ঢাকা ০৯:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫

নারীর প্রতি সহিংসতা: পুরুষরা কী ভূমিকা রাখতে পারে?

  • আপডেট সময় : ০৩:৪৮:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান : বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি গুরত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা; যা প্রতিদিনের জীবনযাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী ও পুরুষের মধ্যে অসম শক্তির সম্পর্ক এবং পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পুরুষদের অবদান ও সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর লক্ষ্যে পুরুষরা কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হবে।

প্রথমেই দেখা যাক নারীর প্রতি সহিংসতার বাস্তব চিত্র। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৪৯ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশে ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

এই সময়কালে মোট ১৭ হাজার ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং কর্তৃত্বের ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে, এর ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি ‘স্বাভাবিক’ বা সামাজিকভাবে গৃহীত আচরণে পরিণত হয়েছে। আমাদের সমাজে পুরুষরা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে চায় এবং এই সংস্কৃতির একাংশ নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করে। এই প্রেক্ষাপটে, পুরুষদের সহিংসতা কমানোর একটি প্রধান উপায় হলো এই পুরুষতান্ত্রিক ধারণার সংস্কার করা। পুরুষদের সহিংসতা কমানোর জন্য প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে, অনেক পুরুষ নারীদের প্রতি সম্মান এবং মর্যাদার গুরুত্ব বুঝতে পারে না; যা সহিংস আচরণকে প্রশ্রয় দেয়। ফলে নারীদের প্রতি মানসিক, শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মাধ্যমে পুরুষদের মধ্যে নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং সুরক্ষা বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা অপরিহার্য। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম, সমাজসেবা সংস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ইতিবাচক পুরুষত্ব’ ধারণার প্রচলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক পুরুষত্ব বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি- যেখানে পুরুষরা তাদের সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার ব্যবহার নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমর্থন এবং সহানুভূতির জন্য করে।

যদি পুরুষরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এমন উদাহরণ তৈরি করেন, তাহলে তা অন্যান্য পুরুষদেরও প্রভাবিত করবে এবং সমাজে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব বাড়াবে। পারিবারিকভাবে মূল্যবোধের গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। পারিবারিক পরিবেশ ও পিতৃ-মাতৃ আদর্শ শিশুদের মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুরা পরিবার থেকে শেখে এবং তা সামাজিক আচরণে প্রতিফলিত হয়। একজন পুরুষ বাবা হিসেবে যদি নিজের সন্তানদের সামনে স্ত্রী এবং পরিবারের নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাদের সমান অধিকার দেন, তাহলে তা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখানো উচিত নারীদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি প্রদর্শন করতে; যাতে তারা ভবিষ্যতে নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ থেকে বিরত থাকে। একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রায়ই নারীরা কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি এবং বৈষম্যের শিকার হন। পুরুষ সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীরা এখানে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, সহানুভূতি এবং সমর্থনের মাধ্যমে পরিবেশকে নারীদের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক করতে পারেন; বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীর প্রতি সম্মান এবং অধিকার সম্পর্কিত শিক্ষার প্রচার প্রয়োজন। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে প্রশাসনিক এবং আইনি সহায়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং পুরুষ কর্মীদের সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা নিতে হবে।

অন্যদিকে আইনি সহায়তা ও প্রশাসনিক উদ্যোগে পুরুষদের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য কিছু আইন প্রণীত হলেও প্রয়োগ প্রায়ই দুর্বল। এই পরিস্থিতিতে পুরুষদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা জরুরি। সমাজে প্রত্যেক পুরুষই যখন নারী নির্যাতনের কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন, তখন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে সেই ঘটনাকে উপেক্ষা না করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে পারেন; এমনকি পরিবারের মধ্যে নির্যাতনের শিকার কেউ হলে বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানি হলে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। পুরুষরা যদি এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে সাহসী এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন, তবে আইনি প্রয়োগ আরও কার্যকর হতে পারে। অধিকন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পুরুষদের সংহতি এবং সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং প্রচারণায় পুরুষদের অংশগ্রহণ করলে তা সমাজের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যখন নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তখন যদি পুরুষরাও নারীদের সাথে সমর্থন এবং সহানুভূতি নিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহজতর হয়। পুরুষদের এই সংহতি অন্য পুরুষদেরও প্রভাবিত করবে এবং সমাজে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মানসিকতা কমাতে সহায়ক হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে কিছু দেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেমন- ‘ডযরঃব জরননড়হ ঈধসঢ়ধরমহ’ নামে একটি পুরুষ নেতৃত্বাধীন আন্দোলন অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় পরিচালিত হয়; যেখানে পুরুষেরা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শপথ নেয়। বাংলাদেশেও যদি পুরুষ নেতৃত্বাধীন এমন উদ্যোগ শুরু হয়, তাহলে তা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া সুইডেনে পুরুষদের পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক এবং পুরুষদের পরিবারে সমান ভূমিকা রাখার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।

ফলে নারীদের প্রতি তাদের সম্মান এবং দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয়। একই সঙ্গে স্পেনে ২০০৪ সালে ‘জেন্ডার ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়; যা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পুরুষদের আইনি দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দেয়। এই আইনের অধীনে পুরুষদের নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করা হয়। পাশাপাশি, দক্ষিণ আফ্রিকায় পুরুষরা ‘ঝড়হশব এবহফবৎ ঔঁংঃরপব ঘবঃড়িৎশ’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করে, যা নারীর অধিকার এবং সমতার পক্ষে কাজ করে। এই সংগঠন পুরুষদের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে পুরুষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন, নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মাধ্যমে এই সহিংসতা অনেকটাই কমানো সম্ভব। পারিবারিক এবং সামাজিক স্তরে পুরুষরা যদি দায়িত্ববান, সহানুভূতিশীল এবং সুশিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন, তবে তা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

লেখক: লোক প্রশাসন ও জননীতি গবেষক

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নির্বাচনে দেরি হলে জঙ্গি ও উগ্রপন্থিরাও সুযোগ নেবে: ফখরুল

নারীর প্রতি সহিংসতা: পুরুষরা কী ভূমিকা রাখতে পারে?

আপডেট সময় : ০৩:৪৮:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান : বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি গুরত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা; যা প্রতিদিনের জীবনযাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী ও পুরুষের মধ্যে অসম শক্তির সম্পর্ক এবং পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পুরুষদের অবদান ও সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর লক্ষ্যে পুরুষরা কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হবে।

প্রথমেই দেখা যাক নারীর প্রতি সহিংসতার বাস্তব চিত্র। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৪৯ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশে ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

এই সময়কালে মোট ১৭ হাজার ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং কর্তৃত্বের ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে, এর ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি ‘স্বাভাবিক’ বা সামাজিকভাবে গৃহীত আচরণে পরিণত হয়েছে। আমাদের সমাজে পুরুষরা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে চায় এবং এই সংস্কৃতির একাংশ নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করে। এই প্রেক্ষাপটে, পুরুষদের সহিংসতা কমানোর একটি প্রধান উপায় হলো এই পুরুষতান্ত্রিক ধারণার সংস্কার করা। পুরুষদের সহিংসতা কমানোর জন্য প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে, অনেক পুরুষ নারীদের প্রতি সম্মান এবং মর্যাদার গুরুত্ব বুঝতে পারে না; যা সহিংস আচরণকে প্রশ্রয় দেয়। ফলে নারীদের প্রতি মানসিক, শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মাধ্যমে পুরুষদের মধ্যে নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং সুরক্ষা বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা অপরিহার্য। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম, সমাজসেবা সংস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ইতিবাচক পুরুষত্ব’ ধারণার প্রচলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক পুরুষত্ব বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি- যেখানে পুরুষরা তাদের সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার ব্যবহার নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমর্থন এবং সহানুভূতির জন্য করে।

যদি পুরুষরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এমন উদাহরণ তৈরি করেন, তাহলে তা অন্যান্য পুরুষদেরও প্রভাবিত করবে এবং সমাজে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব বাড়াবে। পারিবারিকভাবে মূল্যবোধের গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। পারিবারিক পরিবেশ ও পিতৃ-মাতৃ আদর্শ শিশুদের মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুরা পরিবার থেকে শেখে এবং তা সামাজিক আচরণে প্রতিফলিত হয়। একজন পুরুষ বাবা হিসেবে যদি নিজের সন্তানদের সামনে স্ত্রী এবং পরিবারের নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাদের সমান অধিকার দেন, তাহলে তা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখানো উচিত নারীদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি প্রদর্শন করতে; যাতে তারা ভবিষ্যতে নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ থেকে বিরত থাকে। একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রায়ই নারীরা কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি এবং বৈষম্যের শিকার হন। পুরুষ সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীরা এখানে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, সহানুভূতি এবং সমর্থনের মাধ্যমে পরিবেশকে নারীদের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক করতে পারেন; বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীর প্রতি সম্মান এবং অধিকার সম্পর্কিত শিক্ষার প্রচার প্রয়োজন। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে প্রশাসনিক এবং আইনি সহায়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং পুরুষ কর্মীদের সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা নিতে হবে।

অন্যদিকে আইনি সহায়তা ও প্রশাসনিক উদ্যোগে পুরুষদের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য কিছু আইন প্রণীত হলেও প্রয়োগ প্রায়ই দুর্বল। এই পরিস্থিতিতে পুরুষদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা জরুরি। সমাজে প্রত্যেক পুরুষই যখন নারী নির্যাতনের কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন, তখন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে সেই ঘটনাকে উপেক্ষা না করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে পারেন; এমনকি পরিবারের মধ্যে নির্যাতনের শিকার কেউ হলে বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানি হলে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। পুরুষরা যদি এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে সাহসী এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন, তবে আইনি প্রয়োগ আরও কার্যকর হতে পারে। অধিকন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পুরুষদের সংহতি এবং সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং প্রচারণায় পুরুষদের অংশগ্রহণ করলে তা সমাজের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যখন নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তখন যদি পুরুষরাও নারীদের সাথে সমর্থন এবং সহানুভূতি নিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহজতর হয়। পুরুষদের এই সংহতি অন্য পুরুষদেরও প্রভাবিত করবে এবং সমাজে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মানসিকতা কমাতে সহায়ক হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে কিছু দেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেমন- ‘ডযরঃব জরননড়হ ঈধসঢ়ধরমহ’ নামে একটি পুরুষ নেতৃত্বাধীন আন্দোলন অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় পরিচালিত হয়; যেখানে পুরুষেরা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শপথ নেয়। বাংলাদেশেও যদি পুরুষ নেতৃত্বাধীন এমন উদ্যোগ শুরু হয়, তাহলে তা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া সুইডেনে পুরুষদের পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক এবং পুরুষদের পরিবারে সমান ভূমিকা রাখার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।

ফলে নারীদের প্রতি তাদের সম্মান এবং দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয়। একই সঙ্গে স্পেনে ২০০৪ সালে ‘জেন্ডার ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়; যা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পুরুষদের আইনি দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দেয়। এই আইনের অধীনে পুরুষদের নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করা হয়। পাশাপাশি, দক্ষিণ আফ্রিকায় পুরুষরা ‘ঝড়হশব এবহফবৎ ঔঁংঃরপব ঘবঃড়িৎশ’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করে, যা নারীর অধিকার এবং সমতার পক্ষে কাজ করে। এই সংগঠন পুরুষদের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে পুরুষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন, নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মাধ্যমে এই সহিংসতা অনেকটাই কমানো সম্ভব। পারিবারিক এবং সামাজিক স্তরে পুরুষরা যদি দায়িত্ববান, সহানুভূতিশীল এবং সুশিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন, তবে তা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

লেখক: লোক প্রশাসন ও জননীতি গবেষক