ডা. ফারহানা মোবিন
আমাদের দেশে বেশ আয়োজন করে মা দিবস পালন করা হয়। কিন্তু মায়ের স্বাস্থ্যের দিকটা বরাবরই থাকে উপেক্ষিত। অথচ সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য গর্ভবতীকেও হতে হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এজন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি মায়ের পুষ্টিকর খাবার। হাড় ক্ষয় ও দুর্বল তেমন একটি রোগ- যার অন্যতম কারণ অপুষ্টি। তাই আমরা হাড় ক্ষয় ও দুর্বল রোগের বিষয়ে আপনাদের বিস্তারিত ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো।
নারীদের হাড় ক্ষয় ও দুর্বল হওয়ার কারণ এবং প্রতিকার: আগেই বলেছি- অস্টিওপরোসিস মানে হাড় দুর্বল ও হাড়ের মধ্যে ছোট ছোট ছিদ্র হয়ে যাওয়া। নারীদের অস্টিওপরোসিস হয় পুরুষের তুলনায় শতকরা ৮০ ভাগ বেশি। নারীদের প্রায় ৩৫ এবং পুরুষের সাধারণত বয়স ৪০ হওয়ার পর থেকে হাড় দুর্বল হতে শুরু করে।
প্রতি বছর পুরো দেহের চেক আপ করাতে হবে। আমাদের অজানা কোনো অসুখ থাকলে পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়বে। অনেক রোগী আছেন যাদের দেহের কোনো কোনো হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে অথচ কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যখন রোগী অনেক সিরিয়াস পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন ধরা পড়ে। এই জন্য প্রতি বছর পুরো দেহের চেক আপ করালে অনেক ক্ষতিকর পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সঠিক খাদ্যাভাস ও জীবনযাপন পদ্ধতির অভাবে হাড় ক্ষয় হয়ে যায়। হাড় আমাদের পুরো দেহের ওজন বহন করে, আমাদেরকে সঠিক ভাবে চলাচল করতে সাহায্য করে, আমাদের সোজাভাবে দাঁড়াতে এবং দৌড়ানোর জন্য অবদান রাখে।
নারীদের অস্টিওপরোসিস হওয়ার কারণ: প্রতি মাসে নারীদের পিরিয়ডের মাধ্যমে রক্তপাত হয়। দীর্ঘদিন বা দীর্ঘ বছর ধরে সঠিকভাবে পুষ্টিকর খাবারের অভাব; মা হওয়ার পর সন্তানকে খাওয়ানো এবং ওই অনুপাতে সঠিক পরিমাণে খাবার ও বিশ্রামের অভাবে মায়েদের হাড় দুর্বল হয়ে যায়। এই দুর্বলতা নারীদের বয়স ৪০ হওয়ার পর থেকে আরো প্রকট হতে শুরু করে; কিশোর বয়সে অতিমাত্রায় কায়িক পরিশ্রমের অভাব, বয়স বৃদ্ধি, দেহের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি না হওয়া বা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারা। যেমন- মেনোপজ হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ নারীর অস্টিওপরোসিস হতে শুরু করে। মেনোপজ মানে পিরিয়ড চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। মেনোপজ হলে নারীদের দেহে জরুরি কিছু হরমোনসহ বহুবিধ পুষ্টির ঘাটতি দেখা যায়। এই ঘাটতিগুলো হাড়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে; গর্ভাবস্থার সময়ে সঠিকভাবে আয়রন ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি, পরবর্তীকালে হাড় দুর্বল করে ফেলে; অতিমাত্রায় শারীরিক পরিশ্রম অনুপাতে পর্যাপ্ত খাবারের অভাব; দীর্ঘ বছর যাবৎ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, রক্ত শূন্যতা, নিয়মিত সূর্যের আলোতে না থাকা; দীর্ঘ বছর অতিমাত্রায় খাবার নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত ব্যায়াম, কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতে হাড় দুর্বল হতে পারে; কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, দীর্ঘ বছর মাদক দ্রব্য সেবনের জন্য নারী পুরুষ উভয়ের হাড় ক্ষয় হতে পারে।
হাড় ক্ষয় ও দুর্বল রোগের প্রতিকার: নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার- শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, দুধ এবং দুধ দিয়ে তৈরি খাবার খেতে হবে; বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে; নিয়মিত হাঁটা-চলা, বাসার কাজে অংশগ্রহণ, যতটা পারা যায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হবে; অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বা নির্ণয় হওয়া কোনো অসুখ থাকলে সেই মোতাবেক চিকিৎসা করাতে হবে; বাড়ন্ত বয়স, গর্ভাবস্থা, মাতৃদুগ্ধ দান করার সময়ে, মেয়েদের পিরিয়ডের সময়ে, বড় কোনো অপারেশন হবার পরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত; চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হাড়ের ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়া অনুচিত; দেহের কোনো মাংস পেশি অথবা হাড়, কোমর, ঘাড় বা পায়ের পাতার মধ্যে দীর্ঘ বছর যাবৎ ব্যথা বা জ্বালা পোড়া, অবশভাব থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি; ইউটিউব দেখে বা গুগল থেকে লেখাপড়া করে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যায়াম করা, কোনো ঔষধ খাওয়া বা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো থেকে বিরত থাকবেন; প্রতি বছর পুরো দেহের চেক আপ করাতে হবে। আমাদের অজানা কোনো অসুখ থাকলে পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়বে। অনেক রোগী আছেন যাদের দেহের কোনো কোনো হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে অথচ কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যখন রোগী অনেক সিরিয়াস পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন ধরা পড়ে। এই জন্য প্রতি বছর পুরো দেহের চেক আপ করালে অনেক ক্ষতিকর পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে; যাদের অতিমাত্রায় শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় তাদেরকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এর পাশাপাশি নিয়মিত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে; যেসব নারীর বারবার গর্ভপাত হয়, তাদের পরবর্তী সন্তান নেয়ার আগে থেকেই চিকিৎসকের অধীনে থাকতে হবে। কারণ বারবার গর্ভপাত হলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-বহুবিধ পুষ্টির অভাব হয়। এসব নিয়মন মেনে চললে আমরা অবশ্যই হাড় ক্ষয় ও দুর্বল রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবো।
লেখক: স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা এবং ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞ; এমবিবিএস, এমএস, পিজিটি (গাইনি অ্যান্ড অবস্), সিসিডি (বারডেম হসপিটাল), সি-কার্ড (মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ