ক্রীড়া প্রতিবেদক : কি পেলো বাংলাদেশের ফুটবল? প্রতি বছরের শেষান্তে ক্রীড়াঙ্গনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গেলে বড় হয়ে সামনে আসে এ প্রশ্নটি। ফুটবলে প্রাপ্তির খাতাটি শূন্যই থাকে। বিশেষ করে পুরুষ ফুটবলে। প্রতি বছর শেষে লিখতে হয় পুরুষ ফুটবলের ব্যর্থতার কাহিনী। কয়েক বছর ধরে নারী ফুটবলের কারণে কিছু সাফল্যের গল্প তুলে ধরা যায়। ২০২২ সালটা ছাড়িয়ে গেছে নারী ফুটবলের পূর্বের সব সাফল্য। এ বছর যে ইতিহাস গড়েছে দেশের নারী ফুটবলাররা। বিদায়ী বছরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল নারী ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের। ভারতের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্ব এখন বাংলাদেশের হাতে। টুর্নামেন্টের আগের সব শিরোপাই জিতেছিল ভারত। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের এবারের আসর বসেছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে। অংশ নিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার ৭ টি দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভুটান ও শ্রীলংকা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে বাংলাদেশের সামনে পড়েছিল মালদ্বীপ, পাকিস্তান, ভারত, ভুটান ও নেপাল। ৫ দেশকেই হারিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়েছে ৩-১ গোলে।নারীদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য ছিল ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ আসরে রানার্সআপ হয়ে। আগের পাঁচবারের মধ্যে ওই একবারই বাংলাদেশ উঠতে পেরেছিল ফাইনালে। যে কারণে এবার ঘরের আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম ফেভারিট ছিল নেপাল। কিন্তু সেই নেপালকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ গড়েছে ইতিহাস। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের সামনে ছিল ভারত, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে মালদ্বীপকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে হারায় ৬-০ গোলের বড় ব্যবধানে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের সামনে বড় পরীক্ষা ছিল ভারত। আগেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হলেও ভারতের বিপক্ষে লড়াইটা ছিল নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর। সেই লড়াইয়ে সিরাত জাহান স্বপ্নার জোড়া ও কৃষ্ণা রানী সরকারের গোলে ভারতকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে শতভাগ জয় নিয়েই সেমিফাইনালে খেলেছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। সেমিফাইনালে বাংলাদেশ পেয়েছিল ভুটানকে। ফেবারিট হিসেবেই ওই ম্যাচে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। খেলেছিল ফেবারিটদের মতোই। সাবিনার হ্যাটট্রিক এবং স্বপ্না, কৃষ্ণা, রিতু, মাসুরা ও তহুরার গোলে মালদ্বীপকে ৮-০ ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে উঠেছিল ফাইনালে। ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। মেয়েদের এই ঐতিহাসিক জয়ের পর দেশে তৈরি হয়েছিল উৎসমুখর পরিবেশ। সাবিনা-কৃষ্ণারা যেদিন দেশে ফিরেছিল সেদিন হযরত শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে মতিঝিল বাফুফে ভবন পর্যন্ত মানুষের ঢল নেমেছিল। বিমান বন্দরে এত মানুষের সমাগম হয়েছিল যে, বাফুফেকে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করতে হয়েছিল। বিমান বন্দর নারী ফুটবলারদের ছাদখোলা বাসে করে আনা হয়েছিল মতিঝিল বাফুফে ভবনে। বাস যে সড়কগুলো দিয়ে মতিঝিল পৌঁছেছিল সেই সড়কগুলোর দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে অভ্যার্থনা জানিয়েছিল সাবিনাদের। বাস মতিঝিলে বাফুফে ভবনের সামনে আসার পর সাবিনারা নামতে পারছিলেন না মানুষের চাপে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নারী ফুটবল দলকে সংবর্ধনা দিয়েছে। চ্যাম্পিয়ন দলের মেয়েরা তাদের নিজ নিজ এলাকায়ও পেয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সংবর্ধনা। নানা পুরস্কারে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে মেয়েদের হাত কেবল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাই নয়, বিদায়ী বছরে জাতীয় নারী ফুটবল দল ৭ টি ম্যাচ খেলে একটিও হারেনি। ২০২২ সালে সাবিনারা প্রথম খেলেছিল মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতে জিতেছিল ৬-০ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচ ড্র করেছিল গোলশূন্যভাবে। বাংলাদেশের বছরের বাকি ৫ ম্যাচই ছিল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের। পুরো বছরে বাংলাদেশের মেয়েরা গোল করেছে ২৯ টি, খেয়েছে মাত্র ১টি। মেয়েদের ঠিক উল্টো ফল ছেলেদের ফুটবলে। বছরে মাত্র একটি ম্যাচ জিততে পেরেছে জামাল ভুঁইয়ারা। এবছর জাতীয় ফুটবল দল আগের বছরের তুলনায় ম্যাচও অনেক কম খেলেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ যেখানে ম্যাচ খেলেছিল ১৬টি সেখানে এবছর খেলেছে তার অর্ধেক ৮টি। কিন্তু ৮ ম্যাচে মাত্র একটি ম্যাচ জিতেছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।
জামাল ভূঁইয়ারা বছর শুরু করেছিল মালদ্বীপের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ দিয়ে। মালেতে হওয়া মার্চের ওই ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ২-০ গোলে। ওই মাসেই সিলেটে বাংলাদেশ প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে। ঘরের মাঠেও বাংলাদেশ জিততে পারেনি। ম্যাচটি ড্র করে গোলশূন্যভাবে। ১ জুন বাংলাদেশ আরেকটি প্রীতি ম্যাচ খেলে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে। ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত ম্যাচটিও ড্র হয়েছিল গোলশূন্যভাবে। বাংলাদেশের পরের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল এশিয়ান কাপ বাছাই। শক্তিশালী তিন দেশ বাহরাইন, তুর্কমেনিস্তান ও মালয়েশিয়ার বিপক্ষেই হেরেছিল বাংলাদেশ। খেলা হয়েছিল মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ২-০ গোলে হারে বাহরাইনের কাছে, পরের ম্যাচে তুর্কমেনিস্তানের কাছে হারে ২-১ গোলে, শেষ ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে ৪-১ গোলে হেরে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের বছরে ফিফা ও এফসির ম্যাচ কম থাকায় ফ্রেন্ডলি ম্যাচের ওপরই জোর দিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। সেপ্টেম্বরে বছরের শেষ দুটি ম্যাচও খেলেছে ফিফা ফ্রেন্ডলি।নারী ফুটবল দল যখন নেপালে ইতিহাস গড়ে, তখন পুরুষ ফুটবল দল ছিল কম্বোডিয়ায়। সাবিনাদের ঐতিহাসিক জয় পারেনি জামাল ভূঁইয়াদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিল। কম্বোডিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতেছিল ১-০ গোলে।যে মাঠে বাংলাদেশের মেয়েরা ইতিহাস গড়েছিল নেপালকে হারিয়ে সেই কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামেই জামাল ভুঁইয়ারা খেলেছিল বছরের শেষ ম্যাচ। মেয়েরা যে কয়গোলে নেপালকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল সেই ব্যবধানেই (৩-১) জামাল ভূঁইয়ারা হেরে যায় দশরথে। জাতীয় ফুটবল দল ২০২২ সাল শুরু করেছিল নতুন কোচ স্পেনের হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরাকে দিয়ে। ইংল্যান্ডের জেমি ডে, স্পেনের অস্কার ব্রুজোন, পর্তৃগালের মারিও লেমোসের পর ক্যাবরেরার হাতে জাতীয় দল তুলে দিয়েছিল বাফুফেকে। কিন্তু বিদায়ী বছরে কম্বোডিয়ার বিপক্ষে একমাত্র জয়টিই এসেছে তার অধীনে। বিদায়ী বছরটি ঘরোয়া ফুটবলের ছিল নতুনত্বের। এবার বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল শুরু হয়েছে ইউরোপের আদলে। লিগ ও টুর্নামেন্ট ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ধ্যান-ধারণা থেকে বেড়িয়ে এবার বাফুফে লিগ ও ফেডারেশন কাপ একই সঙ্গে চালিয়ে যাচেছ। ৯ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ এবং ২০ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে। ইউরোপের মতো প্রিমিয়ার লিগের খেলা হচ্ছে সপ্তাহে দুই দিন। শুক্রবার ও শনিবার হচ্ছে প্রিমিয়ার লিগের খেলা। শুধু মঙ্গলবার হবে ফেডারেশন কাপের খেলা। যে কারণে এই প্রথম দীর্ঘ সময় চলবে একটি টুর্নামেন্টের খেলা। ফেডারেশন কাপের যে সিডিউল করেছে বাফুফে তাতে এই টুর্নামেন্ট শেষ হবে মে মাসে। এবার ঘরোয়া ফুটবলের বেশিরভাগ খেলা হচ্ছে ঢাকার বাইরে। ছুটির দিনে খেলা বলে স্টেডিয়ামে দর্শকও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা বাফুফে চাইছে দর্শকদের খেলা দেখা যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার খেলা-এটা দর্শককের কাছে নিয়মিত করার জন্যই নতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাফুফে। ঢাকায় কেবল খেলা হচ্ছে বসুন্ধরা কিংস এরেনায়। সংস্কার কাজ চলমান থাকায় এবারও দেশের প্রধান ভেন্যু বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও বাফুফে মার্চের মধ্যে মাঠ তৈরি করে দিতে অনুরোধ করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে। এবার মৌসুম শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা কাপ দিয়ে। বছরের প্রথম টুর্নামেন্ট জিতে দারুণ শুরু করেছে বসুন্ধরা কিংস। বাফুফের পরিকল্পনা আছে এবার চারটি আসর আয়োজনের। বিরতি পড়া কোটি টাকা প্রাইজমানির সুপার কাপ এবার আয়োজনের পরিকল্পনা আছে বাফুফের। ফেডারেশন কাপ ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ শেষ হওয়ার পর চতুর্থ এই টুর্নামেন্টটি আয়োজন করতে পারে বাফুফে।
নারী ফুটবলে ইতিহাস গড়ার বছর
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ