বিশেষ সংবাদদাতা : বিশ্বব্যাপী চলমান করোনা মহামারির মধ্যে দেড় বছরে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। এতে পিষ্ট হচ্ছেন ভোক্তারা। অন্যদিকে সম্প্রতি সরকার এলপি গ্যাস, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। ফলে জীবন যাত্রার ব্যয়ও আরেক দফা বাড়ছে। এতে অর্থনীতির সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। করোনা সংক্রমণের আগের দাম এবং গতকাল শনিবারের দাম সরেজমিনে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ঘোষণার আগে অর্থাৎ ফেব্রয়ারিতে প্রায় সবগুলো নিত্যপণ্যের দাম বর্তমান দামের চেয়ে কম ছিল। এরপর গত দেড় বছরে দাম বেড়ে জনসাধারণের নাগালের প্রায় বাইরে চলে গেছে। করোনার আগে মোটা চালের (পাইজাম) গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৪০ টাকা। গত দেড় বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকায়, শতাংশ হারে যা প্রায় ২৫ শতাংশ। প্রতি কেজি মশুর ডালের (দেশি) দাম করোনার আগে ছিল ১০০ টাকা। এটি বেড়ে এখন হয়েছে ১১০ টাকা, বৃদ্ধি ১০ শতাংশ। আর আকাশ ছুঁয়েছে ভোজ্য তেল। করোনার আগে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ছিল ৮৫ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। অর্থাৎ তেলের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ (৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ)। অন্যান্য নিত্যপণ্যের মধ্যে মুরগি, পেঁয়াজ, চিনির দামও অনেক বেড়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা (বৃদ্ধি ৫০ শতাংশ)। চিনির দামও বেড়েছে কেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম কয়েকবার ওঠানামা করেছে। চিনির দামও আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ায় তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেবে এমন আশঙ্কা থেকে পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। এরপর সরকার যেদিন শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়, সেদিনই দাম কমে যায়। এতে ভোক্তারা অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। এদিকে মুরগির দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড হয়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। যা আগে ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। অর্থাৎ শতাংশ হারে বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। গরুর মাংসের দামও বেড়েছে ২০ টাকা। বর্তমানে প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। বৃদ্ধির তালিকায় আছে ডিমও। ডজনে ৩০ টাকা বেড়ে বর্তমানে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায় (বৃদ্ধি ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ)। তাছাড়া বর্তমানে প্রায় ৬ থেকে ৮টি সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার উপরে। অথচ এসব সবজি আগে পাওয়া যেত ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি।
করোনার আগে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা। কয়েক দিন আগে তা বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা। (বৃদ্ধি ২৩ শতাংশ)। আগে ১২ কেজির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল ১১০০ টাকা। কয়েক দফায় বেড়ে সেটি হয়েছে ১৩১৩ টাকা (বৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ)। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসেবে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে ২৭৭ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যেত, এই বছরের মার্চে সেই পরিমাণ পণ্য ও সেবা নিতে ব্যয় করতে হয়েছে ২৯২ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে একই পণ্য ও সেবা কিনতে ১৫ টাকা বেশি খরচ করতে হয়েছে। শতকরা হিসেবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। গত বছরের মার্চে ৩০১ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ কিনতে এই বছরের মার্চে ব্যয় হয়েছে ৩১৮ টাকা। আলোচ্য সময়ে এতে বেশি ব্যয় হয়েছে ১৭ টাকা। শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ
আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে। গত বছরের মার্চে ২৪৬ টাকায় যে পরিমাণ খাদ্যবহির্ভূত পণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ পণ্য কিনতে এখন ব্যয় হচ্ছে ২৫৯ টাকা। বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ১৩ টাকা। পল্লি এলাকায় সাধারণ খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকে, শহরে বেশি থাকে। এছাড়া গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবায় ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবায় ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৪০ লাখ। করোনার কারণে গত বছর চাকরি হারিয়েছেন ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনায় রাজধানী ঢাকায় ৭৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ‘লেবার রিসোর্স অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার’ (বিলস) নামের একটি সংস্থা বলছে, করোনাকালে দেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এ সময় আয় কমে যাওয়ার কথা বলছে, ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনায় ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩৪ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। আর ঋণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
নিত্যব্যয় বৃদ্ধিতে সঙ্কটে ভোক্তারা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ