নিজস্ব প্রতিবেদক : কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ৫৪৩ দিন গৃহবন্দি থাকার পর আজ রোববার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী হতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। খুলতে যাচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিশু-কিশোর, তরুণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে আবার মুখর হবে শ্রেণিকক্ষ। তাদের পদচারণে প্রাণময় হয়ে উঠবে দীর্ঘ দেড় বছর নির্জীব পড়ে থাকা প্রিয় আঙিনা।
যে করোনা মহামারির কারণে এত দিন ধরে বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেই অদৃশ্য ভাইরাস যে দূর হয়ে গেছে তা নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
গত শুক্রবার রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে হাত ধোয়ার বেসিন ও পানির কল। পরিষ্কার করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত না হওয়া শ্রেণিকক্ষের টেবিল-চেযার আর মেঝে ও দেয়ালের ধুলো-ময়লা। স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা পালনে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেজন্য শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনাও করছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।
রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে প্রবেশের আগে তাপমাত্রা মাপা হবে। কারও তাপমাত্রা বেশি হলে তাকে বাসায় ফেরত পাঠানো হবে। স্কুলের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের মাস্ক দেওয়ারও পরিকল্পনা আছে।
এদিকে গতকাল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে প্রতি বেঞ্চে একজন শিক্ষার্থীর বেশি বসা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা জিগজ্যাগ তথা জেড বিন্যাসে বসবে। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে একই শ্রেণিকে একাধিক গ্রুপে ভাগ করে একাধিক কক্ষে ও একাধিক শিক্ষকের সহায়তায় পাঠদান চালাতে হবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এ রকম মোট ১৬টি নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
কোন শ্রেণির কয় দিন ক্লাস : আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও ক্লাস হবে সীমিত আকারে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সপ্তাহে ছয় দিন এবং ২০২২ সালের পরীক্ষার্থীদের দুই দিন করে ক্লাস নেওয়া হবে। এ ছাড়া অন্যান্য স্তরের ক্লাস এক দিন করে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নেওয়া হবে।
ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস সোমবার, সপ্তম শ্রেণির মঙ্গলবার, অষ্টম শ্রেণির বুধবার ও নবম শ্রেণির ক্লাস বৃহস্পতিবার নেওয়া হবে। মাধ্যমিকের সব স্তরে প্রতিদিন দুটি বিষয়ের চারটি করে ক্লাস করানো হবে। স্কুল-কলেজে প্রভাতী শাখায় সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হবে ক্লাস। চলবে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত। দিবা শাখায় বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে ক্লাস শুরু হবে। ক্লাস শেষ হবে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে। একটি শাখা শেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হবে। নতুন এই রুটিনে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ক্লাস ৪০ মিনিট করে নেওয়া হবে। যেসব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তর যুক্ত রয়েছে সেখানে এ সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্লাস রুটিন তৈরি করতে হবে। প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসে তিন ফুট দূরত্বে বসাতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের অবস্থা : গত ছয় মাসের অনুসন্ধান বলছে, গত দেড় বছরে প্রাথমিকের অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী দিনমজুর ও হকার বনে গেছেন। মাধ্যমিকের অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর এরই মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। সংসারের পাশাপাশি তারা আবারও শ্রেণিকক্ষে বসবে এমন ভাবনা নেই অধিকাংশের মধ্যে। ফলে আজ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও হয়তো অনেক পুরনো শিক্ষার্থীর দেখা মিলবে না শ্রেণিকক্ষে।
এদিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধূলোর স্তূপ জমেছিল। শিক্ষার্থীদের পদচারণ ছিল না বলে স্কুল মাঠে গজিয়ে উঠেছিল বড় বড় ঘাস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আবার শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কাজ চলেছে কয়েক দিন ধরে। গতকাল শেষ মুহূর্তে জোর চেষ্টা চলতে দেখা গেছে।
করোনা মহামারির সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে ডেঙ্গু চোখ রাঙাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিধনেও কাজ চলছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, করপোরেশন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সরকারি, বেসরকারি ও আধাসরকারি মোট ৪৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন দিনব্যাপী বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শেষ করেছে নগর কর্তৃপক্ষ।
স্কুলে উৎসবের সাজ, শিক্ষার্থীদের বরণ করা হবে চকলেট-ফুল দিয়ে : সরকারের তরফ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেয়ার পর নানা আয়োজনে শিক্ষার্থীদের বরণের প্রস্তুতি নিয়েছে রাজধানীর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ক্লাসরুম সাজানো হয়েছে বেলুন ও রঙিন কাগজ দিয়ে। নিজেদের চেনা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা জানানো হবে চকলেট ও ফুল দিয়ে। এর পাশাপাশি রাখা হয়েছে আইসোলেশন রুম সুবিধাসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা পদক্ষেপ।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, গেটেই রাখা আছে শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র। তার পাশে হাত ধোয়ার জন্য স্থাপন করা হয়েছে বেসিন। এক পাশে কোভিড-১৯ বিস্তার রোধে করণীয় নির্দেশনামূলক ফেস্টুন। স্কুলে ঢুকেই দেখা যায় সুন্দর এক দেয়াল লিখন। শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, কর্মচারীরা ধোয়ামোছার কাজ করছেন। কেউ ঝাড়ু দিচ্ছেন, কেউ বেঞ্চ পরিষ্কার করছেন। কেউ বেলুন ও রঙিন কাগজ দিয়ে ক্লাসরুম সাজাচ্ছেন। শিক্ষকরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে প্রস্তুতিমূলক কাজ করছেন।
উদয়ন স্কুলের কর্মচারী শ্যামল চন্দ্র ভৌমিক বলেন, পরিচ্ছন্নতার সব কাজ শেষ। আমরা শিক্ষার্থীদের বরণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অনেক দিন পর স্কুল খোলা হচ্ছে, ভালো লাগছে। শিক্ষার্থীরা আসবে এতেই ভালো লাগছে। বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখার সমন্বয়কারী ও সহকারী শিক্ষক সবিতা সাহা বলেন, দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাবো। ভালো লাগা কাজ করছে। আমাদের অস্তিত্ব শিক্ষার্থীদের নিয়ে। ওদের এই সুন্দর কচি মুখগুলো দেখবো। প্রাণবন্ত চেহারাগুলো দেখবো। ওদের সঙ্গে আমাদের ভাব বিনিময় হবে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কথা জানিয়ে সবিতা সাহা বলেন, শিক্ষার্থীরা খুব উৎসাহিত। আমরা তাদের বরণের জন্য যেমন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তারাও আমাদের দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। কখন আসবে, কখন দেখা হবে। নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে স্কুলটির প্রাথমিক শাখার এই সমন্বয়কারী বলেন, আমরা আমাদের দিক থেকে শতভাগ প্রস্তুত। বহু আগে থেকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখছি ক্যাম্পাস, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা না হয়। সব কাজ করেছি। বিদ্যালয়ের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ জহুরা বেগম বলেন, ২০২০ সাল থেকেই পরিচ্ছন্নতা শুরু করেছি। করোনাকালে গেটের পাশে বেসিন বসিয়েছি হাত ধোয়ার জন্য। গ্লাস, পানির ফিল্টার, পানির ট্যাংক পরিষ্কার করা, সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক, ফুল, চকলেটসহ সব কিছুর ব্যবস্থা করেছি। সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।
নিজেদের সুরক্ষার বিষয়ে অধ্যক্ষ জহুরা বেগম বলেন, এখানে কর্মরতদের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত, ডায়াবেটিস আক্রান্ত, বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা বাদে সবাই টিকা নিয়েছেন। ১০১ জন শিক্ষকের মধ্যে অধিকাংশই টিকা নিয়েছেন। যারা টিকা নিতে পারেননি তাদের সবাই রেজিস্ট্রেশন করেছেন। দ্রুতই টিকা পাবেন বলে আশা করছি।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। মরণ ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে কয়েক দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
নবপ্রাণে জাগবে শিক্ষাঙ্গন
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ