার নাজুকতা ও গুরুত্বকেই প্রমাণ করে।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারেÑ
১। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কমিটিকে (ঘঈঝঅ সক্রিয় করা। এই কমিটির অস্তিত্ব থাকলেও আমরা খুব কমই এই কমিটির কোনো অর্থবহ কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।
২। নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কমিটির নির্দেশনায়, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে, জরুরিভিত্তিতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঞযৎবধঃ ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে জাতীয় নিরাপত্তার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার উপাদানগুলোর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা। পৃথিবীর অনেক দেশে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা (ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু ঢ়ড়ষরপু) প্রণীত হয় ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার আলোকে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিমালা, অর্থনৈতিক নীতিমালা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত নীতিমালাসহ অন্য সব বিষয়ে নীতিমালা প্রণীত ও পর্যালোচনা করা হয়।
৩। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার ঊষবসবহঃং ড়ভ ঘধঃরড়হধষ চড়বিৎগুলো হলো সামরিক, আধা-সামরিক ও অন্যান্য বাহিনীগুলো, অর্থনীতি, কূটনীতি, মানব সম্পদ, জ্বালানি সম্পদ, পানি সম্পদ এবং সর্বোপরি, জাতীয় ইচ্ছা শক্তি (ঘধঃরড়হধষ রিষষ)। এই উপাদানগুলো জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার লক্ষ্যগুলো (চড়ষরপু ঙনলবপঃরাবং) অর্জনে সর্বদা সক্রিয় রাখতে ও তাদের মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলো ও মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নিয়মিত সমন্বয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কখনো কখনো কোনো কোনো রাস্তা ও ব্রিজ-এর মতো স্থাপনা নির্মাণ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও জাতীয় প্রতিরক্ষা তথা জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে পারে। তাই এই ধরনের স্থাপনা নির্মাণের প্রজেক্ট গ্রহণের আগে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি বা উপকমিটিতে আলোচনার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করার দাবি রাখে।
৪। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। এ জন্য পুলিশ বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী সমূহ পুরোপুরি সুসংহত ও পুনর্গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রাখা। তার ব্যতিক্রম হলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি হঠাৎ করেই সৃষ্টি হতে পারে ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং তার সুযোগে প্রতি-বিপ্লব হয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
৫। জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা ও আধুনিকায়ন করা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। তবে সবার আগে সশস্ত্র বাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ও এদের সব সদস্যদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি ও রাজনীতিমুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।
পরিশেষে আমি মনে করি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে পারলে; দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন ও সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সব নিরাপত্তা সহজেই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারকে বিতাড়িত করে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনে এবং ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যে সাহস, ইচ্ছাশক্তি ও দেশ প্রেমের পরিচয় দিয়েছে—এতে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, যে কোনো দেশই বাংলাদেশে সামরিক আগ্রাসন চালাতে অনেকবার ভাববে। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহস ও ইচ্ছা শক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আছেই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নিরাপত্তা খাতের উন্নয়নে যা করা যেতে পারে

আপডেট সময় : ০৪:২০:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন : স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন একটি পরিপক্ব ও পরিণত জাতি রাষ্ট্র। রাজনৈতিক মডেল হিসেবে ১৬৪৮ সালের পিস অফ ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির আলোকে ওয়েস্টফেলিয়া তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি জাতিরাষ্ট্র মূলত দুটি নীতির ওপরে ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। প্রথমটি হলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব (ঝঃধঃব ঝড়াবৎবরমহঃু) নীতি, যা একটি রাষ্ট্রের নিজ ভূখণ্ডকে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার অধিকার দেয়। দ্বিতীয়টি হলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব (ঘধঃরড়হধষ ঝড়াবৎবরমহঃু) নীতি, যা একটি জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার অধিকার দেয়। আদর্শিক ও নৈতিকতার দিক থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব নীতির মূল ভিত্তি হলো জনগণের শাসন, যে ব্যবস্থায় নিজস্ব জনগণের ইচ্ছা ও সার্বিক কল্যাণের প্রতিফলন ঘটে।
জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বা ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের মতোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের। এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করবো যে, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার উপাদানগুলো কী, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার বর্তমান প্রেক্ষাপটগুলো কী এবং আমাদের জন্য জরুরি বিবেচ্য বিষয়গুলো কী হতে পারে। সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় এই আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক বলেই আমি মনে করি।
জাতীয় নিরাপত্তার সহজ সংজ্ঞা হলো, জাতি ও রাষ্ট্রের সব ধরনের স্বাধীনতা, ভূখণ্ড ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব, জাতির নিজস্ব ইচ্ছা ও মূল্যবোধ রক্ষাসহ সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে মূলত ভূখণ্ডের সীমানার (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ওহঃবমৎরঃু) নিরাপত্তা; রাজনৈতিক স্বাধীনতার (চড়ষরঃরপধষ ওহফবঢ়বহফবহপব) নিরাপত্তা; জাতির স্বাধীন ইচ্ছা ও মূল্যবোধের নিরাপত্তা; অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা; অর্থনৈতিক নিরাপত্তা; কূটনৈতিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা; সংস্কৃতি, পরিবেশ, জ্বালানি এবং পানি সম্পদ নিরাপত্তা সন্নিহিত।
জাতীয় প্রতিরক্ষা (ঘধঃরড়হধষ উবভবহংব) ব্যবস্থা ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব (ঝড়াবৎবরমহঃু) ও সীমানা নিরাপত্তা (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ওহঃবমৎরঃু) রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকলেও, জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দৃঢ়তার ওপর রাজনৈতিক স্বাধীনতার নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, কূটনৈতিক স্বাধীনতাসহ অন্য সব নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর করে। তবে অন্য সব জাতীয় নিরাপত্তার উপাদানগুলো রক্ষার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার উপর বর্তায়। তবে প্রত্যেকটি একে অপরের পরিপূরক এবং একটার সাথে অন্যটি সংশ্লিষ্ট।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব (ঝঃধঃব ঝড়াবৎবরমহঃু) নীতির প্রশ্নে প্রথমেই আসে ভূখণ্ডের সীমানার (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ওহঃবমৎরঃু) নিরাপত্তা রক্ষা। বিষয়টি জাতীয় প্রতিরক্ষার (ঘধঃরড়হধষ উবভবহংব) অংশ হলেও অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর বিষয় হলেও এর সাথে কূটনীতি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, এনার্জি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইত্যাদি সরাসরি সম্পৃক্ত। তেমনি জাতীয় নিরাপত্তার অন্যান্য উপাদানগুলোর নিরাপত্তা যেমন অর্থনৈতিক; তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ; পরিবেশ, পানি সম্পদ ইত্যাদির নিরাপত্তা জাতীয় প্রতিরক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। যেমনটি ১৭৭৬ সালে অফধস ঝসরঃয – ঞযব ঋধঃযবৎ ড়ভ ঊপড়হড়সরপং – তার জগৎবিখ্যাত ঞযব ডবধষঃয ড়ভ ঘধঃরড়হং গ্রন্থে লিখেছিলেন যে শুধু সম্পদ অর্জন করলেই হবে না, এর যথাযথ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আজকে কতটুকু সুসংহত তা কারওই অজানা থাকার কথা নয়। সবস্তরে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মহামারি ও সরকারি ছত্রছায়ায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ব্যাপকতায় দেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংস প্রায়, কোটি কোটি টাকা পাচার, মেগা প্রজেক্ট এর নামে দেশের স্বার্থ বিরোধী অসম চুক্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত করা হয়েছে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। যে কোনো সময় বহিঃনিরাপত্তাকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে চলমান ছিলই। এ রমধ্যে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবোত্তর সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অসংগঠিত অবস্থা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা; পতিত সরকারের মরণ কামড়ের প্রচেষ্টায় তাদের প্রভু রাষ্ট্রের উসকানিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো রকম সময় না দিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থির করে রাখা; আনসার আন্দোলন, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণের প্রহসন, দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যা, পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক আন্দোলন ও ভাঙচুরের প্রচেষ্টা, পার্বত্য জেলাগুলোয় উপজাতিদের মধ্যে উসকানির মাধ্যমে চরম অস্থিরতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা ইত্যাদির মতো একসাথে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর কখনো হয়নি। দুই মাসের জন্য সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার নাজুকতা ও গুরুত্বকেই প্রমাণ করে।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারেÑ
১। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কমিটিকে (ঘঈঝঅ সক্রিয় করা। এই কমিটির অস্তিত্ব থাকলেও আমরা খুব কমই এই কমিটির কোনো অর্থবহ কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।
২। নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কমিটির নির্দেশনায়, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে, জরুরিভিত্তিতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঞযৎবধঃ ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে জাতীয় নিরাপত্তার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার উপাদানগুলোর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা। পৃথিবীর অনেক দেশে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা (ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু ঢ়ড়ষরপু) প্রণীত হয় ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার আলোকে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিমালা, অর্থনৈতিক নীতিমালা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত নীতিমালাসহ অন্য সব বিষয়ে নীতিমালা প্রণীত ও পর্যালোচনা করা হয়।
৩। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার ঊষবসবহঃং ড়ভ ঘধঃরড়হধষ চড়বিৎগুলো হলো সামরিক, আধা-সামরিক ও অন্যান্য বাহিনীগুলো, অর্থনীতি, কূটনীতি, মানব সম্পদ, জ্বালানি সম্পদ, পানি সম্পদ এবং সর্বোপরি, জাতীয় ইচ্ছা শক্তি (ঘধঃরড়হধষ রিষষ)। এই উপাদানগুলো জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার লক্ষ্যগুলো (চড়ষরপু ঙনলবপঃরাবং) অর্জনে সর্বদা সক্রিয় রাখতে ও তাদের মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলো ও মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নিয়মিত সমন্বয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কখনো কখনো কোনো কোনো রাস্তা ও ব্রিজ-এর মতো স্থাপনা নির্মাণ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও জাতীয় প্রতিরক্ষা তথা জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে পারে। তাই এই ধরনের স্থাপনা নির্মাণের প্রজেক্ট গ্রহণের আগে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি বা উপকমিটিতে আলোচনার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করার দাবি রাখে।
৪। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। এ জন্য পুলিশ বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী সমূহ পুরোপুরি সুসংহত ও পুনর্গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রাখা। তার ব্যতিক্রম হলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি হঠাৎ করেই সৃষ্টি হতে পারে ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং তার সুযোগে প্রতি-বিপ্লব হয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
৫। জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা ও আধুনিকায়ন করা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। তবে সবার আগে সশস্ত্র বাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ও এদের সব সদস্যদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি ও রাজনীতিমুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।
পরিশেষে আমি মনে করি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে পারলে; দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন ও সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সব নিরাপত্তা সহজেই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারকে বিতাড়িত করে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনে এবং ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যে সাহস, ইচ্ছাশক্তি ও দেশ প্রেমের পরিচয় দিয়েছে—এতে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, যে কোনো দেশই বাংলাদেশে সামরিক আগ্রাসন চালাতে অনেকবার ভাববে। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহস ও ইচ্ছা শক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আছেই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা