জান্নাতুন নাহার নূপুর : বাসের জানালায় চোখ রেখে বরাবরের মতই সুদূর ঐ আকাশপানে চেয়ে আছি দীর্ঘ সময়। হয়তো পাশের মানুষটির এক সময় বোরিং বা আগ্রহ শুরু হতে থাকে আমার ব্যাপারে।আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলেন আপনি কি কোন কারণে আপসেট! আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আগের মতই চেয়ে থাকলাম শরতের মেঘের দিকে।উনি আমাকে আরো বললেন আপনি কি বোবা নাকি অহংকারী! আমি তখন প্রতিত্তোরে বললাম আমি কোনটাই না।উনি বললেন তাহলে কথা বলছেন না? বাসটি খুব দ্রুত বেগে চলছে।কখনো কখনো প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে পড়ে যাবার উপক্রম। তবু নিজেকে সামলে বললাম একজন অপরিচিত কারো কাছে নিজেকে নিয়ে এতো বলার কি আছে!আমি তো পরিচিত কারো কাছেই কিছু বলি না মন খোলে তনু ছাড়া। আমার কথা শুনে তিনি বললেন তনুটা কে!আমি বললাম তনু আমার সবকিছু।আমার কথা শুনে লগ্নজিতা আরো অবাক হতে শুরু করলো। ও আমার পাশের সিটের মেয়েটির নাম লগ্নজিতা।কথার ফাকে জানতে পারলাম। লগ্নজিতা জানতে চায়লো আমি ঢাকায় একা এসেছি কিনা? আমি বললাম না। আমি তনুর সাথে ট্রেনে করে ঢাকায় এসেছিলাম।তনু আগের স্টেশন থেকে উঠে আর আমি ঠিক তার পরের স্টেশন থেকে ভোর চারটায়। তনু আমাকে চারটার আগেই স্টেশনে থাকতে বলে। আমিও এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ট্রেনের চেয়ে অপেক্ষা টা তার জন্য বেশি ছিল। সে আমাকে আগেই বলেছিল ‘ঠ’ নাম্বার বগি। আমার ট্রেনে এনিয়ে দুইবার জার্নি। একবার অনার্স ১ম বর্ষে চড়ে ঢাকায় এসেছিলাম আর এখন। তাই বগি নিয়ে কোন ধারনা নেই যে ‘ঠ’ নাম্বার বগি কোনদিকে হবে? ক,খ,গ,ঘ এইভাবে গুণে গুণে একবার সামনে দৌড়াই আবার পেছনে। কিন্তু ‘ঠ’ বগি খুঁজে পাই না। এদিকে তো তনু ফোন দিয়েই যাচ্ছে। আমি কয়েক বার ফোন ধরে কথাও বলেছি, পরে আর রিসিভ করিনা।মনের ভেতর ভয় ‘ঠ’ নাম্বার বগি না পেলে তনু কে হারিয়ে ফেলবো।এটা ভেবেই প্রচ- কান্না পাচ্ছিল। তবু মন কে শক্ত করে দৌড়াচ্ছি অন্ধের মত। ট্রেন তার হুইসেল বাজিয়ে দিছে। বুকের ভেতর আরো কষ্ট দানা বাঁধতে শুরু করে। অন্ধকারে আমার মন আরো আন্ধ্যারে তলায় যাচ্ছে। ট্রেন চলন্ত অবস্থায় পা রাখি একটা বগিতে। কে যেন হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে। শোনার সময় পাইনি তাই শুধু না তাকিয়েই হাতটা বাড়িয়েছিলাম। পরে একটানে তার বুকে নিয়েছিল। আমি তো তখনো কাঁপছি। সেই সাথে কান ভাড়ি হয়ে আসছিল লোকটার চেঁচামেচিতে।চোখ বুঝেই চিনতে পাই চিরচেনা সেই গলার স্বর,তার গায়ের সেই চেনা গন্ধ।। বুকের বেদনা কঠিন শিলায় পরিণত হয়, চোখের পাপড়ি অশ্রুকে আলিঙ্গন করে আড়াল করে ফেলে। একদম চুপ করে বসে থাকে রেলের কামরায়। বাকি পথ কোন কথা হয় নি আর। নিঃচুপ থেকেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি বিমান বন্দর পৌঁছে গেছি। সে আমাকে তার হাত শক্ত করে ধরে একটা রিকসা নিলো। আমাকে আমার গন্তব্যে দিয়ে ৫০০টাকার একটা হাতে ধরিয়ে বললো যাবার সময় যেন আমি একাই চলে যাই। এতোক্ষণ পর আমি বললাম যদি হারিয়ে যাই! সে বললো বর্তমানে কেউ হারায় না। নিজে নিজে পথ চিনতে শিখো।নারী হয়ে জন্মেছো বলে অবলা নও। নিজেকে আরো শক্ত করো, নিজেরটা নিজে সামলাতে শিখো।কারো করুণা বা দয়ায় বাঁচার চেয়ে নিজে নিজে বাঁচতে শিখো।তাহলে কাউকে চিন্তা করতে হবে না।আমি কথা গুলো শুনেই চুপ থাকলাম। সে চলে গেলো। আমি তার চলে যাওয়া দেখলাম যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। তখন পোড়া চোখে কপোল বেয়ে বরফ লোনা জল গড়িয়ে টুপটুপ করে অবিরত ঝরছে। বোবা মন ছটফটিয়ে চিৎকার করেছে।সেই চিৎকার সে-তো দূরের কথা আমার পাশের মানুষগুলোও দেখতে বা শুনতে পায়নি।আমার কাজ শেষ হলে যথারীতি আমি মহাখালী বাসের উদ্দেশ্যে রওনা হই।ঢাকা শহর আমার কাছে একদমই নতুন জায়গা, নতুন সবকিছু।তবুও মনোবল না হারিয়ে তার কথা মত শক্ত থেকেছি। সে তো আমার কাছে জীবনে কিছুই চায়নি, চেয়েছে আমি যেন সারাটি জীবন একা পথ চলতে পারি কারো কোন সাহায্য ছাড়াই। আমি যেন প্রতিষ্ঠিত হই। তার জীবনের এটাই একমাত্র স্বপ্ন। আমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তার জীবনের যেকোনো কিছু খোয়াতে রাজি। সে তো আমাকে সারাজীবন বিনা শর্তে ভালোবেসে গেলো। তার তো কোন দাবি নাই আমার উপর! তাহলে আমি কেন তার স্বপ্ন পূরণ করবোনা! অবশ্যই করবো। আল্লাহ যেন আমাকে রহম করেন।তাকে তো এজীবনে আর কিছু দিতে পারবোনা,তার ঋণ কোনদিন শোধও করতে পারবোনা।একমাত্র আমি প্রতিষ্ঠিত হলেই তার শোধ হবে।এসব বলতে বলতে আমি আবারো উদাস হয়ে যাই।আমার ধ্যান ভাঙ্গে লগ্নজিতার কথায়। সে আমাকে কঠিন একটা প্রশ্ন করে শেষে। প্রশ্নটা উত্তর দিতে পারিনি। না দিয়েই বাস থেকে নেমে পড়ি। প্রশ্নটা ছিলো তনু আমার কে বা কি হয় তনু?
আমি এখন সকলকে বলছি; কিছু সম্পর্ক আছে যাদের কে কোন সাচে ফেলা যায় না। যাদের নির্দিষ্ট কোন সম্পর্কে আটকানো যায় না। জীবনে যেখানে যাকে প্রয়োজন তখন সেই মানুষটি সেই জায়গাটা পূর্ণ করে। সব প্রয়োজন মিটিয়ে চলে যায় দূরে। প্রয়োজনে তাকে ডাকতে হয়না। নিজে থেকেই হাজির হয়। তাই কিছু সম্পর্ক নামহীন সম্পর্ক।
নামহীন সম্পর্ক
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ