ঢাকা ০৯:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫

নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি আমাদের কী বার্তা দেয়

  • আপডেট সময় : ০৫:২৩:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

সুলতান মাহমুদ রানা : জাতীয় রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের রীতি উন্নত-অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার প্রতিফলন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তা, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ, শহর বা এমনকি পুরো দেশের নাম পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা। নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে প্রকাশ করে।

ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস বহু দেশের স্থাপনাগুলোর নামে রয়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক দেশই ঔপনিবেশিক নাম পরিবর্তন করে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মুম্বাই শহরটি ব্রিটিশ শাসনামলে ‘বোম্বে’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯৫ সালে শহরটির নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই রাখা হয়, যা স্থানীয় মারাঠি ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। একইভাবে আফ্রিকার অনেক দেশ স্বাধীনতার পর ঔপনিবেশিক নাম বদলে ফেলে। রোডেশিয়া নামটি পরিবর্তন করে জিম্বাবুয়ে রাখা হয়, যা দেশের আদিবাসী সংস্কৃতিকে সম্মান জানায়।

স্থাপনাগুলোর নামকরণ বা নাম পরিবর্তন প্রায়ই রাজনৈতিক আদর্শের প্রকাশ হিসেবে কাজ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে কমিউনিস্ট নেতাদের নামে থাকা রাস্তা বা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ- রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি সোভিয়েত আমলে ‘লেনিনগ্রাদ’ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শহরটির নাম আবার সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরিয়ে আনা হয়। এটি ছিল সোভিয়েত অতীত থেকে মুক্তির প্রতীক। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর অনেক স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়, যা নতুন গণতান্ত্রিক ও বহুজাতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। জোহানেসবার্গের ‘কিংগওয়ে’ রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করে ‘জুলিয়াস মালেমা’ রাখা হয়, যা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানায়।

স্থাপনাগুলোর নামকরণ প্রায়ই জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ। তুরস্কের ইস্তান্বুল শহরটি আগে ‘কনস্টান্টিনোপল’ নামে পরিচিত ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের বিজয়ের পর শহরটির নাম পরিবর্তন করে ইস্তান্বুল রাখা হয়; যা তুরস্কের ইসলামিক ও অটোমান ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। একইভাবে ইরানের রাজধানী তেহরানের অনেক রাস্তা ও স্থাপনার নাম ইসলামিক বিপ্লবের পর পরিবর্তন করা হয়; যা দেশের ইসলামিক পরিচয়কে তুলে ধরে।

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা দলবাজির কারণে নাম বদলের খেলা বোধ হয় বাংলাদেশে ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম পরিবর্তন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নাম বদলের এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাই।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর পুরান ঢাকার মদন মোহন বসাক রোডের নাম দেওয়া হয় টিপু সুলতান রোড আর দীপালি বালিকা বিদ্যালয় হয়ে যায় কামরুন নেসা বালিকা বিদ্যালয়। এটা ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নামকরণ ও নামহরণের প্রতিযোগিতা শুরু করে।

অবশ্য আমরা লক্ষ করেছি, কোনো কোনো সময় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় নেতাদের সম্মানার্থে নামকরণের প্রবণতা। এক সময় রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটির নাম রাখা হয় শেরেবাংলা নগর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের নাম দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সবচেয়ে প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের নাম রাখা হয় মানিক মিয়া (তফাজ্জল হোসেন; যিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একজন অকুতোভয় সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব) এভিনিউ। এসব নামকরণ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক সময় নামকরণ ও নাম বদলের খেলাটি প্রতিযোগিতায় রূপ লাভ করে।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র বিমানবন্দরের নাম ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৯৭৯ সালে ঢাকার অদূরে কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক মানের নতুন একটি বিমানবন্দর চালু হলে তার নাম রাখা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামানুসারে তদানীন্তন বিএনপি সরকার এর নাম দেয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনামলে বিমানবন্দরটির নাম বদলিয়ে রাখা হয় ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। এই নাম বদলের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে, এ দেশের মানুষ যেহেতু সুফি আউলিয়াদের শ্রদ্ধা করে, সেহেতু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, যেহেতু হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংবিধান বাতিল এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী অবৈধ শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেহেতু তার নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবে না।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে রেডিওতে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামানুসারে রাখা হয় ‘এম এ হান্নান বিমানবন্দর’। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সে নাম পাল্টিয়ে রাখে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত দরবেশ হজরত শাহ আমানতের নামে। এখনো এর নাম ‘শাহ আমানত বিমানবন্দর’।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মিত ভৈরব সেতুর নাম বদলে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নামানুসারে রাখে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’। জোট সরকার ওই নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু’। এই সেতু উদ্বোধনকালে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘কোথাকার কে নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার।’

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার’ নাম দিয়ে দেশের প্রথম নভোথিয়েটারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক উদ্বোধনের সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার’। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতার এসে বঙ্গবন্ধু নামটি পুনঃস্থাপন করেন। এভাবে অসংখ্য নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশে দেখা গেছে।

শেখ হাসিনা টানা কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় নামকরণের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে; তা অভূতপূর্ব। তিনি নিজের নামে ছাড়াও তার পরিবারের একেকজন সদস্যের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ভবনের নামকরণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে অনেকগুলো। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। এখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সব প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ভবনের নাম পরিবর্তনের রীতিমতো হিড়িক পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে বা ঘটেছে, যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির অনেক কৃতী সন্তানদের নামে ভবনের নাম পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। পতিত সরকারের পরিবার সংশ্লিষ্ট নাম পরিবর্তনের যৌক্তিকতা থাকতে পারে। কিন্তু এসব কৃতী সন্তান কী দোষ করল? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকা রাখা এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নামে; যা নিয়ে রীতিমতো সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সবাই বর্তমান বাস্তবতায় এমন নামকরণের যৌক্তিকতা খুঁজছেন।
স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন সব সময়ই বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো ঐতিহাসিক স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কনফেডারেট জেনারেলদের নামে থাকা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছে। কিছু মানুষ এটিকে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হিসেবে দেখেন, আবার অন্যরা এটিকে অতীতকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেন।

লেখক:, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সেনাবাহিনী জুলাই আন্দোলনে আহতদের পাশে থাকবে: সেনাপ্রধান

নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি আমাদের কী বার্তা দেয়

আপডেট সময় : ০৫:২৩:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

সুলতান মাহমুদ রানা : জাতীয় রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের রীতি উন্নত-অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার প্রতিফলন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তা, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ, শহর বা এমনকি পুরো দেশের নাম পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা। নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে প্রকাশ করে।

ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস বহু দেশের স্থাপনাগুলোর নামে রয়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক দেশই ঔপনিবেশিক নাম পরিবর্তন করে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মুম্বাই শহরটি ব্রিটিশ শাসনামলে ‘বোম্বে’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯৫ সালে শহরটির নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই রাখা হয়, যা স্থানীয় মারাঠি ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। একইভাবে আফ্রিকার অনেক দেশ স্বাধীনতার পর ঔপনিবেশিক নাম বদলে ফেলে। রোডেশিয়া নামটি পরিবর্তন করে জিম্বাবুয়ে রাখা হয়, যা দেশের আদিবাসী সংস্কৃতিকে সম্মান জানায়।

স্থাপনাগুলোর নামকরণ বা নাম পরিবর্তন প্রায়ই রাজনৈতিক আদর্শের প্রকাশ হিসেবে কাজ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে কমিউনিস্ট নেতাদের নামে থাকা রাস্তা বা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ- রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি সোভিয়েত আমলে ‘লেনিনগ্রাদ’ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শহরটির নাম আবার সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরিয়ে আনা হয়। এটি ছিল সোভিয়েত অতীত থেকে মুক্তির প্রতীক। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর অনেক স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়, যা নতুন গণতান্ত্রিক ও বহুজাতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। জোহানেসবার্গের ‘কিংগওয়ে’ রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করে ‘জুলিয়াস মালেমা’ রাখা হয়, যা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানায়।

স্থাপনাগুলোর নামকরণ প্রায়ই জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ। তুরস্কের ইস্তান্বুল শহরটি আগে ‘কনস্টান্টিনোপল’ নামে পরিচিত ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের বিজয়ের পর শহরটির নাম পরিবর্তন করে ইস্তান্বুল রাখা হয়; যা তুরস্কের ইসলামিক ও অটোমান ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। একইভাবে ইরানের রাজধানী তেহরানের অনেক রাস্তা ও স্থাপনার নাম ইসলামিক বিপ্লবের পর পরিবর্তন করা হয়; যা দেশের ইসলামিক পরিচয়কে তুলে ধরে।

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা দলবাজির কারণে নাম বদলের খেলা বোধ হয় বাংলাদেশে ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম পরিবর্তন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নাম বদলের এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাই।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর পুরান ঢাকার মদন মোহন বসাক রোডের নাম দেওয়া হয় টিপু সুলতান রোড আর দীপালি বালিকা বিদ্যালয় হয়ে যায় কামরুন নেসা বালিকা বিদ্যালয়। এটা ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নামকরণ ও নামহরণের প্রতিযোগিতা শুরু করে।

অবশ্য আমরা লক্ষ করেছি, কোনো কোনো সময় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় নেতাদের সম্মানার্থে নামকরণের প্রবণতা। এক সময় রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটির নাম রাখা হয় শেরেবাংলা নগর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের নাম দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সবচেয়ে প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের নাম রাখা হয় মানিক মিয়া (তফাজ্জল হোসেন; যিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একজন অকুতোভয় সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব) এভিনিউ। এসব নামকরণ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক সময় নামকরণ ও নাম বদলের খেলাটি প্রতিযোগিতায় রূপ লাভ করে।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র বিমানবন্দরের নাম ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৯৭৯ সালে ঢাকার অদূরে কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক মানের নতুন একটি বিমানবন্দর চালু হলে তার নাম রাখা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামানুসারে তদানীন্তন বিএনপি সরকার এর নাম দেয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনামলে বিমানবন্দরটির নাম বদলিয়ে রাখা হয় ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। এই নাম বদলের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে, এ দেশের মানুষ যেহেতু সুফি আউলিয়াদের শ্রদ্ধা করে, সেহেতু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, যেহেতু হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংবিধান বাতিল এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী অবৈধ শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেহেতু তার নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবে না।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে রেডিওতে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামানুসারে রাখা হয় ‘এম এ হান্নান বিমানবন্দর’। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সে নাম পাল্টিয়ে রাখে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত দরবেশ হজরত শাহ আমানতের নামে। এখনো এর নাম ‘শাহ আমানত বিমানবন্দর’।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মিত ভৈরব সেতুর নাম বদলে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নামানুসারে রাখে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’। জোট সরকার ওই নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু’। এই সেতু উদ্বোধনকালে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘কোথাকার কে নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার।’

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার’ নাম দিয়ে দেশের প্রথম নভোথিয়েটারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক উদ্বোধনের সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার’। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতার এসে বঙ্গবন্ধু নামটি পুনঃস্থাপন করেন। এভাবে অসংখ্য নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশে দেখা গেছে।

শেখ হাসিনা টানা কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় নামকরণের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে; তা অভূতপূর্ব। তিনি নিজের নামে ছাড়াও তার পরিবারের একেকজন সদস্যের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ভবনের নামকরণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে অনেকগুলো। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। এখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সব প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ভবনের নাম পরিবর্তনের রীতিমতো হিড়িক পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে বা ঘটেছে, যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির অনেক কৃতী সন্তানদের নামে ভবনের নাম পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। পতিত সরকারের পরিবার সংশ্লিষ্ট নাম পরিবর্তনের যৌক্তিকতা থাকতে পারে। কিন্তু এসব কৃতী সন্তান কী দোষ করল? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকা রাখা এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নামে; যা নিয়ে রীতিমতো সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সবাই বর্তমান বাস্তবতায় এমন নামকরণের যৌক্তিকতা খুঁজছেন।
স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন সব সময়ই বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো ঐতিহাসিক স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কনফেডারেট জেনারেলদের নামে থাকা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছে। কিছু মানুষ এটিকে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হিসেবে দেখেন, আবার অন্যরা এটিকে অতীতকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেন।

লেখক:, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়