ঢাকা ১১:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নাজুক দরজায় মজবুত তালা

  • আপডেট সময় : ০৯:১১:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২১
  • ৪৫ বার পড়া হয়েছে

ওয়াসীম পলাশ : মুহূর্তেই মায়ের চেহারাটা অপরিচিত মনে হয়েছিল সারওয়ারের। যেদিন মাকে বললেন যে এবার কিছুদিন এখানে থাকতে চান এবং এখানেই কিছু করতে চান। বিদেশ থেকে যখন ফোনে কথা হতো, তখন মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের চোখে একধরনের আনন্দের ঝিলিক দেখা যেত। তার সন্তান উন্নত দেশে থাকে, নাগরিকত্বও পেয়েছে—এটা নিয়ে গর্বের কমতি ছিল না। কিন্তু এ কোন মতিভ্রম তার! এত উন্নত দেশ, উন্নত সুযোগ–সুবিধা রেখে কেউ কি সরব কান্নার দেশে এই দোজকের মধ্যে থাকতে চায়?
ভ্যাপসা গরম ও অচেতন ব্যস্ততা লেপ্টে আছে চারপাশে। একটু স্থিরভাবে বসার ইচ্ছা হলো সারওয়ারের। দীর্ঘ ছয় বছর পর দেশে ফিরেছেন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে। এবার দীর্ঘদিন দেশে থাকার ইচ্ছা।
এ কয়েক বছরে সারওয়ার অনেকটা ধীরস্থির হয়ে গেছেন। সবকিছুর মধ্যে থেকেও যেন নেই—অদ্ভুত এক মানসিক অনুপস্থিতি। কেমন এক অজানা তৃষ্ণা যেন পেয়ে বসেছে তাকে! সবকিছু অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তার।
গোসল সেরে পরিচ্ছন্ন চাদরটার ওপরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন সারওয়ার। মন্ট্রিলের আকাশের সঙ্গে ঢাকার আকাশের এক বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করলেন। ভাবলেশহীনভাবে তাকালেন জীর্ণ এক তলা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোর দিকে। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে এক অসৌজন্যমূলক বৈষম্য লক্ষ করলেন তিনি। এ বৈষম্য ভেতরকার। যেমন পাশের নতুন নতুন উড়ালসড়কের নিয়ন বাতির নিচেই ছিন্নমূল মানুষের বস্তিঘর। ভাবলেশহীন পর্যবেক্ষণের মধ্যে মিহি কিন্তু ধারালো কান্নার শব্দ তার কানে বাজল। এই মেগা সিটির হাজারো শিশুর কান্নার মধ্যে এ কান্না কোনো পার্থক্য গড়তে পারল না। এ ভূখ-ে কত রকমের কান্না—প্রকৃতির কান্না, মানুষের কান্না, নারীর কান্না, শিশুর কান্না, ব্যর্থতার কান্না, সফলতার কান্না। কিন্তু এ কান্না অদ্ভুত; শহরের সবকিছুকে ভেদ করে যেন ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে—লম্বালম্বি ও দিগন্ত রেখায়। এই শহরের দিগন্ত এখন আর ঠাহর করা যায় না। কিন্তু অন্যরা কি কান্না শুনতে পাচ্ছে না? নাকি এ শুধু সারওয়ারের কান ও হৃদয়েকেই বিদ্ধ করছে?
দুপুরের খাবার সেরে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমানোর পর আবারো উঠে বিছানায় বসলেন সারওয়ার। সূর্য অনেকটা ক্লান্ত, শহরটা যেন ঝিমাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে তিনি ভাবছেন, এখানে অনেক কিছু করার আছে এবং তা খুব জরুরিও। মুহূর্তেই ভেতর থেকে কে যেন তাকে স্থির করে দেয়। তার নিজের ভেতরের এই দ্বৈততা ইদানীং আরও বেড়েছে। তিনি আবারও শুনতে পেলেন সেই কান্না। একটু মনোযোগ দিয়ে ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন আসলে শব্দটা কোথা থেকে আসছে। জানালা দিয়ে উকিঁঝুকি দিয়ে খেয়াল করলেন, পশ্চিমে ঘেঁষা দোতলায় যে ছোট্ট একটা ঘর, ওখান থেকে এক শিশুর কান্না ভেসে আসছে। ঘরে শুধু ছোট একটা জানালা, সামান্য একটু ফাঁকা। ঢাকায় আসার পর খুব বেশি একটা বের হচ্ছেন না সারওয়ার। আবহওয়া ও চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য একটু সময় নিচ্ছেন।
কিন্তু কান্নার শব্দ তাকে স্থির থাকতে দিল না। সিঁড়ি ভেঙে বাসার নিচে নেমে বুঝতে পারলেন, ১০০ হাত দূরের ওই ছোট ঘরে ছোট্ট ঘরে পৌঁছাতে তার নূ৵নতম আধমাইল ঘুরতে হবে। শহরের সরল মানুষগুলো বাড়ির নম্বর ও রাস্তাগুলোকে কীভাবে এত জটিল করে ফেলল—এটা একটা চিন্তার বিষয়।
কয়েকজন পথচারীর সহায়তায় সরু নোংরা গলি পেরিয়ে সরওয়ার পৌঁছালেন বাড়িটার সামনে। টিনের ওপরে কাঠের আধভাঙা গেট ঠেলে অদ্ভুত এক শোরগোল ও নানান বয়সী মানুষের আনাগোনা দেখতে পেলেন। দুই পাশে সারি সাারি খুপরির মতো ঘর, মধ্যে সরু করিডর ধরে এগিয়ে যান সারওয়ার। বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে এই আগন্তুক যেন এক বিস্ময়! এ রকমের ভদ্রলোকের অনুপ্রবেশ এ বাড়িতে মোটেও কাম্য নয়।
ছোট এক কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে কাঠের নাজুক সিঁড়ি বেঁয়ে সারওয়ার ওপরে ওঠেন। আরও কয়েকটা শিশু–কিশোরও তার সঙ্গে ওপরে ওঠে। সূর্য লাল হয়ে গেছে, অনেকটা ক্লান্ত; হেলে পড়ছে। সাওয়ার দেখলেন ছোট ঘরটি তালাবদ্ধ। তবে ভেতরের কান্নাটি তখনো চলছে।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অস্থিরতা বাড়ে সারওয়ারের মধ্যে। বন্ধ তালাটিতে বার কয়েক ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু দরজায় ঝুলছে মজবুত এক তালা। সঙ্গের কিশোরটি আগ বাড়িয়ে বলে, ‘ওর মা আইব আর কতক্ষণ বাদে। এরহম হারা দিন কানতে থাহে। মা কামে গেছে। দেহার কেউ নাই। হারা দিন খালি চিল্লায়। মাথাডা বড়, বইতে পারে না। হুইতেও পারে না। মনে হয় ভূতটুত কিছু একটা আছে! এর লাইগাই এই জায়গায় পোলাডা লইয়া একলা থাহে। নিচে কেউ থাকতে দিতে চায় না।’
সারওয়ার কিশোরটির কাছে জানতে চান, ‘এ ঘরের চাবি কার কাছে?’
‘একটা ওর মার কাছে আরেকটা ঘরের মালিকের কাছে। মালিক নিচে আছে। হ্যারে ডাইক্কা আনুম?’
নিচে গিয়ে বাচ্চু মিয়াকে ডেকে আনে কিশোরটি। বাচ্চু মিয়া পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, চুল আধা পাকা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং মাঝারি গড়নের শরীর। ব্যস্তভাবে সে সারওয়ারকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী লাগবে?’
‘ঘরের চাবি কার কাছে? এর ভেতরে যে শিশুটি কাঁদে, সে কার? ওর মা বাবা কোথায়?’ জানতে চান সারওয়ার।
কাঁচুমাচু মুখে বাচ্চু মিয়া বলে যায়, ‘পোলাডার অসুখ। বাপের খোঁজ নাই, আর ছেমড়িটা কামে গেছে।’
‘তাহলে দরজাটা খোলেন বাচ্চাটা তো অনেকক্ষণ যাবত কাঁদছে, দেখি ওর কী সমস্যা।’
সারওয়ারের মতো ভদ্রলোকদের ভাষা বুঝতে পারেন বাচ্চু মিয়া। এটাও ঠাহর করতে তার দেরি হয় না যে লোকটা এই এলাকার বাসিন্দা না, আর তিনি এই সব রীতি–রেওয়াজও বোঝেন না। এই নোংরা গলিতে, সরু সিঁড়িতে, খুপরির মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে যা সোজা চোখে ঠাহর করা যায় না। এসব সারওয়ার বুঝতে পারেন না, কিন্তু বাচ্চু মিয়ার নিশ্বাস–প্রশ্বাসে লেগে আছে এ নগরের চব্বিশ ঘণ্টা।
বাচ্চু মিয়া সরল উত্তর দেয়, ‘এটা খোলন যাইব না। বাচ্চার মায় আইয়া খুলব। কোনো কিছু চুরি গেলে আমারে ধরব। খামাখা ব্যাজালে যাইতে চাই না।’
সারওয়ার তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না; আমি দেখব। বাচ্চাটার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
সারওয়ারের হৃদয়ের ভালোবাসা ও উদ্বেগের একটা অংশ বাচ্চু মিয়াও টের পায়, কিন্তু সে এ–ও বোঝে, এই লোকটার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। ভিনদেশি মানুষের নাহান ভাবে। কয়েক মিনিটের বচসা আর কান্নার শব্দ মিলে সারওয়ারের মধ্যে সূক্ষ্ম এক ক্রোধের জন্ম হয়। তিনি টের পান, এটা ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে। সারওয়ার বাচ্চু মিয়ার দিকে তাকান স্বাভাবিক এক নির্লিপ্ততায়। এর মধ্যে পড়ন্ত বিকেলের নীরবতা ভেঙে এক কিশোরী দৌড়ে এসে বলে, ‘ছেমরি আইছে; ওর মায় আইছে।’
কিছুক্ষণ পর আবার সেই ঘরের সামনে আসেন সারওয়ার। ছোট ঘরের বাইরে জটলা পাকানো কয়েকজন মানুষকে সরিয়ে অস্তগামী সূর্যের মতো পৃথিবীকে পেছনে ফেলে এসে দাঁড়ান দরজায়। এ সময় বন্ধ ঘরের তালা খোলে এক কিশোরী মেয়ে, সে–ই ক্রন্দনরত শিশুটির মা।
ঘরের ভেতরটা দেখলে তালাটাকেই বেকার মনে হয়। সব আয়োজন যেন অর্থহীন। একদিকে চোখ ধাঁধানো সেতু, উড়ালসড়ক, উন্নয়ন, আর নিচের এ ক্ষয়ে যাওয়া জীবন তার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাচ্চু মিয়ার মনে হয়, আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। বাচ্চাগুলোকে ‘ভাগ’ বলে একটা আওয়াজ করে সে। দু-একটি অত্যুৎসাহী বাচ্চা ছাড়া অন্যরা চলে যায়। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার একটা তাড়া বোধ হয় সব ঘরেই থাকে, ঘর না থাকলেও। দীর্ঘ ছয় বছরের প্রবাস জীবনে সারওয়ারের এভাবে বিমর্ষ সন্ধ্যা আর দেখা হয়নি। এমন সন্ধ্যার প্রত্যাশা তিনি কখনো করেননি। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন দরজার বাইরে। আধো আলো ঘরটিতে ঢুকে আর একটা আলো জ্বালিয়ে দেন। এবার কান্নার শব্দ তার আসল রূপ ধারণ করে। এ এক অসহনীর কান্না। শিশুটি মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাথাটা স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বেশ বড়। বয়স তিন–চারের মতো, বসতে ও দাঁড়াতে পারে না। মলমূত্রের মধ্যে ছোট কাপড়চোপড়ে লেপ্টে আছে তার শরীর। একটা ছোট কাঠের চৌকির ওপর একটা ময়লা চাদর, তার ওপর প্লাস্টিকের একটা নীল পাটি। সব মিলিয়ে যা দৃশ্যমান তা সারওয়ারের চোখ মেনে নিতে পারছে না। ক্রোধের মাত্রাটা বেড়ে গেল। বাচ্চার মাকে তিনি বললেন, ‘আপনাকে আমি পুলিশে দেব। আপনি এ শিশুকে এভাবে আটকে রেখে কোথায় গিয়েছিলেন? বাচ্চাটা দীর্ঘ চার–পাঁচ ঘণ্টা ধরে বদ্ধ ঘরে শুধু কাঁদছে।’
তরুণী মায়ের যে দীর্ঘস্থায়ী কান্না তা কি সারওয়ার আঁচ করতে পারেন?
এই ক্রোধ, এই শব্দ যেন অপচয় হয়ে গেল। হাহাকার, চিৎকার, অনুভূতি—মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল অথবা শক্তির নিত্যতা সূত্রে অন্য কোথাও আশ্রয় নিল অন্য কোনো রূপে। শিশুটির মা তার গায়ের ময়লা নোংরা কাপড় খুলে এবং পাটি সরিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। কয়েক মগ পানি দিয়ে বাচ্চার শরীরটা ধুয়ে একটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে দিল। আরেকটা পাটি বিছিয়ে শুইয়ে দিল আবার। শরীরটাকে একটা পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিল। একটা বোতল থেকে কিছু বাসি তরল খাবার ফিডারে ঢেলে তা পুরে দিল বাচ্চার মুখে। এতে বাচ্চাটার কান্না কিছুটা কমল কিন্তু বন্ধ হলো না। মনে হয় মায়ের শরীরের চিরায়ত ঘ্রাণটা টের পেল বাচ্চাটা।
সারওয়ার ঘরের ভেতরে এক পা বাড়িয়ে দিলেন। আট ফুট বাই ছয় ফুটের মতো ছোট ঘর। সেখানে ছোট একটা চৌকি। কয়েকটা হাঁড়ি–পাতিল, কাপড়চোপড়, পুরোনো টিনের ট্রাঙ্ক, সেটাও তালাবদ্ধ। ওপরে ছোট ফ্যান ঝুলছে। চলে বলে মনে হলো না। তরুণী মা একটা ছোট বসার টুল বাড়িয়ে দেয় সারওয়ারের দিকে। দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই। ভাবলেশহীন সবকিছু যেন স্বাভাবিক—চন্দ্র, সূর্যের মতো নিত্য। যেন এ পৃথিবীতে কখনো কিছু ঘটেনি, সবই একইভাবে চলমান। সারওয়ারের কাছে বিষয়টা কিছুটা অলৌকিক মনে হয়।
এই তরুণী মায়ের নির্লিপ্ততা কি এই উর্বর মাটির নির্লিপ্ততা? সারওয়ার ভাবেন। ভালোভাবে তাকান শিশুটির দিকে। শিশুটি কয়েক মাত্রার জন্মগত অসুস্থতা ও অস্বাভাবিকতা নিয়ে বেঁচে আছে। মা–ও তার স্বাভাবিক কাজকর্ম নিভৃতে করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সারওয়ার একবার তাকান মায়ের মুখে, বয়স একুশ–বাইশের মতো, শ্যামবর্ণ, ক্লান্ত শরীর, যতœহীনতায় আক্রান্ত। চোখ দুটি যেন কিছুই খোঁজে না। মুহূর্তেই সারওয়ারের মন্ট্রিলের সেই স্কুলের কথা মনে পড়ে, যেখানে এই সব শিশুর জন্য কী আন্তরিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বাবা–মা, শিক্ষক ও নার্সরা। আর এখানে এই মায়ের কী অসহায় একক সংগ্রাম! শহরের এই মা যেন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন—একা। স্বামী ফেলে গেছে, সমাজ ও পরিবার–পরিজন পরিত্যক্ত ক্ষুদ্রাংশে উঠিয়ে রেখে গেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের অট্টহাসি যেন সর্বত্র।
বেশ কিছু প্রশ্ন সারওয়ারের মাথায় ঘুরপাক খায়। এর কয়েকটি তিনি ভদ্র ও সুন্দরভাবে জিজ্ঞেসও করেন। কোনো উত্তর মেলে না। তরুণী মায়ের মতো সারওয়ারও খুব অসহায়বোধ করেন। মনে হয় এসব প্রশ্ন অর্থহীন। এই ছোট ঘরটিতে এখন শুধু সারওয়ার, তরুণী মা আর তার সন্তান। শিশুটি তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তবে মায়ের উপস্থিতি অনুভব করার ক্ষমতা এখন তাকে রাগিয়ে তুলেছে মনে হয়। এক প্রচ্ছন্ন অভিমান।
সরওয়ার বেরিয়ে আসবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন। ওয়ালেট থেকে বের করে কিছু টাকা মায়ের হাতে দিতে চাইলেন। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করতে না পেরে বাচ্চাটির কাছে বিছানায় রাখলেন। এরপর ‘আসি’ বলে যখন ওই ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন, তখনই বিছানায় রাখা টাকাগুলোকে সারওয়ারের হাতে ফেরত দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হলো মা। সারওয়ার আরও একবার মেয়েটির মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেন, সাহস পেলেন না।
জীবনে পরাজয় তো থাকেই। কিন্তু এমন পরাজয় কখনো ভেতর ও বাহিরকে অবশ করে দেয়।
বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন সারওয়ার। একটু পরে মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে, তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। মা বুঝতে পারলেন, সন্তানের ভেতরে তোলপাড় চলছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
কোনো উত্তর এল না। একটু পরে সারওয়ার তার স্ত্রীকে ফোন করে, সন্তানদের সঙ্গেও কথা বললেন। মনে হয় নিজের সঙ্গে কী যেন একটা হিসাব মোলানোর চেষ্টা করছেন তিনি, কিন্তু হিসাবটা মিলছে না। ওই তরুণী মায়ের নির্লিপ্ততা তাকে বিপর্যস্ত করেই চলেছে। তার সারা জীবনের হিসাব–নিকাশ যেন ওলটপালট হয়ে গেছে।
আরও একটা রাত কেটে যায়। ভোর আসে শহরে। সবকিছু মেতে ওঠে তার পৌনঃপুনিকতায়। কিন্তু আজ কোনো শব্দ নেই, কান্না নেই, এমনকি নেই কোনো তাৎপর্যপূর্ণ নির্লিপ্ততাও। সকালের নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়েন সারওয়ার। আজ পথটা তার চেনা। গলির ধারের মোড় থেকে কিছু খাবার ও ফল নিয়ে ধীরে ধীরে তিনি হাজির হন ওই দরজায়। এক অচেনা নৈঃশব্দ৵ যেন ভর করেছে চারপাশে।
সেই নাজুক দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তালাটি নেই কড়ায়। কড়া নাড়েন সারওয়ার। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, কান্নাও নেই।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নাজুক দরজায় মজবুত তালা

আপডেট সময় : ০৯:১১:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২১

ওয়াসীম পলাশ : মুহূর্তেই মায়ের চেহারাটা অপরিচিত মনে হয়েছিল সারওয়ারের। যেদিন মাকে বললেন যে এবার কিছুদিন এখানে থাকতে চান এবং এখানেই কিছু করতে চান। বিদেশ থেকে যখন ফোনে কথা হতো, তখন মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের চোখে একধরনের আনন্দের ঝিলিক দেখা যেত। তার সন্তান উন্নত দেশে থাকে, নাগরিকত্বও পেয়েছে—এটা নিয়ে গর্বের কমতি ছিল না। কিন্তু এ কোন মতিভ্রম তার! এত উন্নত দেশ, উন্নত সুযোগ–সুবিধা রেখে কেউ কি সরব কান্নার দেশে এই দোজকের মধ্যে থাকতে চায়?
ভ্যাপসা গরম ও অচেতন ব্যস্ততা লেপ্টে আছে চারপাশে। একটু স্থিরভাবে বসার ইচ্ছা হলো সারওয়ারের। দীর্ঘ ছয় বছর পর দেশে ফিরেছেন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে। এবার দীর্ঘদিন দেশে থাকার ইচ্ছা।
এ কয়েক বছরে সারওয়ার অনেকটা ধীরস্থির হয়ে গেছেন। সবকিছুর মধ্যে থেকেও যেন নেই—অদ্ভুত এক মানসিক অনুপস্থিতি। কেমন এক অজানা তৃষ্ণা যেন পেয়ে বসেছে তাকে! সবকিছু অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তার।
গোসল সেরে পরিচ্ছন্ন চাদরটার ওপরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন সারওয়ার। মন্ট্রিলের আকাশের সঙ্গে ঢাকার আকাশের এক বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করলেন। ভাবলেশহীনভাবে তাকালেন জীর্ণ এক তলা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোর দিকে। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে এক অসৌজন্যমূলক বৈষম্য লক্ষ করলেন তিনি। এ বৈষম্য ভেতরকার। যেমন পাশের নতুন নতুন উড়ালসড়কের নিয়ন বাতির নিচেই ছিন্নমূল মানুষের বস্তিঘর। ভাবলেশহীন পর্যবেক্ষণের মধ্যে মিহি কিন্তু ধারালো কান্নার শব্দ তার কানে বাজল। এই মেগা সিটির হাজারো শিশুর কান্নার মধ্যে এ কান্না কোনো পার্থক্য গড়তে পারল না। এ ভূখ-ে কত রকমের কান্না—প্রকৃতির কান্না, মানুষের কান্না, নারীর কান্না, শিশুর কান্না, ব্যর্থতার কান্না, সফলতার কান্না। কিন্তু এ কান্না অদ্ভুত; শহরের সবকিছুকে ভেদ করে যেন ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে—লম্বালম্বি ও দিগন্ত রেখায়। এই শহরের দিগন্ত এখন আর ঠাহর করা যায় না। কিন্তু অন্যরা কি কান্না শুনতে পাচ্ছে না? নাকি এ শুধু সারওয়ারের কান ও হৃদয়েকেই বিদ্ধ করছে?
দুপুরের খাবার সেরে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমানোর পর আবারো উঠে বিছানায় বসলেন সারওয়ার। সূর্য অনেকটা ক্লান্ত, শহরটা যেন ঝিমাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে তিনি ভাবছেন, এখানে অনেক কিছু করার আছে এবং তা খুব জরুরিও। মুহূর্তেই ভেতর থেকে কে যেন তাকে স্থির করে দেয়। তার নিজের ভেতরের এই দ্বৈততা ইদানীং আরও বেড়েছে। তিনি আবারও শুনতে পেলেন সেই কান্না। একটু মনোযোগ দিয়ে ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন আসলে শব্দটা কোথা থেকে আসছে। জানালা দিয়ে উকিঁঝুকি দিয়ে খেয়াল করলেন, পশ্চিমে ঘেঁষা দোতলায় যে ছোট্ট একটা ঘর, ওখান থেকে এক শিশুর কান্না ভেসে আসছে। ঘরে শুধু ছোট একটা জানালা, সামান্য একটু ফাঁকা। ঢাকায় আসার পর খুব বেশি একটা বের হচ্ছেন না সারওয়ার। আবহওয়া ও চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য একটু সময় নিচ্ছেন।
কিন্তু কান্নার শব্দ তাকে স্থির থাকতে দিল না। সিঁড়ি ভেঙে বাসার নিচে নেমে বুঝতে পারলেন, ১০০ হাত দূরের ওই ছোট ঘরে ছোট্ট ঘরে পৌঁছাতে তার নূ৵নতম আধমাইল ঘুরতে হবে। শহরের সরল মানুষগুলো বাড়ির নম্বর ও রাস্তাগুলোকে কীভাবে এত জটিল করে ফেলল—এটা একটা চিন্তার বিষয়।
কয়েকজন পথচারীর সহায়তায় সরু নোংরা গলি পেরিয়ে সরওয়ার পৌঁছালেন বাড়িটার সামনে। টিনের ওপরে কাঠের আধভাঙা গেট ঠেলে অদ্ভুত এক শোরগোল ও নানান বয়সী মানুষের আনাগোনা দেখতে পেলেন। দুই পাশে সারি সাারি খুপরির মতো ঘর, মধ্যে সরু করিডর ধরে এগিয়ে যান সারওয়ার। বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে এই আগন্তুক যেন এক বিস্ময়! এ রকমের ভদ্রলোকের অনুপ্রবেশ এ বাড়িতে মোটেও কাম্য নয়।
ছোট এক কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে কাঠের নাজুক সিঁড়ি বেঁয়ে সারওয়ার ওপরে ওঠেন। আরও কয়েকটা শিশু–কিশোরও তার সঙ্গে ওপরে ওঠে। সূর্য লাল হয়ে গেছে, অনেকটা ক্লান্ত; হেলে পড়ছে। সাওয়ার দেখলেন ছোট ঘরটি তালাবদ্ধ। তবে ভেতরের কান্নাটি তখনো চলছে।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অস্থিরতা বাড়ে সারওয়ারের মধ্যে। বন্ধ তালাটিতে বার কয়েক ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু দরজায় ঝুলছে মজবুত এক তালা। সঙ্গের কিশোরটি আগ বাড়িয়ে বলে, ‘ওর মা আইব আর কতক্ষণ বাদে। এরহম হারা দিন কানতে থাহে। মা কামে গেছে। দেহার কেউ নাই। হারা দিন খালি চিল্লায়। মাথাডা বড়, বইতে পারে না। হুইতেও পারে না। মনে হয় ভূতটুত কিছু একটা আছে! এর লাইগাই এই জায়গায় পোলাডা লইয়া একলা থাহে। নিচে কেউ থাকতে দিতে চায় না।’
সারওয়ার কিশোরটির কাছে জানতে চান, ‘এ ঘরের চাবি কার কাছে?’
‘একটা ওর মার কাছে আরেকটা ঘরের মালিকের কাছে। মালিক নিচে আছে। হ্যারে ডাইক্কা আনুম?’
নিচে গিয়ে বাচ্চু মিয়াকে ডেকে আনে কিশোরটি। বাচ্চু মিয়া পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, চুল আধা পাকা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং মাঝারি গড়নের শরীর। ব্যস্তভাবে সে সারওয়ারকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী লাগবে?’
‘ঘরের চাবি কার কাছে? এর ভেতরে যে শিশুটি কাঁদে, সে কার? ওর মা বাবা কোথায়?’ জানতে চান সারওয়ার।
কাঁচুমাচু মুখে বাচ্চু মিয়া বলে যায়, ‘পোলাডার অসুখ। বাপের খোঁজ নাই, আর ছেমড়িটা কামে গেছে।’
‘তাহলে দরজাটা খোলেন বাচ্চাটা তো অনেকক্ষণ যাবত কাঁদছে, দেখি ওর কী সমস্যা।’
সারওয়ারের মতো ভদ্রলোকদের ভাষা বুঝতে পারেন বাচ্চু মিয়া। এটাও ঠাহর করতে তার দেরি হয় না যে লোকটা এই এলাকার বাসিন্দা না, আর তিনি এই সব রীতি–রেওয়াজও বোঝেন না। এই নোংরা গলিতে, সরু সিঁড়িতে, খুপরির মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে যা সোজা চোখে ঠাহর করা যায় না। এসব সারওয়ার বুঝতে পারেন না, কিন্তু বাচ্চু মিয়ার নিশ্বাস–প্রশ্বাসে লেগে আছে এ নগরের চব্বিশ ঘণ্টা।
বাচ্চু মিয়া সরল উত্তর দেয়, ‘এটা খোলন যাইব না। বাচ্চার মায় আইয়া খুলব। কোনো কিছু চুরি গেলে আমারে ধরব। খামাখা ব্যাজালে যাইতে চাই না।’
সারওয়ার তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না; আমি দেখব। বাচ্চাটার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
সারওয়ারের হৃদয়ের ভালোবাসা ও উদ্বেগের একটা অংশ বাচ্চু মিয়াও টের পায়, কিন্তু সে এ–ও বোঝে, এই লোকটার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। ভিনদেশি মানুষের নাহান ভাবে। কয়েক মিনিটের বচসা আর কান্নার শব্দ মিলে সারওয়ারের মধ্যে সূক্ষ্ম এক ক্রোধের জন্ম হয়। তিনি টের পান, এটা ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে। সারওয়ার বাচ্চু মিয়ার দিকে তাকান স্বাভাবিক এক নির্লিপ্ততায়। এর মধ্যে পড়ন্ত বিকেলের নীরবতা ভেঙে এক কিশোরী দৌড়ে এসে বলে, ‘ছেমরি আইছে; ওর মায় আইছে।’
কিছুক্ষণ পর আবার সেই ঘরের সামনে আসেন সারওয়ার। ছোট ঘরের বাইরে জটলা পাকানো কয়েকজন মানুষকে সরিয়ে অস্তগামী সূর্যের মতো পৃথিবীকে পেছনে ফেলে এসে দাঁড়ান দরজায়। এ সময় বন্ধ ঘরের তালা খোলে এক কিশোরী মেয়ে, সে–ই ক্রন্দনরত শিশুটির মা।
ঘরের ভেতরটা দেখলে তালাটাকেই বেকার মনে হয়। সব আয়োজন যেন অর্থহীন। একদিকে চোখ ধাঁধানো সেতু, উড়ালসড়ক, উন্নয়ন, আর নিচের এ ক্ষয়ে যাওয়া জীবন তার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাচ্চু মিয়ার মনে হয়, আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। বাচ্চাগুলোকে ‘ভাগ’ বলে একটা আওয়াজ করে সে। দু-একটি অত্যুৎসাহী বাচ্চা ছাড়া অন্যরা চলে যায়। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার একটা তাড়া বোধ হয় সব ঘরেই থাকে, ঘর না থাকলেও। দীর্ঘ ছয় বছরের প্রবাস জীবনে সারওয়ারের এভাবে বিমর্ষ সন্ধ্যা আর দেখা হয়নি। এমন সন্ধ্যার প্রত্যাশা তিনি কখনো করেননি। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন দরজার বাইরে। আধো আলো ঘরটিতে ঢুকে আর একটা আলো জ্বালিয়ে দেন। এবার কান্নার শব্দ তার আসল রূপ ধারণ করে। এ এক অসহনীর কান্না। শিশুটি মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাথাটা স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বেশ বড়। বয়স তিন–চারের মতো, বসতে ও দাঁড়াতে পারে না। মলমূত্রের মধ্যে ছোট কাপড়চোপড়ে লেপ্টে আছে তার শরীর। একটা ছোট কাঠের চৌকির ওপর একটা ময়লা চাদর, তার ওপর প্লাস্টিকের একটা নীল পাটি। সব মিলিয়ে যা দৃশ্যমান তা সারওয়ারের চোখ মেনে নিতে পারছে না। ক্রোধের মাত্রাটা বেড়ে গেল। বাচ্চার মাকে তিনি বললেন, ‘আপনাকে আমি পুলিশে দেব। আপনি এ শিশুকে এভাবে আটকে রেখে কোথায় গিয়েছিলেন? বাচ্চাটা দীর্ঘ চার–পাঁচ ঘণ্টা ধরে বদ্ধ ঘরে শুধু কাঁদছে।’
তরুণী মায়ের যে দীর্ঘস্থায়ী কান্না তা কি সারওয়ার আঁচ করতে পারেন?
এই ক্রোধ, এই শব্দ যেন অপচয় হয়ে গেল। হাহাকার, চিৎকার, অনুভূতি—মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল অথবা শক্তির নিত্যতা সূত্রে অন্য কোথাও আশ্রয় নিল অন্য কোনো রূপে। শিশুটির মা তার গায়ের ময়লা নোংরা কাপড় খুলে এবং পাটি সরিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। কয়েক মগ পানি দিয়ে বাচ্চার শরীরটা ধুয়ে একটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে দিল। আরেকটা পাটি বিছিয়ে শুইয়ে দিল আবার। শরীরটাকে একটা পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিল। একটা বোতল থেকে কিছু বাসি তরল খাবার ফিডারে ঢেলে তা পুরে দিল বাচ্চার মুখে। এতে বাচ্চাটার কান্না কিছুটা কমল কিন্তু বন্ধ হলো না। মনে হয় মায়ের শরীরের চিরায়ত ঘ্রাণটা টের পেল বাচ্চাটা।
সারওয়ার ঘরের ভেতরে এক পা বাড়িয়ে দিলেন। আট ফুট বাই ছয় ফুটের মতো ছোট ঘর। সেখানে ছোট একটা চৌকি। কয়েকটা হাঁড়ি–পাতিল, কাপড়চোপড়, পুরোনো টিনের ট্রাঙ্ক, সেটাও তালাবদ্ধ। ওপরে ছোট ফ্যান ঝুলছে। চলে বলে মনে হলো না। তরুণী মা একটা ছোট বসার টুল বাড়িয়ে দেয় সারওয়ারের দিকে। দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই। ভাবলেশহীন সবকিছু যেন স্বাভাবিক—চন্দ্র, সূর্যের মতো নিত্য। যেন এ পৃথিবীতে কখনো কিছু ঘটেনি, সবই একইভাবে চলমান। সারওয়ারের কাছে বিষয়টা কিছুটা অলৌকিক মনে হয়।
এই তরুণী মায়ের নির্লিপ্ততা কি এই উর্বর মাটির নির্লিপ্ততা? সারওয়ার ভাবেন। ভালোভাবে তাকান শিশুটির দিকে। শিশুটি কয়েক মাত্রার জন্মগত অসুস্থতা ও অস্বাভাবিকতা নিয়ে বেঁচে আছে। মা–ও তার স্বাভাবিক কাজকর্ম নিভৃতে করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সারওয়ার একবার তাকান মায়ের মুখে, বয়স একুশ–বাইশের মতো, শ্যামবর্ণ, ক্লান্ত শরীর, যতœহীনতায় আক্রান্ত। চোখ দুটি যেন কিছুই খোঁজে না। মুহূর্তেই সারওয়ারের মন্ট্রিলের সেই স্কুলের কথা মনে পড়ে, যেখানে এই সব শিশুর জন্য কী আন্তরিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বাবা–মা, শিক্ষক ও নার্সরা। আর এখানে এই মায়ের কী অসহায় একক সংগ্রাম! শহরের এই মা যেন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন—একা। স্বামী ফেলে গেছে, সমাজ ও পরিবার–পরিজন পরিত্যক্ত ক্ষুদ্রাংশে উঠিয়ে রেখে গেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের অট্টহাসি যেন সর্বত্র।
বেশ কিছু প্রশ্ন সারওয়ারের মাথায় ঘুরপাক খায়। এর কয়েকটি তিনি ভদ্র ও সুন্দরভাবে জিজ্ঞেসও করেন। কোনো উত্তর মেলে না। তরুণী মায়ের মতো সারওয়ারও খুব অসহায়বোধ করেন। মনে হয় এসব প্রশ্ন অর্থহীন। এই ছোট ঘরটিতে এখন শুধু সারওয়ার, তরুণী মা আর তার সন্তান। শিশুটি তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তবে মায়ের উপস্থিতি অনুভব করার ক্ষমতা এখন তাকে রাগিয়ে তুলেছে মনে হয়। এক প্রচ্ছন্ন অভিমান।
সরওয়ার বেরিয়ে আসবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন। ওয়ালেট থেকে বের করে কিছু টাকা মায়ের হাতে দিতে চাইলেন। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করতে না পেরে বাচ্চাটির কাছে বিছানায় রাখলেন। এরপর ‘আসি’ বলে যখন ওই ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন, তখনই বিছানায় রাখা টাকাগুলোকে সারওয়ারের হাতে ফেরত দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হলো মা। সারওয়ার আরও একবার মেয়েটির মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেন, সাহস পেলেন না।
জীবনে পরাজয় তো থাকেই। কিন্তু এমন পরাজয় কখনো ভেতর ও বাহিরকে অবশ করে দেয়।
বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন সারওয়ার। একটু পরে মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে, তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। মা বুঝতে পারলেন, সন্তানের ভেতরে তোলপাড় চলছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
কোনো উত্তর এল না। একটু পরে সারওয়ার তার স্ত্রীকে ফোন করে, সন্তানদের সঙ্গেও কথা বললেন। মনে হয় নিজের সঙ্গে কী যেন একটা হিসাব মোলানোর চেষ্টা করছেন তিনি, কিন্তু হিসাবটা মিলছে না। ওই তরুণী মায়ের নির্লিপ্ততা তাকে বিপর্যস্ত করেই চলেছে। তার সারা জীবনের হিসাব–নিকাশ যেন ওলটপালট হয়ে গেছে।
আরও একটা রাত কেটে যায়। ভোর আসে শহরে। সবকিছু মেতে ওঠে তার পৌনঃপুনিকতায়। কিন্তু আজ কোনো শব্দ নেই, কান্না নেই, এমনকি নেই কোনো তাৎপর্যপূর্ণ নির্লিপ্ততাও। সকালের নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়েন সারওয়ার। আজ পথটা তার চেনা। গলির ধারের মোড় থেকে কিছু খাবার ও ফল নিয়ে ধীরে ধীরে তিনি হাজির হন ওই দরজায়। এক অচেনা নৈঃশব্দ৵ যেন ভর করেছে চারপাশে।
সেই নাজুক দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তালাটি নেই কড়ায়। কড়া নাড়েন সারওয়ার। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, কান্নাও নেই।